
কক্সবাজার : উপক‚লে প্রায় অর্ধশত নৌদস্যুর অস্ত্রসহ আত্মসমর্পণের পর মনে করা হয়েছিল সাগরে মাছ শিকার এবার নিরাপদ হবে। কিন্তু না, আত্মসমর্পণের পর থেকে বিরতিহীনভাবেই চলছে ফিশিং ট্রলারে ডাকাতি। গত ২৪ ফেব্রুয়ারি ও গত ২৫ ফেব্রুয়ারি অন্তুত ৩০টি ট্রলারে ডাকাতি করেছে দস্যুরা। অপহরণ করা হয়েছে ১৪টি বোটসহ ৫৭ জন মাঝি-মাল্লাকে। এ অবস্থায় মাছ শিকার বন্ধ হওয়ার উপক্রম হয়েছে। উপক‚লে ফিরে আসছে ট্রলারগুলো।
কক্সবাজার ফিশিং বোট মালিক সমিতির সাংগঠনিক সম্পাদক মোস্তাক আহমদ জানান, ‘আমরা মনে করেছিলাম আত্মসমর্পণের পর সাগরে জেলেরা নিরাপদে মাছ শিকার করতে পারবে, কিন্তু সেই থেকে অনবরত ডাকাতি চলছে। আরো বেড়ে গেছে দস্যুদের উৎপাত। গত ২৫ ফেব্রুয়ারি এক দিনেই ১৪টি মাছধরা ট্রলারসহ ৫৭ মাঝি-মাল্লাকে অপহরণ করা হয়েছে। গত ২৪ ফেব্রুয়ারি বেলা ১১টা থেকে সন্ধ্যা সাড়ে ৭টা পর্যন্তু কক্সবাজারের পাটুয়ারটেক থেকে সেন্টমার্টিন পর্যন্তু উপক‚লবর্তী গভীর বঙ্গোপসাগরের প্রায় ১০০ কিলোমিটার এলাকাজুড়ে চলে দস্যুতা। আগের দিন গত ২৩ ফেব্রুয়ারিও একই অঞ্চলে প্রায় ৩০টি ট্রলার মাঝি-মাল্লাসহ অপহরণের শিকার হয়।
ট্রলার মালিক সমিতি সূত্র জানায়, গত ২৪ ফেব্রুয়ারি মুক্তিপণ আদায়ের জন্য আটক ট্রলারগুলোর মধ্যে ৮টি কক্সবাজারের, ৪টি চট্টগ্রামের ও দুটি বরগুনার পাথরঘাটা এলাকার। এর মধ্যে কক্সবাজারের আবু সোলতান নাগু কোম্পানির মালিকানাধীন এফবি ছেনুয়ারা ও এফবি ভাই ভাই নামে দু’টি ফিশিং বোটের চারজন করে আটজন, নুনিয়াছড়ার মোজাম্মেল কোম্পানির এফবি মায়ের দোয়ার ৩ জন, একই এলাকার সোহেলের বোটের চারজন, নতুন বাহারছড়ার ওসমান গনি টুলুর এফবি নিশান-১ ও ২ ফিশিং বোট দু’টির ১৮ জন মাঝি-মাল্লাকে অপহরণ করা হয়েছে। এ ছাড়া কক্সবাজার শহরের এন্ডারসন রোডের কাইয়ুম সওদাগরের এফবি রিফাত ও এফবি রফিকুল হাসান নামে দু’টি ফিশিং বোটের তিনজন করে ছয়জন মাঝি-মাল্লা অপহরণের শিকার হয়। একই সময়ে পাথরঘাটা এলাকার এফবি ইদ্রিস ও এফবি জলপুরী নামে দুটি ট্রলার ও তিনজনকে অপহরণ করা হয়।
গত ২৪ ফেব্রæয়ারি একই এলাকায় এফবি কিংশ ফিশার-১ ও ২ নামে ২১০ অশ্বশক্তিসম্পন্ন দু’টি ট্রলারসহ চট্টগ্রাম এলাকার ৪টি মাছধরা ট্রলারের মোট ১২ জন অপহƒত হয়েছেন। জেলা ফিশিং ট্রলার মালিক সমিতির সাংগঠনিক সম্পাদক মোস্তাক আহমদ আরো জানান, জেলেবেশি ডাকাতদল প্রথমে ট্রলারের কাছে আসে এবং পরে অস্ত্রের মুখে জিম্মি করে ট্রলারের নিয়ন্ত্রণ নেয়। ডাকাতেরা ট্রলারসহ মাঝি-মাল্লাদের জিম্মি করার পর কয়েকজন মাঝি-মাল্লাকে রেখে অন্যদের অন্য ট্রলারে তুলে ছেড়ে দেয়। এর মধ্যে বেশ কিছু জেলে রাতে কূলে ফিরে এসেছেন।
তিনি জানান, অপহরণের শিকার ট্রলারসহ মাঝি-মাল্লাদের মুক্তির বিনিময়ে ট্রলারপ্রতি ৪-৫ লাখ করে পণ দাবি করছে দস্যুরা। আগের দিন গত ২৩ ফেব্রæয়ারি একইভাবে অপহরণের শিকার ৩০টি ট্রলার ২-৩ লাখ হারে মুক্তিপণ দিয়ে মুক্ত করার পর বেশ কয়েকটি ট্রলার আরেক দল দস্যুর কবলে পড়েছে। তিনি আরো জানান, কক্সবাজার ও চট্টগ্রামের এমন কোনো মাছধরা ট্রলার নেই, যেটি এই সময়ে আক্রান্তু হয়নি।
অপহরণের শিকার ট্রলার মালিক ও জেলেরা জানান, বঙ্গোপসাগরের পাটুয়ারটেক থেকে সেন্টমার্টিন পর্যন্তু প্রায় দুই হাজার বর্গকিলোমিটার এলাকাজুড়ে এখন নৌদস্যুদের রাজত্ব চলছে। এই বিস্তীর্ণ এলাকা তিনটি দস্যু গ্রুপের নিয়ন্ত্রণে রয়েছে। একেকটি গ্রুপে ৭০ থেকে ১০০ জন পর্যন্ত সদস্য রয়েছে। এক গ্রুপের সাথে অপর গ্রুপের সম্পর্কও রয়েছে বলেও ধারণা ট্রলার মালিকদের।
জেলেরা আরো জানান, জলদস্যুদের তিনটি গ্রুপের সদস্যদের অধিকাংশই বয়সে তরুণ। এই তিনটি বাহিনীর সদস্যরা মূলত চট্টগ্রামের বাঁশখালী, কুতুবদিয়া, পেকুয়ার রাজাখালী, মহেশখালী শাপলাপুর, ধলঘাটা ও মাতারবাড়ি এলাকার। ডাকাতদের বেশির ভাগই সদস্যই এ পেশায় নবীন বলেও জানান জেলেরা।
ট্রলার মালিকরা সাগরে ডাকাতি রোধে কোস্টগার্ডের তৎপরতা বৃদ্ধি, সি-গার্ড গঠন, ড্রোন মোতায়েন এবং মেরিন র্যাব প্রতিষ্ঠার উওপর গুরুত্ব দেন। জরুরি ভিত্তিতে সাগরে র্যাবের তৎপরতা বৃদ্ধিরও দাবি তুলেন তারা।
এ বিষয়ে কক্সবাজারের নবগঠিত র্যাব-১৫ এর কোম্পানি কমান্ডার মেজর মেহেদী হাসান বলেন, সাগরে ডাকাতির ঘটনা শুনেছি। সোনাদিয়া থেকে নৌদস্যুদের আমরা নির্মূল করেছি। কিন্তু গভীর সাগরে গিয়ে দস্যু দমনের অনুমতি পাওয়া গেলে র্যাব তাই করবে।
উল্লেখ্য, ২০১৮ সালের ২০ অক্টোবর মহেশখালী ও কুতুবদিয়া অঞ্চলের ছয়টি বাহিনীর শীর্ষ ১২ দস্যুসহ ৪৩ সন্ত্রাসী অস্ত্র জমা দিয়ে আত্মসমর্পণ করেছিল।