সাওমের ফজিলত

মাওলানা মো. লুৎফুর রহমান চৌধুরী

ইসলাম শরীয়তের অন্যতম রোকন হলো সাওম। সালাত ও যাকাত অস্বীকারকারী যেমন কাফির হয়ে যায় তেমনি সাওম অস্বীকারকারী কাফির হয়ে যায়। ইসলামী শরীয়তে এর অনেক ফজিলত রয়েছে। হযরত আবু হুরায়রা হতে বর্ণিত। তিনি বলেন, রাসুল (স.) ইরশাদ করেছেন, যে ব্যক্তি ঈমানের সাথে ও ছওয়াবের আশায় রমজান মাসে রোজা রাখে তার পূর্বের সমুদয় গুনাহ (সগিরা) মাফ হবে, যে ব্যক্তি ঈমানের সাথে ও ছওয়াবের আশায় রমজানের রাত ইবাদতে কাটাবে তার পূর্বের গুনাসমূহ মাফ করা হবে বরং এবং যে ব্যক্তি ঈমানের সাথে ও ছওয়াবের আশায় কদরের ইবাদাতে কাটাবে তার পূর্বকৃত সমুদয় গুনাহ মাফ করা হবে। (বুখারি ও মুসলিম) হাদিসে গুনাহ দ্বারা উদ্দেশ্য করা হয়েছে সগিরা গুনাহ। এ ব্যাপারে সকল মুহাদ্দিস একমত যে, কবিরা গুনাহ তাওবাহ ছাড়া মাফ হয় না। তবে রোজা পালনের সাথে তাওবার নিয়ত করলে কবিরা গুনাহ মাফ হওয়ার আশা করা যায়। অন্য হাদিসে আছে, সাহল ইবনে সা’দ (রা.) হতে বর্ণিত। তিনি বলেন, রাসুল (স.) ইরশাদ করেন, জান্নাতের আটটি দরজা রয়েছে। তন্মধ্যে একটি দরজার নাম রাইয়ান। ঐ দরজা দিয়েই শুধু রোজাদারগণই প্রবেশ করবেন। (বুখারি ও মুসলিম) রাইয়ান নামকরণ সম্পর্কে বিভিন্ন অভিমত রয়েছে: অর্থ- পরিতৃপ্ত হওয়া। অর্থাৎ রোজদার যে স্থানে প্রবেশ করবেন সেখানে অসংখ্য প্রবাহিত নহর, ফল-ফুলের বাগ-বাগিচা ও তৃপ্তিদায়ক বস্তুসমূহ বিদ্যমান থাকবে অথবা রোজা অবস্থায় তারা ক্ষুৎ-পিপাসায় একেবারে কাতর হয়ে পড়েছিল, তাই এখানে তাদেরকে পরিতৃপ্তি সহকারে প্রবেশ করানো হবে।
অন্য এক হাদিসে আছে, হযরত আবু হুরায়রা (রা.) হতে বর্ণিত। তিনি বলেন, রাসুল (স.) ইরশাদ করেছেন, আদম সন্তানের প্রতিটি নেক আমল দশ গুণ হতে সাত শত গুণ পর্যন্ত বাড়ানো হয়ে থাকে। আল্লাহ বলেন, কিন্তু রোজা এর ব্যতিক্রম। কেননা, রোজা একমাত্র আমার জন্য রাখা হয়। আর আমিই এর প্রতিদান করব। (আমার ইচ্ছা মতো) বান্দাহ আমার জন্য নিজের প্রবৃত্তি পানাহার পরিবহার করে থাকে। রোজাদারে দুটি আনন্দ রয়েছে- একটি তার ইফতারের সময় এবং অপরটি তার প্রতিপালকের সাথে সাক্ষাতের সময়। নিশ্চই রোজদারের মুখের গন্ধ আল্লাহ তাওয়ালার নিকট মিশকের সুগন্ধি হতে অধিক সুগন্ধিময়। রোজা হলো ঢালস্বরূপ। সুতরাং যখন তোমাদের কারও রোজার দিন আসে, সে অশ্লীল কথাবার্ত বলবে না এবং গ-গোল করবে না। তাকে যদি কেউ কটুকথা বলে অথবা লড়াই করতে চায়, তবে সে যেন বলে আমি একজন রোজাদার। (বুখারি ও মুসলিম)
রোজাকে ঢালস্বরূপ বলার অনেক কারণ মুহাদ্দিসগণ উল্লেখ করেন। মোল্লা আলী কারী বলেন, রোজা রোজদারের জন্য পার্থিব জীবনে অন্যায় থেকে এবং পরকালীন জীবনে নরকের অগ্নি থেকে বাঁচার ঢালস্বরূপ। কাজী আয়াজ (রা.) বলেন, রোজা মানুষকে যাবতীয় অপরাধ থেকে রক্ষা করে। তাই রোজাকে ঢাল বলা হয়েছে। আল্লামা আইনি বলেন, মানুষ পাশবিকতার কারণে দোযখে ধাবিত হয়, বিধায় রোজার উদ্দেশ্য হলো পাশবিক শক্তি কামনা ও বাসনাকে দমন করা।
শরীয়তে রোজার বিধান প্রবর্তনের হিকমত:
ইসলামী শরীয়তে রোজার বিধান প্রবর্তনের পিছনে অনেক হিকমত বিদ্যমান রয়েছে। যেমন-
১। রোজার মাধ্যমে বান্দাহ তাকওয়াহ অর্জন করে। কুরআনে বলা হয়েছে তারা যেন মুত্তাকি হতে পারে।
২। শয়তানের আক্রমণ প্রতিহত করার শ্রেষ্ঠ হাতিয়ার হলো রোজা। হাদিসে আছে রোজা ঢালস্বরূপ।
৩। রোজা পালনের মধ্যামে গুনাহসমূহ মাফ হয়ে যায়।
৪। রোজা জান্নাতে প্রবেশের মাধ্যম।
৫। রোজা আল্লাহর সান্নিধ্য ও নৈকট্য লাভের মাধ্যম।
৬। রোজার ম্যাধমে অবিরত রহমত লাভ করা যায়।
৭। কুলআন মাজিদ নাযিলের মাস রমজান। রোজার মাধ্যমে কুরআনের ফয়েজ লাভ করা যায়।
৮। বিশ্বজনীন, সাম্য, মৈত্রী, ভালোবাসা ও ভাতৃত্ব লাভের বন্ধন তৈরিতে রোজার বিকল্প নেই।
৯। দুঃখী মানুষের দুঃখ অনুভব করা যায়।
১০। রোজা আল্লাহর প্রতি কৃতজ্ঞতা জ্ঞাপনে অনুপ্রাণিত করে।
১১। রোজা চরিত্র হননকারীর কুপ্রবৃত্তি দমন ঘটায়।
১২। রোজা বিভিন্ন রোগ জীবাণু ধ্বংস করে ও শারীরিক সুস্থতা আনয়ন করে।
১৩। কুপ্রবৃত্তি দমনে সাহায্য করে।
১৪। অন্তর আখেরাতমুখী হয়।
১৫। সর্বোপরি আল্লাহর রেজা মন্দি হাসিলের অন্যতম মাধ্যম।
রমজান মাসে কতিপয় কাজ করতে হয় যা অন্য মাসে করার প্রয়োজন হয় না। যেমন- সাহরি ও ইফতার। সন্ধ্যা রাতের খাবারকে ইফতার আর শেষ রাতের খাবারকে সাহরি বলে। সাধারণত সুবহে সাদিকের পূর্বে রোজার নিয়তে পানাহার করাকে সাহরি বলা হয়। আর দিনের শেষে সুর্যাস্থের সাথে সাথে পানাহার করাকে ইফতার বলা যায়। সাহরি ও ইফতারের অনেক ফজিলত রয়েছে। বিশেষ করে সাহরি খাওয়াকে সুন্নত হিসেবে ঘোষণা করা হয়েছে। বুখারি শরীফের হাদিসে আছে, হযরত আনাস (রা.) থেকে বর্ণিত তিনি বলেন, রাসুল (স.) ইরশাদ করেন তোমরা সাহরি খাও। কেননা সাহরি খাওয়ার মধ্যে বরকত রয়েছে। অন্য হাদিসে আছে আমাদের রোজা ও আহলে কিতাবের রোজার মধ্যে পার্থক্য হলো সাহরি খাওয়া। তিরমিযির হাদিসে আছে, রাসুল (স.) বলেন, যখন তোমাদের কেউ ইফতার করে সে যেন খেজুর দ্বারা ইফতার করে। কেননা তাতে বরকত বা কল্যাণ রয়েছে। আর যদি খেজুর না পায় তবে যেন পানি দ্বারা ইফতার করে। কেননা তা পবিত্রকারী। খুরমা বা খেজুর দ্বারা ইফতার করা মুস্তাহাব। কারো মতে- এই হুকুম ঐসব লোকদের জন্য যাদের প্রধান খাদ্য হলো খুরমা। চিকিৎসা বিজ্ঞানীদের মতে, খালি পেটে যে কোনো মিষ্টি বস্তু পাকস্থলীর জন্য খুবই ফলপ্রসূ হয়। আর পানিকে পবিত্রকারী বলা হয়েছে। কেননা এর দ্বারা যেমনিভাবে বাহ্যিক পবিত্রতা অবলম্বন করা হয় তেমনিভাবে আত্মিক পবিত্রতাও হাসিল হয়। ইফতারের সময় উচিত হলো ইফতারের দুআ পড়া। হাদিসে আছে রাসুল (স.) ইফতারের সময় এ দুআ পড়তেন। (্আল্লাহুম্মা লাকা সুমতু ওয়া আলা রিযকিকা আফতারতু) অর্থাৎ ‘হে আল্লাহ আমি তোমার জন্য রোজা রেখেছি এবং তোমার দেওয়া রিজক দ্বারা ইফতার করেছি।’ অন্য হাদিসে আছে রাসুল (স.) বলতেন, (ইয়া ওয়াছিয়াল ফাদ্বলি ইগফির লি) ‘হে রিজিক বা কল্যাণের মালিক, আমাকে মাফ করে দাও।’ হযরত সালমান ফারসি (রা.) এর হাদিসে আছে রাসুল (স.) ইরশাদ করেন, রমজান মাসে যে ব্যক্তি রোজাদারকে ইফতার করাবে এটা তার পক্ষে গুনাহসমূহের জন্য ক্ষমাস্বরূপ হবে এবং তার নিজেকে জাহান্নামের আগুন হতে মুক্তির কারণ হবে। আর তাকে রোজাদারের সমান সওয়াব দেওয়া হবে। এতে তার সওয়াব হতে কিছু কমতি হবে না। রাবী বলেন, আমরা বললাম, হে আল্লাহর রাসুল (স.) আমাদের প্রত্যেকের এ সামর্থ্য নেই যে, আমরা রোজাদারের ইফতার করাবো। তখন রাসুল (স.) বললেন, আল্লাহ তাওয়ালা এ ছওয়াব ঐ ব্যক্তিকে দান করেন, যে কোন রোজাদারকে এক ঢোক দুধ দ্বারা বা একটি খেজুর দ্বারা অথবা এক ঢোক পানি দ্বারা ইফতার করায়। যে ব্যক্তি কোন রোজাদারকে পরিতৃপ্তি সহকারে ভোজন করায় আল্লাহ তায়ালা তাকে হাউজে কাওছার হতে পানি পান করাবেন। ফলে জান্নাতে প্রবেশ পর্যন্ত সে কখনো তৃষ্ণার্ত হবে না। শর্ত হলো হালাল মাল দ্বারা ইফতার করতে হবে ও অন্যকে হালাল মাল দ্বারা ইফতার করাতে হবে। হারাম মাল দিয়ে ইফতার করলে রোজা হবে না এবং ইফতার করালে সওয়াব হবে না।