সিলেটে সমরেশ মজুমদার…

প্রণবকান্তি দেব : ‘সিলেটে এসে আমি রোমাঞ্চিত হয়েছি। কারণ, উত্তরবঙ্গের যে চা-বাগানে আমার দীর্ঘ সময় কেটেছে, ঠিক সেই জায়গার মতোই সিলেট। সেই চা-বাগান, সেই মাটি। আমি যখন বিমানবন্দর থেকে আসছিলাম, তখন মনে হচ্ছিল, সিলেটের সঙ্গে ভারতের উত্তরবঙ্গের সেই চা-বাগানের ও এর আশপাশের এলাকার অনেক মিল রয়েছে।’- এ অভিব্যক্তি সদ্য প্রয়াত কিংবদন্তী সাহিত্যিক এবং ‘ঠিকানা’র এক সময়ের নিয়মিত লেখক সমরেশ মজুমদারের। গ্রন্থবিপণি প্রতিষ্ঠান ‘বাতিঘর’-এর আমন্ত্রণে সিলেটে প্রথম এবং শেষবারের মতো এসেছিলেন কালজয়ী এ লেখক। ২০১৯ সালে মাত্র দু’দিনের এ ভ্রমণ সিলেটের সাহিত্য-সংস্কৃতি অঙ্গনে সৃষ্টি করেছিল অন্যরকম দ্যোতনা। প্রিয় লেখককে পেয়ে সিলেট যেন হয়ে উঠেছিল সেদিন স্পন্দনমুখর। একটু দেখা পেতে, একটা অটোগ্রাফ নিতে হুড়মুড় খেয়ে পড়েছিল তাঁর পাঠককূল।
দিনটি ছিল শুক্রবার। ১৩ সেপ্টেম্বর। বাতিঘরে আয়োজন করা হয়েছিল ‘বই প্রকাশের গল্প’ শিরোনামের একটি অনুষ্ঠানের।

অনুষ্ঠানে সেদিন বাতিঘর থেকে লেখকের সদ্য প্রকাশিত উপন্যাস ‘অপরিচিত জীবনযাপন’ এবং বাদল সৈয়দের ‘জন্মজয়’ বই দুটির মোড়ক উন্মোচন করা হয়। অনুষ্ঠানে স্বাগত বক্তব্য দিয়েছিলেন বাতিঘরের স্বত্বাধিকারী দীপঙ্কর দাশ। অনুষ্ঠান সঞ্চালন করেছিলেন সিলেটের লোক গবেষক এবং সাংবাদিক সুমনকুমার দাশ।
পুরো অনুষ্ঠানটি ছিল দুটি পর্বে বিভক্ত। প্রথম পর্বে সমরেশ মজুমদার তাঁর শৈশবের বিভিন্ন ঘটনা এবং জনপ্রিয় উপন্যাস উত্তরাধিকার, কালবেলা, কালপুরুষ, সাতকাহন, গর্ভধারিণীসহ তাঁর লেখালেখির বিষয়ে কথা বলেন। দ্বিতীয় পর্বে তিনি পাঠকদের লিখিত প্রশ্নের জবাব দেন।
বাতিঘরের মিলনায়তন পূর্ণ হয়ে সেদিন সমরেশপ্রেমীদের দীর্ঘ লাইন ছুঁয়েছিল রাস্তা পর্যন্ত। সেদিন পাঠকদের নানা প্রশ্নেরও উত্তর দেন সমরেশ মজুমদার। পাঠকের প্রশ্নের উত্তরে সমরেশ মজুমদার প্রেম, ভালোবাসা, বিপ্লব, সাম্যবাদ নিয়েও কথা বলেন সে আয়োজনে। বলেন, প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সঙ্গে তাঁর প্রথম দেখা হওয়ার ঘটনাটুকুও। ‘শেখ হাসিনার সঙ্গে যখন আমার পরিচয়, তখন তিনি প্রধানমন্ত্রী ছিলেন না। একদিন উনার বাসায় দাওয়াত দেন।’ অনুষ্ঠানে সমরেশ মজুমদার স্মৃতিচারণা করেন প্রয়াত কথাসাহিত্যিক হুমায়ূন আহমেদের। এ ছাড়া পাঠকদের প্রশ্নের জবাবে বাংলা সাহিত্যের আরও দুই দিকপাল সুনীল গঙ্গোপাধ্যায় ও শীর্ষেন্দু মুখোপাধ্যায়কে নিয়েও কথা বলেন।
পাঠকের সম্মুখে নিজেকে সেদিন মেলে ধরেছিলেন জনপ্রিয় এ কথাসাহিত্যিক। জীবনের গহীনে লুকানো নানা গল্প ভাগ করে নিয়েছিলেন সিলেটের পাঠকদের সাথে। সেদিন তিনি জানিয়েছিলেন, মঞ্চনাটকের প্রতি তার খুব টান ছিল। প্রথম গল্পও লেখেন যে নাট্যদলটির সঙ্গে তিনি জড়িত ছিলেন সেই দলের একটি চিত্রনাট্য রচনার জন্য। যার নাম ছিল ‘অন্তর আত্মা’। কিন্তু সেটি নিয়ে মঞ্চদলটি নাটক করায় সেটি ছাপানোর জন্য দেশপত্রিকায় পাঠান তিনি। ছাপেনি তারাও।
তিনি বলেন, পরে এক বন্ধুকে সঙ্গে নিয়ে দেশপত্রিকার তৎকালীন সম্পাদক বিমল করের সঙ্গে যোগাযোগ হলে তিনি গল্পটি ছাপান। গল্প ছাপানোর ফলে পত্রিকা থেকে তাকে ১৫ টাকা দেয়া হয়। সেই টাকা তিনি বন্ধুদের নিয়ে কফি খেয়ে উড়িয়ে দেন।
এরপর এই খাওয়ার লোভে বন্ধুরা তাকে আরও লেখার জন্য তাগিদ দেন। সেই কফি খাওয়া ও খাওয়ানোর লোভ থেকেই সাহিত্যিক হিসেবে পর্দাপণ করেন সমরেশ মজুমদার। আড্ডায় উঠে আসে ‘সাতকাহনে’র দীপাবলির কথাও। তাছাড়া দীর্ঘ এই আলাপচারিতায় বারবারই উঠে আসে তার উপন্যাস-ত্রয়ী ‘উত্তরাধিকার’, ‘কালবেলা’ ও ‘কালপুরুষ’ প্রসঙ্গ। অনুষ্ঠান শেষে উৎসুক পাঠকদের অটোগ্রাফ দেন তিনি। সিলেটের পাঠক-ভক্তরা তখন হুড়মুড় খেয়ে পড়ে প্রিয় লেখকের সাথে ছবি তুলতে। অনেকেই এগিয়ে এসে তাঁর সৃষ্ট নানা চরিত্র নিয়ে কথা বলেন, ভালোলাগা উপন্যাসের কথা বলেন। ঠোঁটে মৃদু হাসি মেখে সেদিন সবার অনুভুতির সাথে নিজেও মিশে যান। গল্প, কথায় বাতিঘর মিলনায়তন হয়ে উঠে সমরেশময়।
এদিকে, সমরেশ মজুমদারের সিলেট আগমনকে কেন্দ্র করে ২০১৯ সালের ১২ এবং ১৩ সেপ্টেম্বর দুদিন সিলেটে ছিল উৎসবের আমেজ। সিলেটে এসে তিনি অবস্থান করছিলেন শহরতলীর শুকতারা রিসোর্টে। সেখানেও ঢল নেমেছিল পাঠক-ভক্তের। একদিন বেড়াতে গিয়েছিলেন শ্রীমঙ্গল। উপভোগ করেছিলেন সেখানকার অপরূপ প্রাকৃতিক সৌন্দর্য।
গত ৮ সেপ্টেম্বর কীর্তিমান এ সাহিত্যিকের মৃত্যুর খবরে সিলেটেও নামে শোকের ছায়া। সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে সিলেটের অনেকেই সেই ভ্রমণকালীন সমরেশ মজুমদারের নানা স্মৃতি আওড়াতে থাকেন।