সিলেটের মণিপুরি শাড়ি

সেলিনা উদ্দিন :

মণিপুরি জাতি ভারত ও বাংলাদেশের একটি ক্ষুদ্র ও বৈশিষ্ট্যপূর্ণ জনগোষ্ঠীর নাম। এদের আদি নিবাস ভারতের মণিপুর রাজ্যে। আঠারো শতকের শেষ ভাগ থেকে উনিশ শতকের প্রথম ভাগ পর্যন্ত সংঘটিত বিভিন্ন সামাজিক, রাজনৈতিক, এবং যুদ্ধের কারণে মণিপুর রাজ্যের অধিবাসীরা স্থানান্তরিত হয়ে ভারতের বিভিন্ন রাজ্য এবং বাংলাদেশে অভিবাসন গড়ে তোলে। বাংলাদেশের সিলেট জেলায় তাদের অধিক বসবাস। মণিপুরিদের নিজস্ব ভাষা, বর্ণমালা, সাহিত্য এবং সমৃদ্ধ সংস্কৃতি রয়েছে। তাঁতশিল্পে রয়েছে তাদের বিরাট খ্যাতি। তাদেরই হাতে বোনা এখনকার জনপ্রিয় এই মণিপুরি শাড়ি।

মণিপুরি শাড়ি বলে আদতে কিছু ছিল না। শাড়ি মণিপুরি নারীদের পোশাকও নয়। তাদের আসল পোশাক হলো লাহিং বা ফানেক, যা কোমরে প্যাঁচ দিয়ে পরতে হয়। সঙ্গে ওপরে যে ব্লাউজ পরে, তাকে তারা ফুরিৎ বলে। এর সঙ্গে পরিহিত ওড়নার নাম তাদের ভাষায় ফিতুপ বাইনাফি। ইনাফির উন্নত সংস্করণ যখন তৈরি হয়েছিল, তখন নাম দেওয়া হয়েছিল মৈরাংফি। কারণ দৃষ্টিনন্দন কারুকার্যখচিত এই ওড়না তৈরি হয়েছিল মৈরাং রাজ্যের রাজকুমারীর জন্য। আর তাই তার নাম দেওয়া হয়েছিল মৈরাংফি বা মৈরাংয়ের পোশাক।

নব্বইয়ের দশকের শুরুতে এই মৈরাংফি থেকে অনুপ্রাণিত হয়ে মণিপুরি তাঁতিরা ব্যবসায়িক দিক বিবেচনা করে শাড়ি তৈরি করতে শুরু করেন। আজ দেশের গণ্ডি ছাড়িয়ে বিদেশেও প্রচুর জনপ্রিয়তা অর্জন করতে সক্ষম হয়েছে তাদের এই উৎপাদন। তার একমাত্র কারণ হলো মণিপুরি শাড়ির বৈচিত্র্যময় রঙের সংমিশ্রণ। শাড়িতে রঙের বাহার যে কারও চোখ কাড়ে।

মণিপুরি শাড়ির মূল বৈশিষ্ট্য হলো জমিনের রং থেকে পাড়ের রং গাঢ় থাকে। তাই দূর থেকে নজর কাড়ে। এর দুই পাড়ে মন্দিরের প্রতিকৃতি থাকে। প্রতিটি শাড়ির আঁচল, পাড় এবং জমিন তৈরি হয় উজ্জ্বল রঙের সুতা দিয়ে। সম্পূর্ণ হাতে বুনন হয় বলে শাড়িগুলোর এপিঠ-ওপিঠের কোনো পার্থক্য থাকে না এবং শাড়িগুলোর কাজের নকশা একটার সঙ্গে অন্যটার মিলও থাকে না।
মণিপুরি শাড়ির যত্ন নেওয়ারও রয়েছে কিছু নিয়ম, যা মেনে চললে একেকটা শাড়ি টেকে বহুদিন।

আধুনিক যুগের ফ্যাশনসচেতন নারীরা উজ্জ্বল রঙের পোশাক পরিধানে বেশি আগ্রহী। অনেকের ধারণা, রঙিন কাপড় পরিধান মনকে প্রফুল্ল রাখতে সাহায্য করে। নারীদের জীবন এখন আর আগের মতো নেই। নানা ধরনের মানসিক চাপ নিয়ে তাদের চলতে হচ্ছে। আগেকার দিনের বেশির ভাগ নারীই ঘরে অবস্থান করতেন। বাইরে কাজ করার তাগিদ তাদের ছিল না। কিন্তু এখন সময় পাল্টেছে, নারীরা বিভিন্ন পেশায় যুক্ত হচ্ছেন। সঙ্গে সংসারের দায়িত্বও পালন করে যাচ্ছেন। ফলে নারীদের মানসিক চাপ এখন পুরুষদের চাইতে বেশি। বিভিন্ন সামাজিক, সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানে নারীরা যোগ দিচ্ছেন। তার একটিমাত্র কারণ, নারীরা দিন শেষে কিছুটা মানসিক চাপমুক্ত হওয়ার চেষ্টা করছেন। শাড়ি যেহেতু বাঙালি নারীদের পোশাক, সে কারণে শাড়ি পরে সাজগোজকে নারীরা প্রাধান্য দিচ্ছেন বেশি। জামদানি বা মসলিন শাড়ি থেকে মণিপুরি শাড়ি অনেক সাশ্রয়ী। এটি এখনো সাধারণ মানুষের ক্রয়ক্ষমতার মধ্যে আছে। একেকটা শাড়ির দাম ১২০০ টাকা থেকে ছয়-সাত হাজার টাকা মূল্যে কিনতে পারা যায়। তবে দাম নির্ভর করে সুতা ও নকশার ওপর। শাড়ির চাহিদা বৃদ্ধির পাশাপাশি পর্যাপ্ত সুতার আমদানি না থাকায় যথেষ্ট পরিমাণ জোগান দিতে পারছেন না তাঁতিরা। এ কারণে মণিপুরি শাড়ির দাম দিন দিন বাড়ছে।
মণিপুরিদের শাড়ি বুননের প্রক্রিয়া অনেকটা বিখ্যাত এবং ইউনেসকো-স্বীকৃত বাংলাদেশি জামদানি শাড়ির মতোই। কোন প্রকার মেশিনের ব্যবহার হয় না এই শিল্পে। কাপড় তৈরির সুতাও চরকায় হাত দিয়ে তৈরি করা হয়। মণিপুরিদের উৎপাদিত তাঁত পণ্যের মধ্যে আরও রয়েছে ফানেক, শাল, ওড়না, থ্রি-পিস, গামছা, ফতুয়া, পাঞ্জাবি, বিছানার চাদর ইত্যাদি। এখন তারা অত্যন্ত সুন্দর নকশিকাঁথা এবং বকুল কাঁথাও তৈরি করে থাকে।

সিলেটের বিভিন্ন জায়গায় রয়েছে মণিপুরিদের হাতে বোনা কাপড়ের দোকান। প্রায় সময় পরিব্রাজকদের ভিড় লেগে থাকে সেই সব দোকানে। সিলেটের প্রবাসীরাও ঝুঁকতে শুরু করেছেন মণিপুরি শাড়ি ও হস্তশিল্পে। এর ফলে বিশ্বের বিভিন্ন প্রান্তে পৌঁছে গেছে এই তাঁতশিল্প।
সিলেটের বিভিন্ন স্থানে মণিপুরিদের বসবাস এবং ব্যবসাপ্রতিষ্ঠান থাকলেও সবচেয়ে বেশি মণিপুরি বসবাস করে মৌলভীবাজারে। সেখানকার মণিপুরিদের বাড়িতে গেলে দেখা যায়, তাঁতিদের বুনন-ব্যস্ততা, তাদের বুননশৈলী এবং জীবনধারা। দেশীয় বুননশিল্পের অন্যতম একটি মাধ্যম এই মণিপুরি তাঁতশিল্প, যার পুরোটাই চলছে মণিপুরিদের লোকজ্ঞানে। তাদের নেই কোনো ক্যাটালগ, নেই কোনো আলাদা ডিজাইন। তারা নিজেদের থেকে তৈরি করে এই চোখজুড়ানো শাড়ি। একেকটা শাড়ি তৈরি করতে দুজন নারীর সময় লেগে যায় ৭ থেকে ১৪ দিন পর্যন্ত।
বাংলাদেশের তাঁতশিল্পের ইতিহাস অতি প্রাচীন। এই শিল্পের সঙ্গে জড়িত আছে আমাদের সংস্কৃতি। দেশের সর্ববৃহৎ কুটিরশিল্প ও লোকশিল্প এটি। তাই তাঁতশিল্প এই দেশের ধারক ও বাহক। সিলেটের মণিপুরি তাঁতশিল্প এই সর্ববৃহৎ শিল্পের অন্যতম অংশীদার। বিখ্যাত পর্যটক ইবনে বতুতা ও হিউয়েন সাংয়ের ভ্রমণকাহিনিতেও মণিপুরি তাঁতশিল্পের উল্লেখ রয়েছে। সেদিক থেকে বলা যায়, এটি আমাদের হাজার বছরের ঐতিহ্য, কৃষ্টি ও সংস্কৃতি।

তাঁতশিল্পের পাশাপাশি মণিপুরি সম্প্রদায়ের নৃত্যেরও রয়েছে আলাদা খ্যাতি। এই নৃত্যের মাধ্যমে এই সম্প্রদায়ের ঐতিহ্য প্রতিফলিত হয়। কবিগুরু রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের ভ্রমণ ইতিহাসে উল্লেখ আছে, ১৯১৯ সালে তিনি সিলেট ভ্রমণে এলে শহরের অদূরে মাছিমপুর পল্লিতে মণিপুরি সম্প্রদায়ের গোস্টলীলা ও রাসলীলায় নৃত্যের সজ্জা, সাবলীল ছন্দ ও সৌন্দর্য দেখে তিনি এতই বিমোহিত হয়েছিলেন যে সেদিনের নৃত্যশিল্পীদের শান্তিনিকেতনে যোগদানের আমন্ত্রণ জানিয়েছিলেন। ওনার শ্যামা ও চণ্ডালিকায় আংশিক এবং চিত্রাঙ্গদা নৃত্যনাট্যে সম্পূর্ণভাবে মণিপুরি নৃত্যের সুর ও তাল অনুসরণ করা হয়েছে। তা ছাড়া রবীন্দ্রনাথের অনেক গানেও মণিপুরি সুর ব্যবহৃত হয়েছে।

লেখক : প্রাবন্ধিক।