সুফিয়া কামাল খালা: আমাদের আন্দোলনদিনের সাহসী-সতীর্থ

সালেম সুলেরী

কবি সুফিয়া কামালকে খালা ডাকতাম। কিন্তু আদর নিয়েছি শহুরে মায়ের। তিনি ছিলেন আমাদের তারুণ্যের সাহসী আশ্রয়। জেনারেল এরশাদের সামরিক শাসনকালে আমরা তরুণ-তুর্কি। ১৯৮৭-তে আয়োজন করেছি জাতীয় কবিতা উৎসব। অগণতান্ত্রিক পরিবেশে ‘শৃঙ্খল মুক্তির কবিতা’। আমাদের দেহ-মন তখন বিপ্লব-বাতায়নে উদ্ধত-চঞ্চল। প্রয়োজন ছিলো সাহসী বাতাসের। সে সময়েই পেয়েছি এই ‘জননী সাহসিকাকে। শুরু থেকেই অনুপ্রেরণা দিয়েছেন। প্রথম জাতীয় কবিতা উৎসবের সাহসী উদ্বোধকও হয়েছেন। এর আগে সাহস যুগিয়েছিলেন ‘বাপী শাহরিয়ার’ ইস্যুতে। অনুজ এই লেখক গাড়ি-দুর্ঘটনায় পঙ্গু হলো। গাড়িটি চালাচ্ছিলেন তৎকালীন স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীর ‘অর্ধচালক’ পুত্র। ঘটনাটি রাজধানী ঢাকার শান্তিনগরের। বাকি ইতিহাস আমাদের আন্দোলনের। সতত সেবা ও কল্যাণের। আমাদের মাথার ওপর ছিলো প্রশাসনযন্ত্রের করাতকল, রক্তচক্ষু। কিন্তু আমরা কিছুতেই দমিনি। ঐ সময়ে আমাদের সাহসের বাতিঘর ছিলেন সুফিয়া খালা। বলতেন, তোমরা নজরুল থেকে কি শিখেছো। কবিদেরও বিদ্রোহী বা সাহসী হতে হয়। শুধু শব্দে-বাক্যে সাহসী হলে চলবে না। সময় সময় নিজেদেরও পালন করতে হয় ভূমিকা।
আমরা সেবার দর্শনীর বিনিময়ে ছড়া পাঠের অনুষ্ঠান করি। তাও সরকারি শিশু একাডেমি মিলনায়তনে। ১৯৮৬ সালে, সকাল-বিকেল আয়োজন। সর্বকবি সুফিয়া কামালসহ অংশ নিলেন শতাধিক ছড়ালেখক। ‘বাপী শাহরিয়ার কল্যাণ তহবিলে’ অর্থ জমলো। তবে ততোধিক জন্মেছিলো সম্মিলিত সাহসের নতুন এক হিমালয়। সামরিক সরকারের স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীর রক্তচক্ষু আমাদের করতলে। আমাদের তারুণ্য-উদ্দামতা উচ্ছলতায় টইটুম্বুর। কারণ, আমাদের বেশ কটি ছাতাও নিভৃতে ছায়া দিচ্ছিলো। এমনই এক ছাতাবৃক্ষ ছিলেন সুফিয়া খালা। যেন মাতৃমায়ামুগ্ধ সতত সতীর্থ ভূমিকায়।
সুফিয়া খালার অসাধারণ কিছু ভূমিকা দেখেছি অতীতে। সেটি আরো আগের কথা। ১৯৭৮-৮৯ সালে, অবহেলিত উত্তরবঙ্গে। রংপুরে বেগম রোকেয়ার পায়রাবন্দ ছিলো চরম অবহেলিত। আজকের বেগম রোকেয়া বিশ্ববিদ্যালয় তখন ছিলো না। ‘অবরোধবাসিনী’-সহ বেগম রোকেয়ার বইগুলোর পুনঃপ্রকাশ ঘটেনি। তখন উদ্যোগী হয়ে উঠলো ‘বাংলাদেশ লেখিকা পরিষদ’। কমিটির কয়েকজন ঢাকা থেকে রংপুর গেলেন। এই অভিযাত্রার প্রধান সেতুবন্ধ হলেন আমার বড়ো ফুপু। তিনি লেখিকা লুৎফুন্নেসা আব্বাস। সুরসম্রাট আব্বাসউদ্দীনের সুপ্রিয় সহ-ধর্মিণী। জন্ম বৃহত্তর রংপুরের ডোমারে, থাকতেন ঢাকায়। তাঁর ব্যবস্থাপনায় দূরের রংপুরে গেলেন সুফিয়া খালা। সঙ্গে আয়শা জাফরসহ উদ্যোগী নেতৃবর্গ। স্থানীয় জনগণ ও প্রশাসনকে জাগালেন। এরপর আর বেগম রোকেয়ার সমাদরÑ পশ্চাদপদ হয়নি।
১৯৮৩-৮৪-তে প্রকাশিত হয় বাংলাদেশের ছড়ার প্রথম এনসাইক্লোপেডিয়া। ‘বাংলাদেশের ছড়া ও ছড়ালেখক’ শিরোনামে। সম্পাদক-প্রকাশক ছিলাম আমি (সালেম সুলেরী)। প্রত্যক্ষ-পরোক্ষ অনেক সহযোগিতা দিয়েছিলেন সুফিয়া খালা। ছন্দে-হৃদয়ানন্দে লিখেছিলেনও নতুন লেখা।
সুফিয়া খালার গল্প একদিনে শেষ হওয়ার নয়। ইচ্ছে হয়, পুরো একটি বই লিখি। প্রয়াত হওয়ার আগে আগে আর সাক্ষাৎ করতে পারিনি। ‘মিডিয়ায় ত্রুটিজনিত’ একটি লজ্জা পেয়েছিলাম। কষ্টও পেয়েছি অনেক। ‘মিডিয়ামুখর দিনগুলো’র পান্ডুলিপিতে সে কথা জমানো আছে। এখনও অপ্রকাশিত রয়েছে সেই অব্যক্ত যন্ত্রণার ধ্বনি।
২০ জুন ছিল প্রিয়-শ্রদ্ধেয় সুফিয়া খালার জন্মদিন। ফুলের তোড়া নিয়ে মুখোমুখি হওয়ার আর সুযোগ নেই। দেহাবসান ঘটেছে ১৯৯৯-এর ২০ নভেম্বর। সারল্যে ভরা মানুষটির জন্যে তাই স্মৃতিকাতর পদ্য। সঙ্গে বিদেহী আত্মার জন্যে প্রশান্তির পরমায়ু-প্রার্থনা।