হুসনে আরা :
আধুনিক মানুষ সার্বভৌম। আধুনিক মানুষ সার্বজনীন। সময়ের ধারাবাহিকতায় আমরা এই আধুনিক যুগের মানুষ নামের নারী। মানুষ হওয়ার অর্থ ক্রমশ বিকশিত হওয়া, আবিষ্কার করা, সৃষ্টি করা। জীবনকে নিরন্তর বিকশিত করার মধ্যেই নিরুপিত হয় জীবনের মূল্য। শুদ্ধ মানব সংস্কৃতির পরিচর্যা ও লালন মানুষের বড় অবলম্বন ও পরিচয়।
নারীও মানুষ। এ কথা একদা বোধের সীমানার অতিদূরে ছিল। তাইতো বিধানকর্তারা, পুরোহিতরা, দার্শনিকেরা, লেখকেরা এবং বিজ্ঞানীরা প্রতিষ্ঠিত করার চেষ্টা করেছেন যে, নারীর অধীন অবস্থান স্থির হয়েছে স্বর্গে এবং মর্ত্য।ে পুরুষ নামক মানুষের উদ্ভাবিত ধর্মে প্রতিফলিত হয় পুরুষ আধিপত্যের এ বাসনা। পুরুষ নারীকে করে তুলেছে কর্মী হিসেবে। নারীকে কখনো কর্তা হয়ে উঠতে দেয়া হয়নি। তাই নারীর মূল্য অমূর্ত ধারণার প্রতিরূপ।
আর পুরুষই হচ্ছেন মানুষ। পৌরুষ হচ্ছে মানুষকে মাপার মানদণ্ড! বর্তমান সময়ের পরম্পরায় এক মিশ্র অনুভূতিতে মনে ভেসে ওঠে মাতামহী-পিতামহীর স্মৃতিকথা। গত শতাব্দীতে ঐ দুই বিদুষী নারীর পক্ষে বিশ্ব ইতিহাস, দেশীয় রাজনীতি কিংবা সমাজ বিশ্লেষণ করা ও বোঝার মত ক্ষমতা তাদের ছিল না। তাদের ছিল না কোন প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষা। মানুষের অধিকার, নারী-পুরুষের সম-অধিকারের প্রশ্ন তাদের নাড়া দিতো কিনা- তাও মনে প্রশ্ন জাগে। অক্ষরজ্ঞানহীন আমার শরীরে প্রবাহিত রক্তধারার সেই পূর্ব বংশধরদের মনকে প্রশ্নবিদ্ধ করেছে কিনা- সংসারের কর্তা কে? সমাজ-সংসারে নারীর মূল্য কতটুকু? নারীর ক্ষমতায়ন নিয়ে তারা ভাবতেন কিনা? যদিও তখন বিশ্বে নারীরা জাগতে শুরু করেছে। ভাবতে শুরু করেছে- নারীর দারিদ্র্য দূরীকরণ, নারীর অর্থনৈতিক ক্ষমতায়ন, নারীর কর্মসংস্থান, নারীর প্রতি নির্যাতন বন্ধ। সেই সাথে মেয়ে সন্তানের প্রতি বৈষম্য বিলোপ এবং সমাজে মানুষ হিসেবে নারীর গ্রহণযোগ্যতা নিয়ে।
আমাদের অগ্রবর্তী গত শতাব্দীতে জন্মলাভ করা মানুষ নামের সেই মানবদরদী নারীরা না জানলেও নারী উন্নয়নের অপরিহার্যতা অনুভব করে দৃঢ় পদক্ষেপ গ্রহণ করেছেন রাজা রামমোহন রায়, ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর, পশ্চিমের মেরিওলস্টোন ক্র্যাফট, সিমোন দা রেভোয়ার, প্রীতিলতা, ইলা মিত্র, বেগম রোকেয়া, সুফিয়া কামাল, জাহানারা ইমামসহ অনেক ব্যক্তিত্বের অবদান এবং সোচ্চার কণ্ঠ। ফরাসি বিপ্লবের ক্ষেত্র তৈরি করেছিলেন দুই বিশিষ্ট দার্শনিকÑ ভলতেয়ার এবং রুশো। রুশো বলতেন- ‘জনগণই ক্ষমতার মালিক’। এই জনগণের মধ্যে কেবল পুরুষ নন, নারীও যথারীতি আছেন।
অনেক বন্ধুর পথ পেরিয়ে নারী আজ সোচ্চার ও উপযুক্ত হয়ে সামনে দাঁড়িয়েছে। নারীকে বিক্ষিপ্ত করতে নারীর ইতিহাস নিয়ে নারীমুক্তি বিরোধীরা দাঁড় করান দুটি পরস্পর বিরোধী যুক্তিÑ নারী কখনো মহৎ কিছু সৃষ্টি করে নাই, আর নারীর পরিস্থিতি মহৎ নারী ব্যক্তিত্বের বিকাশে কখনো বাধা দেয় নাই। এই মন্তব্য দুটিতে রয়েছে প্রতারণা। বিশ্ব ইতিহাস পর্যালোচনা করলে দৃশ্যমান যেÑ ভোটাধিকার হচ্ছে মানুষের মৌলিক অধিকার। কিন্তু সেই মৌলিক অধিকার আদায় করতে নারীদের দীর্ঘদিন আন্দোলন করতে হয়েছে। জীবন পর্যন্ত বিসর্জন দিতে হয়েছে। নারীমুক্তি ও নারী স্বাধীনতা প্রতিষ্ঠায় পুরুষ নারীর মর্যাদা ও অধিকার প্রতিষ্ঠার জগৎকে সংকীর্ণ করে রেখেছে। তাই নারীকে অগ্নি ও অশ্রুর সমন্বয়ক হতে হয়েছে। কারণ নারীর শত্রু শুধু পুরুষই নয়, নারীর শত্রু পুরুষমন্ত্রে দীক্ষিত একদল নারীও। আসলে মানুষের অধিকার প্রতিষ্ঠিত হলে তবেই নারীর অধিকার প্রতিষ্ঠা পাবে।
এক্ষেত্রে প্রকৃত শিক্ষা, যোগ্য মানুষ হওয়া, নেতৃত্ব গ্রহণ এবং অর্থনৈতিক স্বাবলম্বিতার ধারাকে অব্যাহত রাখতে সাহসী, সুদক্ষ ও মূলধারাকে শক্ত হাতে নিয়ন্ত্রণ করতে হবে। এটা পারলে নারী তার গন্তব্যে পৌঁছতে সক্ষম হবে। ধর্মের নামে নারীকে শোষণÑ এ যেনো এক আবশ্যিক নাটক। এ নাটকের দিন শেষ হয়ে যাবে। নারী যে মানুষ, তারা সন্তান জন্ম দেয়া থেকে সমাজ ও দেশে সুশাসন প্রতিষ্ঠিত করে বিশ্বকে মানুষের জন্যে এক সুসম নিরাপদ বাসভূমি প্রতিষ্ঠিত করতে নিজেদের তৈরি করেছে। বিশ্বে এখন অনেক রাষ্ট্রে সফল নারী প্রধান। নারী সন্তান জন্মদান, কৃষিকাজ, বিচারকাজ থেকে রাজনীতি, বিজ্ঞান, সমাজনীতিতেও দক্ষতার সাথে বিচরণ করছে। মহাকাশ বিজয়েও আজ তারা পিছিয়ে নেই। সমাজ প্রগতির সকল ধারায় তারা দক্ষতার সাথে ভূমিকা রেখে চলেছে। নারীকে অবজ্ঞা করে সমাজ প্রগতি অসম্পূর্ণ।
আজ এ কথা প্রমাণিত, নারীকে বাদ দিয়ে সমাজ উন্নয়ন চিন্তা বাতুলতা মাত্র। যে দেশ ও জাতি নারীকে সমমর্যাদায় সব সুযোগ উন্মুক্ত করে পাশে নিয়ে চলবে, সেই দেশ এবং জাতির অগ্রগতি এবং সমৃদ্ধি কারও পক্ষেই ঠেকিয়ে রাখা সম্ভব নয়। আজকের সময়ের নারী মুক্তিই মানব মুক্তি। আন্তর্জাতিক নারী দিবসে সব নারী এবং নারী কল্যাণকামী শক্তিকে অভিবাদন।
-নিউইয়র্ক।