সাহিত্য একাডেমির নিয়মিত মাসিক আসর অনুষ্ঠিত

বেনজির শিকদার : গত ৩০ ডিসেম্বর অনুষ্ঠিত হলো ‘সাহিত্য একাডেমি, নিউইয়র্ক’র নিয়মিত মাসিক সাহিত্য আসর। শুরুতেই একাডেমির পরিচালক মোশাররফ হোসেন সবাইকে বিজয় দিবসের শুভেচ্ছা জানিয়ে, যাঁদের আত্মত্যাগের বিনিময়ে আমরা এ বিজয় পেয়েছি- তাদের প্রতি গভীর শ্রদ্ধা ও ভালোবাসা প্রকাশ করেন। যুদ্ধ বিষয়টি যখন সাহিত্যের সাথে সংশ্লিষ্ট হয়, তখন তা যেন একটি অন্যরকম মাত্রা পায়। বলতে গেলে, বিশ্বের সেরা সবগুলো মহাকাব্য এবং ধ্রুপদী ভাণ্ডার ভরে আছে যুদ্ধ আর বীরত্বগাথায়।
মুক্তিযুদ্ধ বাঙালির ইতিহাসে এক গুরুত্বপূর্ণ অধ্যায়ের নাম। বিজয়ের মাস হওয়ায়, সবার বিষাদময়-নান্দনিক কথা কবিতা ও গল্পে উঠে আসছিল টুকরো টুকরো মৃত্যু, হানাদার বাহিনীর হৃদয় বিদারক মর্মন্তুদ, নারকীয় অত্যাচারে প্রিয়জন হারানোর ব্যথা, অর্থনৈতিক ক্ষতি, নারীর অবমাননা এবং পাকবাহিনীর ঘেরাটোপে বন্দি প্রতিটি মানুষ একাত্তরের রক্তাক্ত অশ্রুময় দিনগুলি কী করে পার করেছেন- তার অনবদ্য বর্ণনা।
প্রবীণ সাংবাদিক সৈয়দ মোহাম্মদ উল্লাহ বলেন, দেশবিভাগের যন্ত্রণা এবং সাম্প্রদায়িকতার বিষবাষ্পের কারণে লক্ষ লক্ষ মানুষ দেশান্তরী হতে বাধ্য হয়েছে। ১৯৪৭ সালে প্রায় এক কোটি মানুষ মারা গিয়েছে। মানুষ জন্মভূমি থেকে দেশান্তরী হতে বাধ্য হয়, কিন্তু জন্মভূমির জন্য তার যে ভালোবাসা, তা তার সবসময়ই থাকে।
তিনি উল্লেখ করেন, সাহিত্য একাডেমির মতো এমন অসাধারণ কর্মকাণ্ড পৃথিবীর বিভিন্ন দেশেও হচ্ছে। কিন্তু এর মাঝ থেকে যখন তাদেরকে বলা হয় ‘প্রবাসী সাহিত্যিক’- তখন অনেকেই অখুশি হন। ভাবেন, তাদের খাটো করে দেখা হচ্ছে। আসলে বিষয়টি এভাবে দেখা উচিত নয়। আমাদের ডায়াসপোরা সাহিত্য খুব শক্তিশালী। ভালো লেখা হলে পৃথিবীর যেকোনো প্রান্তে, যে কোনো ভাষাতেই থাক না কেন, মূল্যায়ন হবেই।
তিনি উল্লেখ করেন, ১৮৫৬ সালে জন্ম হয় তরু দত্তের। অল্পবয়সেই তিনি খ্রিস্টধর্ম গ্রহণ করেন এবং পুরো পরিবারসহ প্রথমে ফ্রান্স এবং পরে ক্যামব্রিজ ইউনিভার্সিটিতে কিছু কোর্স করে ফরাসি সাহিত্যের অনেক অনুবাদের পাশাপাশি ইংরেজিতে বেশ কিছু লেখা লেখেন। সাহিত্যে তার মূল্যায়ন অপরিসীম।
বঙ্গবন্ধুসহ সব শহিদের স্মৃতির প্রতি, তাঁদের আত্মার প্রতি গভীর শ্রদ্ধা জানিয়ে, তিনি বিশেষভাবে শ্রদ্ধা জানান, বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধকালীন সরকারের প্রধানমন্ত্রী তাজ উদ্দিন আহমেদের প্রতি।
লেখক ফেরদৌস সাজেদীন বলেন, ৭০-এর নির্বাচন এবং বঙ্গবন্ধুর ৭ই মার্চের ভাষণের পূর্ব পর্যন্ত সময়ের নানা আন্দোলন-সংগ্রামের একজন সহযোদ্ধা ছিলেন তিনি। এদের মধ্যে কবি আবুল হাসান এবং কবি নির্মলেন্দু গুণও ছিলেন।
তিনি আপ্লুত হয়ে বলেন, একদিন বর্ধমান হাউজের সামনে ঘাসের ওপর বসেছিলাম। পাশে রাখা ছিল, বন্ধুদের নিয়ে তৈরি সদ্য প্রকাশিত কিছু স্মরণিকা। ওই সময় সামনে দিয়ে হেঁটে যাচ্ছিলেন মুনির চৌধুরী। একটি স্মরণিকা হাতে নিয়ে তার কাছে গিয়ে বললাম, স্যার এটা? উত্তরে মুনির চৌধুরী বললেন, ‘এটা আমি আগেই কিনে নিয়েছি’। এক সময় যুদ্ধ শেষ হলো। আমরা মুনির চৌধুরীকে আর দেখতে পেলাম না। কী করে তিনি হারিয়ে গেলেন? আমাদের জাতীয় সত্ত্বারা এভাবেই একের পর এক নিরুদ্দেশ-লাপাত্তা হয়েছেন।
তিনি আরো উল্লেখ করেন, বাংলাদেশ স্বাধীন হওয়ার পরে পত্রিকার সব হেডলাইন একসাথে করেছিলাম। একটি হেডলাইনে লেখা ছিল- ‘সাবধানে হাঁটবেন সাহেব, দেখবেন মাথার খুলির ওপর যেন পা না পরে।’ এ কথাগুলো বলার কারণ হলো, ডিসেম্বর মাস বিজয়ের মাস, ডিসেম্বর মাসেই মুনির চৌধুরীকে হারিয়েছি। কিন্তু তিনি রেখে গিয়েছিলেন তার টাইপ রাইটারের বাংলা কী-বোর্ড। পরবর্তীতে সেই কী-বোর্ডটি ব্যবহার করেছিলেন সৈয়দ শামসুল হক। অতঃপর সেই কী-বোর্ড দিয়েই তিনি লিখেছিলেন মুক্তিযুদ্ধের নাটক। এরপর এসেছে কম্পিউটার, বরণ করা হয়েছে নতুনকে।
সেই ’৫২ থেকে ড. মুনির চৌধুরী, শামসুর রাহমান, হাসান হাফিজুর রহমানসহ আরো যাঁরা ছিলেন, তারা সবসময়ই চেষ্টা করেছেন আমাদের বাংলার কী হবে? আমরা ভারতের বাংলা থেকে আমাদের সুষমাকে কি করে পেতে পারি? তারা সমস্ত অন্তর দিয়ে ধারণ করতে চেয়েছিলেন বাংলার স্বরূপটি। যে স্বরূপের পথ ধরে, যে আত্মত্যাগের পথ ধরে আমরা ধীরে ধীরে আজকের এই বাংলাকে পেয়েছি। আর এই বাংলাকে সঠিকভাবে পরিচর্যা করছে সাহিত্য একাডেমি।
দীর্ঘ বারো বছর ধরে মাসের শেষ শুক্রবার আমি যতবার এখানটায় আসি, ততবারই মুগ্ধ হই! প্রাণখুলে উপভোগ করি! এখানে সবাই একেকটি নক্ষত্র! এজন্য যে, ভাষা, শিল্প, সাহিত্য- এসবকে ভালোবেসে তিন-চার ঘণ্টা নিশ্চুপ বসে থেকে একে অপরকে সহ্য করছে, ভালো-মন্দ শুনছে, বের হয়ে আসছে কতশত সুন্দর শব্দ ও বাক্য।
তিনি আশাবাদ ব্যক্ত করেন, আগামীতে এগুলোকে ধরে রাখার ব্যাবস্থা করা হবে। এখানে পঠিত অনেক কবিতাই হৃদয় স্পর্শ করে। আর এই হৃদয়কে স্পর্শ করার জন্য প্রতিমাসে একত্রিত করার কাজটি করে যাচ্ছে সাহিত্য একাডেমি। এর চাইতে বড় আর কী আছে? স্বাধীনতার সময় বিজয় আমাদের যে আনন্দ দিয়েছিল, আমার মতে এখানকার এই আনন্দটিও একটি সমীকরণ রচিত করে।
ঠিকানার প্রধান সম্পাদক মুহাম্মদ ফজলুর রহমান বলেন, আমাদের জীবনের কঠিন বাস্তবতা ও সবচেয়ে বড় সত্য হচ্ছে- মুক্তিযুদ্ধ। স্বাধীনতা বিতর্কের বিষয় নয়।
তিনি অনুরোধ করে বলেন, আমরা কেউ যেন একে নিয়ে বিতর্কে না জড়াই। স্বাধীনতা নিরেট সূর্যের মতো সত্য। এই সত্যকে যারা অস্বীকার করবে, তারা পাপিষ্ঠ।
কবি হোসাইন কবীর বলেন, দীর্ঘদিন অসুস্থতায় কাটিয়ে সুস্থ হয়ে ওঠা আমার জন্য একটি বিজয়। বিজয় মানেই শুধু উল্লাস নয়, মুক্তিযুদ্ধের যে বিজয় অর্জন, তার পাশাপাশি তাকে ঘিরে বেদনার বিষয়টিও রয়েছে। আমরা যারা বাংলাদেশ তথা লাল-সবুজের পতাকার দেশ থেকে এই ভূখণ্ডে এসেছি, আমরা সেই লাল-সবুজ পতাকাকে বুকে ধারণ করে চলবো। পরে তিনি স্বরচিত কবিতা পাঠ করেন। কবি তমিজ উদ্দীন লোদী তৎকালীন পাকিস্তানের শাসন ব্যবস্থায় ওৎপ্রোতভাবে জড়িয়ে যাওয়া ফ্রাঙ্কোর কথা, স্টালিন-এর শাসন ব্যবস্থা, তার নিপীড়ন, নৃশংসতার বিরুদ্ধে দাঁড়ানো বরিস পাস্তেরনাক-এর নানা বিষয় উল্লেখ করেন।
তিনি বলেন, তদ্রুপ আজকের আসরে উপস্থিত মুক্তিযোদ্ধা ডা. মহসিন আলীর মতো মানুষকে দেখলে, তাদের অভিজ্ঞতার কথা শুনলে আমরা উজ্জীবিত হই, আনন্দিত হই এবং আমাদের ইতিহাসকে আমরা জলজ্যান্তভাবে দেখতে পাই।
তিনি বলেন, স্বাধীনতা কি শুধু একটি ভূখণ্ডের স্বাধীনতা? সার্বিকভাবে স্বাধীনতাকে প্রতিষ্ঠিত করতে হলে এইসব বিষয়ের দিকেও আমাদের নজর দিতে হবে। কুসংস্কারকে দূর করতে হবে, সেইসাথে দেখতে হবে আমাদের অবকাঠামো। প্রান্তিক মানুষের অধিকারকে যদি প্রতিষ্ঠিত করতে না পারি, তাহলে আমাদের সার্বিক স্বাধীনতা আমরা পাবো বলে মনে হয় না। কেবল আমাদের দেশের জন্যই নয়, সারা বিশ্বের জন্যই এটি প্রযোজ্য। কবি কাজী আতিক বলেন, ক্লাস সিক্স থেকে জিন্দাবাদ-মুর্দাবাদ বলেছি। মুক্তিযুদ্ধের সময় আমার বয়স ছিল চৌদ্দ বছর। আমি ১৯৪৮ এবং ’৬৯-এর গণঅভ্যূত্থানে অংশ নিয়েছি। সঠিক জায়গায় উপনীত হতে মুক্তিযুদ্ধের চেয়েও মুক্তিযুদ্ধের পটভূমি নিয়ে আমাদের বেশি চর্চা করা প্রয়োজন। তিনিও স্বরচিত কবিতা থেকে পাঠ করেন।
লেখক এ বি এম সালেহ উদ্দিন বলেন, আমরা বিজয়ের একান্নটি বছর পার করলাম। স্বাধীন সার্বভৌম বাংলাদেশ পেয়েছি, লাল-সবুজ পতাকা পেয়েছি। সেই পতাকার জোরে আমরা পৃথিবীর বিভিন্ন দেশে ছড়িয়ে আছি। সেই পতাকা এতটাই পবিত্র, যার স্পর্শ পেলে কোন মানুষ হেরে যেতে পারে না। ’৭১ প্রসঙ্গে লেখক আদনান সৈয়দ বলেন, বিজয়ের মাস এলেই আমরা অনুষ্ঠান করি, কবিতা পড়ি। নিঃসন্দেহে এটি আনন্দের বিষয়। কিন্তু বিজয়কে ঘিরে আমাদের ওরাল হিস্ট্রি সেভাবে নেই বললেই চলে। যারা বিজয়কে নিজের চোখে দেখেছেন, তাদের কাছ থেকে সেই গল্প কিংবা ইতিহাসকে জেনে আমরা সেগুলো নিয়ে অনায়াসেই কাজ করতে পারি, নইলে একদিন তা কালের গহ্বরে হারিয়ে যাবে।
তিনি উল্লেখ করেন, আমেরিকা, জাপান, কোরিয়া, ইউরোপসহ গোটা পৃথিবীজুড়ে নানাদেশ তাদের ওরাল হিস্ট্রিটিকে গুরুত্বের সাথে সংগ্রহের জন্য কাজ করছে।
মুক্তিযোদ্ধা-লেখক ডা. মহসিন আলী বলেন, মহান মুক্তিযুদ্ধের সময় আমি রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের অর্থনীতি বিভাগে দ্বিতীয় বর্ষের ছাত্র ছিলাম। রাজনৈতিক কারণেই মুক্তিযুদ্ধে গিয়েছি এবং বঙ্গবন্ধুর নির্দেশেই মুক্তিযুদ্ধ করেছি। তিনি উল্লেখ করেন, দু’বার আমি মুক্তিযুদ্ধে অংশগ্রহণ করেছি। একটি হচ্ছে ১৯৭১ সাল এবং অন্যটি ১৯৭৫ সালে বঙ্গবন্ধু হত্যার পর। তিনি মুক্তিযুদ্ধ এবং বাংলাদেশ বিষয়ক তার বাংলা এবং ইংরেজিতে লেখা বেশ কয়েকটি বই সম্পর্কে সংক্ষিপ্ত পরিচিতি তুলে ধরেন।
এছাড়াও বক্তব্য রাখেন, কবিতা আবৃত্তি ও স্বরচিত কবিতা পাঠ করেন মোরশেদ আলম, অধ্যাপিকা হুসনে আরা, আকবর হায়দার কিরণ, নাসির শিকদার, শিরিন খান, মনিজা রহমান, পলি শাহীনা, জেবুন্নেসা জোৎস্না, আবুল বাশার, ফারহানা হোসেন, আনোয়ার সেলিম, সুমন শামসুদ্দিন, সবিতা দাস, সুলতানা ফেরদৌসী, বেনজির শিকদার, পারভীন সুলতানা প্রমুখ।
এছাড়াও আসরে উপস্থিত ছিলেন, রাহাত কাজী শিউলী, আবেদীন কাদের, আহমেদ মাজহার, শামস আল মমীন, উর্মি রহমান, শওকত রিপন, উইলি নন্দী, স্বপ্ন কুমার, সরাবত আলী প্রমুখ।
উপস্থিত সবাইকে ধন্যবাদ এবং আগামী আসরের আমন্ত্রণ জানিয়ে অনুষ্ঠানের সমাপ্তি টানেন মোশাররফ হোসেন।