
অসীম সাহা : পূর্ণিমা মানে জ্যোছনায় ভিজে যাওয়া সোহাগী রাত। স্বপনরা বাসা বাঁধে বুকের মাঝে। কত রকমের হাউস! কোনোটা লাল, কোনোটা বেগুনি, আবার কোনোটা গোলাপি। অনেক বাহারি হাউস। কেউ দেয় মিলাদ, কেউ দেয় পূজা।
কদিন আগে কেউ উদ্যাপন করল বড়দিন। কেউ বলে, বুদ্ধং শরণং গচ্ছামি। সবাই মেতে থাকে যে যার আনন্দে।
সুবর্ণচরেও সেদিন আনন্দ কম ছিল না। আকাশ ছিল গাঢ় নীল, পুঞ্জমেঘের ভেলায় আকাশ হেলেদুলে বেড়াচ্ছিল এ-পাড়া থেকে ও-পাড়ায়। ছোটখাটো মেলাও বসেছিল স্কুলের মাঠে। সবাই সেজেছিল যে যার মতো করে। সাবিহা পরেছিল সবুজ জমিনে হলুদ পাড়ের শাড়ি। নাবিলা লাল ফ্রক, আব্বাস কমলা রঙের জামা। মোতালেব বিড়িতে সুখটান দিয়ে বলে, সাহিবা তাড়াতাড়ি কর। দেরি হলে লম্বা লাইনের পেছনে পড়তে হবে। ফিরতে বেলা হবে।
তুমি বাড়াও, আই আসি। সাবিহা চোখের কাজল টেনে বাইরে আসে। কী সুন্দর লাগতাছে! সেই প্রথম দিনের মতো। আব্বাস একটু দেখে নেয়। কী দেখতাছ? মাইয়া মানুষ কোনো দিন দেহ নাই? আব্বাস কথা বাড়ায় না। একটু লজ্জাও পায়। আব্বাস সাবিহাকে কোনো দিন এভাবে দেখেনি।
রোদ উঠেছে। চকচকে রোদ। বাবলাগাছের ছায়া দিয়ে সাবিহা আব্বাস হেঁটে যায় স্কুল মাঠের দিকে।
সাবিহার বয়স তিরিশের কোঠায়। মেঘনার দুরন্ত জলোচ্ছ¡াসে সাবিহার জীবন অনেকটা বিপর্যস্ত। প্রথম স্বামী মোবারক সাগর থেকে আর ফেরেনি। মালিহা তখন পেটে। মালিহা বাবার মুখ দেখেনি। সম্পত্তি-বেসাতি যা ছিল তা নিয়াছে অর্ধেক মেঘনা আর অর্ধেক মোবারক মোড়ল। পরের বাড়িতে ঝিয়ের কাজ আর রাস্তার মাটি কেটে ফসলের মাঠে কৃষাণ বেচে সাবিহার দিন গেছে। শরীরটার ওপর খারাপ চোখের আছর কম পড়েনি। সাবিহা বেঁচে গেছে দৌড়ে পালিয়ে, আব্বাস সাবিহার জীবনে এক নতুন আশার আলো। মোতালেব ওকে সব দিয়েছে। মোতালেবের শরীরে তাগৎ আছে। অ¤øান সাবিহাকে ভালোবাসে সে। রাস্তার বাঁক ঘুরলেই সোলেমানের চায়ের দোকান। চাকরি হারিয়ে সোলেমান তখন চায়ের দোকান দিয়েছে। বেচাকেনার চেয়ে বাজে আড্ডা বেশি হয়। স্কুল-কলেজের মেয়েরা এ পথ সহজে মাড়াতে চায় না। গা গুলানো কিছু উক্তি পথচারীদের সমস্ত দিন নাকি নষ্ট করে দেবে।
বিশেষ করে উঠতি বয়সের মেয়েরাই এই অত্যাচারের শিকার। বয়স্করাও বাদ যায় না। আহসান মাতব্বরের ছেলে এ দেশের নেতা, সবাই ভয় পায় তাকে। তার নাকি খুঁটির জোর আর কানেকশন খুব শক্ত!
সাবিহার সে ডর নেই। আজ মোতালেব সাথে আছে। আর সাবিহা তো বিবাহিত। ভয় কিসের। সাবিহা চার সন্তানের মা। মোড় নিতেই তিন-চারজন সামনে দাঁড়ায়।
আসসালামু আলাইকুম।
ওয়ালাইকুম!
ভাবি যান কই সাইজে-গুজে।
ভোট দিবার যাই। মমিননগর স্কুলে।
খুব ভালো কথা। আপনারাই শক্তি। আপনাদের দোয়াই দরকার। দোয়া আর দয়া এক হইলে আর লাগে না। সোজা ফরমগেট।
তা ভোট দেবেন কারে?
আমার যাকে খুশি তারে, সাবিহা জবাব দেয়।
তা তো বুঝলাম। অনেক সময় কর্তার ইচ্ছায় মেন্যু হয়।
উৎসব বলে কথা। সব সময় কি নিজের খুশির দাম দিলে চলে?
আমারে তো চেনেন, আমার একটা অনুরোধ আছে।
বলেন, কী অনুরোধ? আমাদের বড় ভাই দাঁড়িয়েছে ইলেকশনে, কলস মার্কা পানি ভইরা দিব। খালি রাখব না। ভোটটা দিয়েন। আমি তো ভোট দেব ‘হাতি মার্কায়। হাতি বড় ভালো প্রাণী।
ভালো সার্কাস দেখায়, কারও ক্ষতি করে না।
আমি যাই, বেলা হচ্ছে। সাবিহা সামনে এগোয়। নাসির সামনে গিয়েই আবার শুনিয়ে দেয় মার্কাটা কলস, মনে রাখিয়েন।
লম্বা লাইন। পাশে পুলিশ-বিজিবি, অনেক দূরে সেনাবাহিনীর একটি ট্রাক দাঁড়ানো। মোতালেব দাঁড়িয়েছে ছেলেদের লাইনে। সাবিহা মেয়েদের। মাঝেমধ্যে চোখাচুখি হচ্ছে। আজ অনেক দিন পর সাবিহা-মোতালেব কেঁদেছে অপার বিস্ময়ে মানুষটা তো এমন ছিল না। প্রায় আধা ঘণ্টা পরে মোতালেব আর সাবিহা ভোট দিয়ে বাইরে আসে। সাবিহা আজ ভাজা খাবে। মোতালেবের কাছ থেকে এক টাকা নিয়ে গোপালের দোকান থেকে পাপড় কিনে খেতে খেতে বাড়ি ফেরে।
মনে মনে প্রার্থনা করে, আল্লাহ হাতি মার্কা যেন জিতে যায়। মাথার ওপর রোদ দক্ষিণে হেলেছে। উঠানে এসেই মোতালেব সাবিহাকে বলে, খিদে লাগছে। খাবার দাও। যাও হাতমুখ ধুয়ে আসো। আমি খাবার দিচ্ছি। সাবিহা বারান্দায় খাবার সাজায়। নাবিলা, আব্বাসকে ডাক দিয়ে মোতালেব সাজিতায় পরম তৃপ্তি নিয়ে কচু সেদ্ধ আর পুঁটি মাছ দিয়ে দুপুরের খাওয়া সেরে নেয়। গ্রামের মসজিদ থেকে মাগরিবের নামাজের আজান শোনা যাচ্ছে। দোচালা ঘরের এক কোণে মোতালেব বসেছে নামাজে। উঠানে রাতের খাবার করে সাবিহা ঘরের মেঝেতে বসেছে সবাইকে রাতের খাবার খাওয়ানোর জন্য। গ্রামে রাত নামে তাড়াতাড়ি। চারপাশ অন্ধকার করেই রাত জেঁকে বসে। আজও তাই সারা দিনের উত্তেজনা আর ক্লান্তি ভর করে মোতালেব আর সাবিহার চোখে। ছেলেমেয়ে দুটো ঘুমিয়েছে একটু আগে। মোতালেব ডাকে, সাবিহা ও সাবিহা সাবু। ঘুমালে নাকি? সব দিন তো বলো আজকে ঘুম আসছে। আজকে উৎসবের দিন, আজকেও ঘুমাবা। সাবিহা নাক ডাকতে শুরু করেছে। দূর চর থেকে ভেসে আসা শিয়ালের হুক্কাহুয়া মধ্যরাতের ঘণ্টা বাজিয়ে দেয়।
দরজা খুলুন! শুনছেন, দরজা খুলুন। আমরা পুলিশের লোক। চার-পাঁচবার দরজায় কড়া নাড়ার শব্দে মোতালেবের ঘুম ভেঙে যায়। পুলিশের কথা শুনেই মোতালেব দরজা খুলে দেয়। দরজা খুলতেই চার-পাঁচজন দানব লাঠি-রামদা নিয়ে ঘরে ঢুকেই মোতালেব, নাবিলা আর আব্বাসকে বেঁধে ফেলে। পাশের ঘরেই ছিল সাবিহা।
খানকি মাগি কই? হাতির শুঁড় ঢুকাই দিমু। খানকির বাচ্চা। আয় তোরে আইজ হাতি দেখাই আনুম। সাবিহা চিৎকার করতে পারে না। চুলের মুঠি ধরে টেনেহিঁচড়ে সাবিহাকে নিয়ে যায় নির্জন পুকুরপাড়ে।
ছিঁড়ে যায় অশ্রু অহংকার। রক্তাক্ত হয় সুবর্ণচরের মাটি। বড় ভাইয়ের স্নেহধন্যরা সওয়াবের কাজ করে সাবিহাকে ফেলে রেখে যায়।
সুবেহ সাদেক! জলিল মাওলানা যাচ্ছে মসজিদে আজান দিতে। পথের পাশে পুকুর। পুকুরের পাশেই গোঙাচ্ছে এক আদমসুরত বেপর্দা রক্তাক্ত। জিন নাকি? জিনরাই এ সময় ঘোরাফেরা করে। মাওলানা দোয়া পড়ে। আর্ত অস্ফুট কণ্ঠে ভেসে আসে একটি কণ্ঠ : আই জিন না! মোতালেবের বউ, সাবিহা, আরে বাঁচান।
জলিল মাওলানা কাকে দেখছে, এ কি মানুষ নাকি অন্য কিছু! সমস্ত শরীর রক্তাক্ত রক্তধারার স্লাত নিমগ্ন শতছিন্ন কাপড়! প্রায় মৃত্যুর দ্বারপ্রান্তে। মাওলানা কাছে যায়। নিজেকে বিশ্বাস করতে পারে না। এই মাওলানা ছিল একাত্তরের কমলাপুর কলোনিতে। এমন দৃশ্য সে জানতেও পারে না।
রাত শেষে যে অমাবস্যার আঁধার কাটে না। এবার সত্যিই পুলিশ আসে। ধরে ফেলে পাঁচজনের দলকে। যে ধর্ষক, সে নাকি রাজনীতির লোক। রাজনীতি ভালো, তবে রাজনীতির আগাছা ভালো নয়। এই আগাছার জন্য আক্রান্ত হয়েছে পূর্ণিমা শীল, রামুর বৌদ্ধবিহার, অভয়নগরের মালোপাড়া, ফরিদপুরের মানুষগুলো, ঠাকুরগাঁওয়ের হিন্দুপাড়া, ধর্ষিত হয়েছে পিরোজপুরের মা-মেয়ে একসাথে।
সুবর্ণচরে সূর্য ওঠে। চোখ-জ্বালানো সূর্যের তাপ। হৃদয়ের উত্তাপ ছড়িয়ে পড়ে সুবর্ণচর থেকে চৌরঙ্গী। সাবিহার মুখ লাঞ্ছিতার, পাপিষ্ঠার হয়ে ছড়িয়ে পড়ে ভোরের সেøাগানে : ধর্ষকের বিচার চাই। বিচার চাই, শাস্তি চাই।
নিউ ইয়র্ক।