মাওলানা মো. লুৎফুর রহমান চৌধুরী
মুসলিম বিশ্বের সবচেয়ে বড় উৎসব হলো ঈদুল ফিতর ও ঈদুল আজহা। পবিত্র রমজান মাসের পর আসে ঈদুল ফিতর আর যিলহজ মাসের ১০ তারিখ হয় ঈদুল আজহা। বুখারির সহীহ হাদিসে উল্লেখ আছে তোমরা চাঁদ দেখে রোজা রাখবে আবার চাঁদ দেখে রোজা ছাড়বে অর্থাৎ ঈদ করবে। তাই রমজান মাসের শেষে শাওয়াল মাসের প্রথম তারিখে ঈদুল ফিতর পালিত হয়। হযরত আনাস (রা.) হতে বর্ণিত, তিনি বলেন, রাসুল (সা.) হিজরত করে মদিনায় এসে দেখেন তারা বছরে দু দিন উৎসব পালন করে। তিনি তাদেরকে বললেন, ঐ দিনগুলো কিসের উৎসব? তারা বললেন, আমরা উক্ত দু দিনে আনন্দ করি। রাসুল (স.) তাদেরকে উক্ত দু দিন হতে উত্তম দু দিন দান করেন। একটি হলো ঈদুল ফিতর ও অন্যটি ঈদুল আজহা।
শাওয়াল মাসের প্রথম দিন হলো ঈদুল ফিতরের দিন। এদিনে অনেক মুস্তাহাব আমল রয়েছে। ঈদের নামাজে যাওয়ার পূর্বে কিছু খেতে হবে, গোসল করা, সুগন্ধি ব্যবহার করা, ভালো কাপড় পরিধান করা, তাকবীর বলে ঈদগাহে যাওয়া, ঈদের নামাজের পূর্বে কোনো নফল নামাজ আদায় না করা।
ঈদগাহে ঈদের নামাজ জামাতের সাথে আদায় করা। ঈদের নামাজ আদায় করা ওয়াজিব। ঈদের নামাজে প্রথম রাকাতে সানা পড়ার পর তিন তাকবীর বলা আর ২য় রাকাতে রুকুতে যাওয়ার পূর্বে তিন তাকবীর বলা অর্থাৎ মোট অতিরিক্ত ছয় তাকবীর বলা ওয়াজিব।
সালাম ফেরানোর পর ইমামগণ দাঁড়িয়ে খুতবা দিবেন। খুতবার মধ্যে বিভিন্ন বিষয়ে আলোচনা করবেন বিশেষ করে সাদকাতুল ফিতর ও তার হুকুম সম্পর্কে আলোচনা করবেন।
মিশকাতের হাদিসে আছে, রাসুল (সা.) বলেন, যখন মুসলমানদের ঈদের দিন আসে অর্থাৎ ঈদুল ফিতরের দিন উপস্থিত হয় তখন আল্লাহ তায়ালা তাদের ব্যাপারে ফেরেশতাদর নিকট গৌরব প্রকাশ করেন এবং বলেন, হে আমার ফেরেশতাগণ। যে শ্রমিক তার কার্য সম্পন্ন করেছে তার প্রতিদান কি হতে পারে? মহান আল্লাহ আরও বলেন, হে আমার ফেরেশতাগণ আমার বান্দা-বান্দিগণ যারা তাদের ওপর অর্পিত আমার ফরজ যথাযথরূপে পালন করেছে অতঃপর সে (নিজের ঘর হতে ঈদগাহের দিকে) উচ্চস্বরে দোয়া উচ্চারণ করতে করতে যাচ্চে- আমার ইজ্জত, মহিমা, বুযুর্গী উচ্চ মর্যাদা ও উচ্চাসনের কসম নিশ্চয় আমি তাদের দোয়া কবুল করব। অতঃপর আল্লাহ তায়ালা বলেন, যাও, তোমরা ফিরে যাও। আমি তোমাদের মাফ করে দিলাম এবং তোমাদের গুনাহগুলোকে নেকিতে পরিবর্তন করলাম। রাসুল (স.) বলেন, এখন তারা ক্ষমাপ্রাপ্ত হয়ে বাড়িতে প্রত্যাবর্তন করে। (বায়হাকি) ঈদুল ফিতরের পরবর্তী আমল সম্পর্কে রাসুল (স.) এর হাদিস প্রণিধানযোগ্য। রাসুল (সা.) বলেন, যে ব্যক্তি রমজানের রোজা আদায় করার পর শাওয়াল মাসে ছয়টি রোজা রাখে, সে যেন সারা বছরব্যাপী রোজা রাখল।
তাই যাদের রোজা রাখার সামর্থ আছে তারা যেন শাওয়াল মাসের যে কোনো ছয় দিন রোজা রাখে।
সাদকাদুল ফিতর: সাদাকাতুন শব্দটি বহুবচন; একবচন ‘সাদাকাতুন’ আল ফিতর শব্দটি বাবে নাসারা বা জারাবা এর মাসদার। অর্থ- ভঙ্গ করা ধ্বংস করা বা বিদীর্ণ করা। অতএব উভয়ের সম্মিলিত অর্থ হলো- দানের মাধ্যমে ভঙ্গ করা। তবে শাওয়াল মাসের প্রথম তারিখকে বলা হয় ইওয়ামুল ফিতর বা ঈদুল ফিতর, কেননা একাধারে রোজা রাখার পরে ঐ তারিখে রোজা ভঙ্গ করা হয়।
কাজেই ঈদুল ফিতরের দিন নিসাব পরিমাণ সম্পদের মালিক তার নিজের ও অপ্রাপ্ত বয়স্ক সন্তান-সন্ততির পক্ষ হতে শরীয়ত কর্তৃক নির্ধারিত যে সদকা আদায় করতে হয় তাকে সাদকাতুল ফিতর বলা হয়। ইমাম অকী ইবনুল জারাহ বলেন, রমজান মাসের যাকাতুল ফিতর নামাজের সিজদায়ে সাহুর সমতুল্য। দলিল হিসেবে হাদিস পেশ করেন- হযরত ইবনে আব্বাস (রা.) হতে বর্ণিত। তিনি বলেন, রাসুল (সা.) সাদকায়ে ফিতর রোজাকে অনর্থক কথা ও অশালীন কথা হতে পবিত্র করার জন্য এবং নিঃস্বদের মুখে খাদ্য দেয়ার জন্য নির্ধারিত করেছেন। (আবু দাউদ) অর্থাৎ- সাদকায়ে ফিতর সিজদায়ে সাহুর মতো, সিজদা সাহু যেমন নামাজের একটি বিচ্যুতি পরিপূর্ণতার সহায়ক হয় তেমনি সাদকাতুল ফিতর ও রমজানের রোজার পরিপূর্ণতা আনয়ন করে। এছাড়া ফেতরা দ্বারা সমাজের অসহায় শ্রেণির সহায়তা করে ইসলামের সাম্যের নজির স্থাপন করে।
সদকায়ে ফিতরের হুকুম : ইমাম আবু হানিফা ও সাহেবাইন (র.) এর মতে, সদকায়ে ফিতর আদায় করা ওয়াজিব। মিশকাতে হযরত আব্দুুল্লাহ ইবনে ওমর (রা.) হতে বর্ণিত। তিনি বলেন, রাসুল (স.) মুসলমানদের প্রত্যেক স্বাধীন, নারী, পুরুষ, ছোট-বড় সকলের উপরে সদকায়ে ফিতর হিসেবে এক সা খেজুর অথবা এক সা যব ফরজ (ওয়াজিব) করেছেন এবং নামাজে বের হওয়ার পূর্বেই এটা আদায় করতে নির্দেশ দিয়েছেন।
অন্য হাদিসে আছে, হযরত আমর ইবনে শুয়াইব (রা.) তার পিতা হতে, তিনি তার দাদা হতে বর্ণনা করেন যে, রাসুল (স.) একবার মক্কায় চালিসমূহে ঘোষক পাঠিয়ে ঘোষণা করালেন যে, তোমরা জেনে রাখ। সাদকায়ে ফিতর প্রত্যেক মুসলমান পুরুষ-স্ত্রী, স্বাধীন-ক্রীতদাস, ছোট-বড় সকলের ওপর ফরজ। দু’মুছ গম বা তাছাড়া অন্য কিছু অথবা এক সা খাদ্য (তিরমিযি) হাদিসে এক সা= সাড়ে তিন সের প্রায়। এ হাদিস দ্বারা বোঝা যায় সদকায়ে ফিতর ওয়াজিব। কারণ উক্ত হাদিসে সরাসরি ওয়াজিব শব্দ উল্লেখ আছে।