মোস্তফা কামাল : ব্যাপক না হোক, সীমান্ত হত্যা কিছুটা হলেও কমবে বলে আশাবাদ জেগেছিল প্রধানমন্ত্রীর ভারত সফরে। কিন্তু আশা চুরমার হতে সময়ই লাগেনি। সীমান্ত হত্যা শূন্যে নামিয়ে আনতে দু’দেশের প্রধানমন্ত্রীর যৌথ বিবৃতির মাঝেই, এমন কি আমাদের প্রধানমন্ত্রীকে ভারতে রেখেই, দিনাজপুরের দাইনুর সীমান্তে বিএসএফের গুলিতে মিনহাজকে হত্যা। এর কোনো প্রতিবাদও না করা কী বার্তা দেয়? সমঝোতার নমুনা? সফরের হাদিয়া? সৌজন্যের স্মারক পুরস্কার? নাকি এ রকম হত্যা হয়ে আসছে, হতেই থাকবে?
দুই প্রধানমন্ত্রীÑ শেখ হাসিনা ও নরেন্দ্র মোদির শীর্ষ বৈঠক নিয়ে গত ৭ সেপ্টেম্বর প্রচারিত ৩৩ অনুচ্ছেদের যৌথ বিবৃতিতে রাজনীতি, নিরাপত্তা, বাণিজ্য, প্রতিরক্ষার সঙ্গে সীমান্ত ব্যবস্থাপনার কথাও জানানো হয়। সীমান্ত হত্যা উল্লেখযোগ্য হারে কমেছে বলে উপলব্ধিতে তারা সন্তোষও প্রকাশ করেন। দু’পক্ষ সীমান্ত হত্যা শূন্যে নামিয়ে আনার বিষয়ে সম্মত হয়েছেন বলেও জানানো হয়। বাংলাদেশ হত্যার শিকার, ফরিয়াদি। আর হত্যাকারী ভারত। বাংলাদেশের এখানে সম্মত হওয়ার কী আছে?
বাংলাদেশ বরং মানবিকতা চর্চা করে আসছে। প্রায়ই বাংলাদেশের জলসীমায় অনুপ্রবেশ করে ভারতীয় ট্রলারসহ জেলেরা। ধরাও পড়ে মাঝেমধ্যে। বাংলাদেশ তাদের ফেরৎ দেয়, মাছ চোর বলে হত্যা করে? বিশ্বের কোনো দেশে জুডিশিয়াল সিস্টেমে কোনো অপরাধ প্রমাণ না হওয়া পর্যন্ত তো কাউকে অপরাধী বলা যায় কিনা, অথবা অপরাধী হলেও তাকে বিচারবহির্ভূতভাবে কি হত্যা করা যায়? বাংলাদেশের পক্ষ থেকে আজতক জোরালোভাবে প্রশ্নটি তোলা হচ্ছে না। বরং হতাহতদের গরু চোর মেনে নেয়ার একটি সায় বরাবরই। তা দেখা গেছে প্রধানমন্ত্রীর সফরের মাস দু’য়েক আগে ঢাকায় দু’দেশের সীমান্তবাহিনীর সম্মেলনেও। ফাঁকা বসেই সীমান্তে বিএসএফের গুলিতে নিহত সবাইকে গড়ে হরিবল ‘ক্রিমিনাল’ বলেছেন বিএসএফের ডিজি পঙ্কজ কুমার সিং। বাংলাদেশ বা বিজিবির তরফে আপত্তি করা হয়নি। একদিকে হিংস্রতা, আরেকদিকে মাথা নুইয়ে মেনে নেয়া কি বিনয়, শিষ্টাচার বা সৌজন্যতা?
সীমানা তো সীমানাই। হোক সমুদ্রসীমা বা স্থলসীমা। ভারত বাংলাদেশের নামকাওয়াস্তের প্রতিবেশী নয়। ঘনিষ্ঠতম পড়শি। মুক্তিযুদ্ধের সময় বাংলাদেশের জনসাধারণকে আশ্রয়, প্রশিক্ষণ, যুদ্ধ সহায়তাকারী। স্বাভাবিকভাবেই প্রতিবেশী বন্ধু রাষ্ট্রটির প্রতি বাংলাদেশের মানুষ কৃতজ্ঞ। কিন্তু, তাই বলে ক’দিন পর পরই সীমান্তে হত্যাকাণ্ডও স্বাভাবিক? যুদ্ধাবস্থা ছাড়া বিশ্বের কোনো স্বাধীন দু’দেশের সীমান্তে এমন হত্যার নজির আছে?
ভারতের সঙ্গে তো চীনেরও সীমানা রয়েছে। সেখানে মাঝেমধ্যেই যুদ্ধাবস্থা হয়। এ যুদ্ধাবস্থার মাঝেও গুলি ছোঁড়ার অনুমতি নেই। ভারতের জাতশত্রু পাকিস্তানের সঙ্গে তাদের সীমানা রয়েছে। সীমানা বিরোধও রয়েছে। সেখানে যুদ্ধাবস্থা লেগেই থাকে। সেখানেও বেসামরিক মানুষকে হত্যার ঘটনা নেই। ভারত লাগোয়া নেপাল-ভুটান সীমান্তেও হত্যাকাণ্ডের খবর শোনা যায় না। একমাত্র বাংলাদেশ-ভারত সীমান্তেই এভাবে বেসামরিক মানুষকে অকাতরে মৃত্যুর ভাগ্য মেনে নিতে হয়। বাংলাদেশকে কেন এভাবে পেয়ে বসেছে ভারত? বাংলার মাটি বড় নরম বলে? এর প্রতিবাদে প্রতিশোধ বা যুদ্ধ নয়, শক্ত প্রতিবাদ-প্রতিরোধ করতেও মানা?
লেখক : সাংবাদিক-কলামিস্ট; বার্তা সম্পাদক, বাংলাভিশন, ঢাকা।