রেভারেন্ড ফাদার স্ট্যানলী গমেজ :
১৭ মার্চ তারিখটিকে ঘিরে বহু রকমের ধর্মীয়, রাজনৈতিক, সামাজিক, সাংস্কৃতিক, পারিবারিক ও ব্যক্তিগত উৎসব হয়, যেখানেই আইরিশদের বসবাস। কারণ ১৭ মার্চ সেইন্ট প্যাট্রিক’স ডে। আমরা বাঙালিরা মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র, কানাডা, অস্ট্রেলিয়া কিংবা ইউরোপের যেখানেই বসবাস করি না কেন, আমাদের সবার সঙ্গেই আইরিশ বংশোদ্ভূত কারও না কারও পরিচয় আছে। হয়তো তাদের কেউ আমাদের সহকর্মী, প্রতিবেশী, বন্ধু কিংবা বিবাহসূত্রে আত্মীয়। অন্যদিকে আমাদের বহু সরকারি, বেসরকারি ও ধর্মীয় নেতা কিংবা কর্মচারী, পুলিশ, দমকল বাহিনীর সদস্য, স্থানীয় ব্যবসায়ী, এমন অনেকেই জাতিগতভাবে আইরিশ।
সেইন্ট প্যাট্রিক’স ডে তাই আইরিশ দিবস এবং তাদের জাতি, ইতিহাস, সংস্কৃতি পালনের দিন। এ উপলক্ষে ১৭ মার্চের আগে বা পরে সুবিধা অনুযায়ী বিভিন্ন শহরে শোভাযাত্রা বা Parade হয়। New York City-i Parade সবচেয়ে বড় ও অত্যন্ত আড়ম্বরপূর্ণ, যা আমরা টেলিভিশনে কিংবা স্বচোখে দেখেছি কিংবা পত্রিকা বা ইন্টারনেটে পড়েছি। ১৭৬২ সালের ১৭ মার্চ নিউইয়র্ক সিটিতে প্রথমবারের মতো সেইন্ট প্যাট্রিক’স ডে প্যারেড হয়। সেই থেকে প্রতিবছর এই দিনে রোদ, বৃষ্টি, তুষার, তুফান যা-ই আসুক না কেন, এই প্যারেড অনুষ্ঠিত হয়। তাই চলুন, আজ আমাদের প্রতিবেশী আইরিশ-আমেরিকানদের এই বিশেষ দিবস সম্বন্ধে কিছু জানি। তাতে করে তাদের সঙ্গে আমাদের সম্পর্ক আরো সুন্দর ও সুগম হবে এবং আমাদের মাঝে এক সেতুবন্ধ তৈরি হবে।
আইরিশ জাতি : জাতিগতভাবে আইরিশরা সেল্টিক (Celtic) জাতি এবং আয়ারল্যান্ডের অধিবাসী। এদের শুরু মধ্য ইউরোপে এবং খ্রিষ্টপূর্ব ১০০০ সাল থেকে আয়ারল্যান্ডে বসবাস করতে থাকে। গায়ের রং অনুযায়ী আইরিশরা শ্বেতাঙ্গ বা সাদা। চুলের রং লালচে (red hair), সোনালি (blond), বাদামি (brown), হালকা কালো (light black)। চোখের রং নীল (blue), বাদামি (brown), পিঙ্গল (hazel) ও কালো (black)। কিছু কিছু আইরিশের মুখে ও গায়ে ছোট ছোট বাদামি রঙের হালকা দাগ থাকে। এগুলোকে বলে freckles. কিছু আইরিশের গায়ের ত্বক এত বেশি সাদা যে এরা রোদে গেলেও ত্বকের রং কখনো গাঢ় হয় না। ধর্মীয় দিক দিয়ে আইরিশরা বেশির ভাগ রোমান ক্যাথলিক, কিছু প্রটেস্টান। সেইন্ট প্যাট্রিকের কারণেই আইরিশরা খ্রিষ্টধর্মাবলম্বী। এর পূর্বে তারা দ্রুয়িড ও বিভিন্ন পৌত্তলিক ধর্মের অনুসারী ছিল।
সবুজের দেশ আয়ারল্যান্ড : আয়ারল্যান্ডে সূর্যমামার দেখা মেলে কম এবং দিনের কোনো না কোনো সময় একটু বৃষ্টি হবেই। এ জন্য আয়ারল্যান্ড হৃদয় কেড়ে নেওয়া চিরসবুজ এক দেশ। বসন্তকালে সেই সবুজকে বলে ‘৪০ স্তরের বা প্রকারের শ্যামল’। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের পল্লিগীতিশিল্পী জনি ক্যাশ এই সবুজের বাহার নিয়ে একটা গানও করেছেন : ‘40 Shades of Green.’ তাই বলতে গেলে সবুজ রং হলো আয়ারল্যান্ডের জাতীয় রং, যা যেকোনো সাজসজ্জায় ব্যবহৃত হয়। বিশেষ করে, সেইন্ট প্যাট্রিক’স ডেতে সবাই সবুজ রঙের কাপড়, টুপি, মোজা, জুতা ইত্যাদি পরিধান করে প্যারেড কিংবা এই দিনের ধর্মীয়, সাংস্কৃতিক, সামাজিক অনুষ্ঠানে যায়। এমনকি বিভিন্ন খাবারে, যেমন রুটি, বেগেল ইত্যাদিতে খেতে নিরাপদ সবুজ রং দেয়। শিকাগো শহরের শিকাগো নদীতে বিগত পাঁচ যুগ ধরে সবুজ রঙের ফুল দিয়ে সেইন্ট প্যাট্রিক’স ডের প্যারেডের দিনে জলকে সবুজ করা হয়। আয়ারল্যান্ডের ডাকনাম (nickname) হলো Emerald Isle.
আইরিশদের নামসমূহ : আইরিশদের প্রথম নামগুলো কিছু ঐতিহ্যপূর্ণ। তাদের ভাষার জন্য ও অন্যগুলো ইউরোপীয় নাম এবং শেষ নামগুলো তাদের বাসস্থান কিংবা তাদের প্রজাতি/গোষ্ঠী অথবা পেশার ওপর ভিত্তি করে দেওয়া হয়েছে। মেয়েদের কিছু জনপ্রিয় প্রথম নাম হলো নিভ (Niamh)-উজ্জ্বল, অ্যাশলিং (Aisling)-স্বপ্ন, কারা (Cara)-বন্ধু, সিনিড (Sinead)-ঈশ্বর দয়ালু, সিভন (Siobhan)-আনন্দপূর্ণ। ছেলেদের প্রথম নামগুলোর মধ্যে কিছু জনপ্রিয় নাম হলো সন (Sean)-জন ও বিজ্ঞ ব্যক্তি, কনর (Conor)-উচ্চ প্রত্যাশিত, লিয়াম (Liam)-শক্ত মনোবলের যোদ্ধা, এইড্যান (Aidan)-ছোট্ট অগ্নিস্ফুলিঙ্গ, ব্র্যানডন (Brandon)-যুবরাজ ইত্যাদি। আইরিশদের শেষ নামগুলোই আইরিশ মানুষ হিসেবে তাদের পরিচিতি বহন করে। কিছু জনপ্রিয় নাম হলো : কেলি (Kelly), মার্ফি (Murphy), ও’সালিভান (O’Sullivan), ও’ব্রায়েন (O’Brien), ও’কনোর (O’Connor), রাইলি (Reilly), কেনেডি (Kennedz), ম্যাককার্থি (McCarthy), ম্যাকলাফলিন (McLaughlin), লিন্চ্ (Lynch), কলিন্স (Collins), ফিটসজেরাল্ড (Fitzgerald), ম্যাকডনেল (McDonnell), কানিংহ্যাম (Cunningham) ইত্যাদি। এ রকম নাম আমরা প্রায়ই শুনে বা দেখে থাকি রেডিও, টেলিভিশন, পত্রিকা কিংবা ইন্টারনেটে।
সংস্কৃতি : আয়ারল্যান্ডের সংস্কৃতি বহু প্রাচীন এবং এর মধ্যে আছে আইরিশদের ভাষা, সাহিত্য, সংগীত, নৃত্য, ভাস্কর্য, চিত্র, পুরাকাহিনি, দেশীয় পোশাক, আঞ্চলিক খাবার, পুরোনো দিনের ক্রীড়া-এমনই আরো বহু কিছু। আয়ারল্যান্ডবাসীর প্রাচীন ভাষা হলো আইরিশ, যা এখন বিলুপ্তির পথে। কয়েক বছর আগেও আয়ারল্যান্ডের ভাষার নাম বলা হতো গেইলিক (Gaelic), কিন্তু এখন আইরিশ নামেই বেশি পরিচিত। অনেকটা আমাদের মতোই, যেমন বাংলাদেশিদের ভাষা বাংলা। আইরিশদের প্রধান ভাষা ইংরেজি। আইরিশ লোকগীতি বাংলা পল্লিগীতির মতোই শ্রুতিমধুর ও অনেক শিক্ষণীয় বিষয় এই গানগুলোর ভেতরে নিহিত। তবে আয়ারল্যান্ডের প্রাচীন গানগুলো কিছুটা বিষাদপূর্ণ।
অন্যদিকে কিছুটা রবীন্দ্রসংগীতের মতোই লাগে। ঐতিহাসিকভাবে সত্য কি না জানা নেই, তা রবীন্দ্রগবেষকেরা বলতে পারবেন-যুবক রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর বিলেতে থাকাকালে কিছু আইরিশের সঙ্গে নাকি তার পরিচয় হয়। সে সময় কোনো এক আইরিশ কিশোরীর সঙ্গে গল্পে মুগ্ধ হয়ে নাকি অনুপ্রেরণা পান তার সেই প্রখ্যাত গানটি রচনা-সুর করতে : ‘আমি চিনিগো চিনিগো তোমারে, ওগো বিদেশিনী।’ আমার ব্যক্তিগত অভিজ্ঞতা থেকে বলতে পারি, যদি বাঙালিদের সঙ্গে ইংরেজ ও আইরিশদের পরিচয় হয়, তাহলে বাঙালিদের কাছে আইরিশদেরই বেশি ভালো লাগবে। সবাই অবশ্য নয়, তবে স্বাভাবিকভাবে ইংরেজরা কথা-বার্তা, আচার-আচরণে কিছুটা শীতল ও উন্নাসিক এবং আইরিশরা উষ্ম ও মিশুক। আইরিশরা খুবই গাল্পিক অর্থাৎ তারা গল্প বলতে পটু (Irish gift of the gab) এবং তা শুনতেও খুবই মজার ও হাস্যরসে পরিপূর্ণ (Irish sense of humour)। বাংলা ঠাকুরমার ঝুলির মতোই আইরিশ লোককাহিনি আছে প্রচুর। প্রাচীনকালে গল্পকারেরা গ্রামে গ্রামে ঘুরে মানুষদের আয়ারল্যান্ডের গল্প শোনাতেন। এটাই ছিল তাদের পেশা।
আইরিশ খাদ্য ও পানীয় : সুস্বাদু ও নামকরা খাবার আইরিশ খাবারের তালিকায় দুষ্প্রাপ্য হলেও কিছু খাবার আছে, যা সেইন্ট প্যাট্রিক’স ডে কিংবা অন্য কোনো বিশেষ দিনে আইরিশদের খেতেই হবে। সেগুলোর মধ্যে উল্লেখযোগ্য হলো আইরিশ সোডাব্রেড, আইরিশ স্টু (ভেড়া, ছাগল অথবা গরুর মাংস আলু, গাজর ও সবজির সঙ্গে রান্না), সেপার্ড’স পাইÑকিমা করা গরুর মাংস আলুর ভর্তার ভেতরে রান্না করা, ভাজা মাছ ও আলু (fish & chips) এবং মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ও কানাডায় খুবই জনপ্রিয় গরুর মাংস ও বাঁধাকপি (corned beef & cabbage) ইত্যাদি। পানীয়ের মধ্যে বিভিন্ন প্রকারের চা (ব্যারি, টুইননিং আইরিশ ব্রেকফাস্ট), বিয়ার (গিনিস, ইংলিং, মার্ফি’স স্টাউট, হার্প লাগার ইত্যাদি) ও আইরিশ হুইস্কি (জেমিসন, টুলামোর ডিউ, বুসমিলস, প্যাডিস ইত্যাদি)। আইরিশরা সাদামাটা খেতেই অভ্যস্ত অর্থাৎ সেদ্ধ আলু, মাংস ও সবজির সঙ্গে একটু লবণ ও গোলমরিচ (pepper)।
সেইন্ট প্যাট্রিকÑআয়ারল্যান্ডের পালক সাধু : প্যাট্রিকের জন্ম রোমান সাম্রাজ্যের অধীন ওয়েলসে ৩৯০ সালে। ১৬ বছর বয়েসে প্যাট্রিক কেলটিক জলদস্যুদের দ্বারা অপহৃত হন এবং জলদস্যুরা তাকে আয়ারস্যান্ডের এক দ্রুয়িড নেতার কাছে দাস হিসেবে বিক্রি করে এবং প্যাট্রিক মেষ পালনের কাজে নিয়োজিত হন। ২০ বছর বয়সে প্যাট্রিক স্বপ্নে আদেশ পেয়ে আয়ারল্যান্ড থেকে পালিয়ে রোমান-ইংল্যান্ডে যান। সেখানে তিনি পুরোহিত হওয়ার অনুপ্রেরণা পান এবং শিক্ষা ও ধর্মীয় জীবন গঠন শেষে যাজক পদে অভিষিক্ত হন।
ধর্মীয় কর্তৃপক্ষ যাজক প্যাট্রিককে মিশনারি হিসেবে আয়ারস্যান্ডে প্রেরণ করেন ২৫ মার্চ ৪৩৩ সালে। সে সময়ে আয়ারস্যান্ডের অধিবাসীরা দ্রুয়িড ধর্ম ও পৌত্তলিক জীবনযাপন করত। নিরলস পরিশ্রম করে তিনি বহু আইরিশকে খ্রিষ্টধর্মে দীক্ষিত করেন এবং অনেক গির্জা প্রতিষ্ঠা করেন। ধর্মীয় কর্তৃপক্ষ তাঁর কাজে সন্তুষ্ট হয়ে পদোন্নতি দিয়ে তাকে বিশপ পদে অভিষিক্ত করে। নতুন খ্রিষ্টানদের ধর্মশিক্ষা দিতে তিনি বুঝতে সহজ করার জন্য স্থানীয় চিহ্ন ব্যবহার করতেন, যেমন পবিত্র ত্রিত্ব অর্থাৎ পিতা, পুত্র ও পবিত্র আত্মা মিলে এক ঈশ্বর বোঝাতে তিনি স্থানীয় ছোট গাছের পাতা স্যামরক ☘️ (Shamrock) ব্যবহার করতেন, যা দেখতে তিনটি পাতার মতো হলেও আসলে তা একটি পাতা। দীর্ঘ ৩০ বছরেরও বেশি সময় ধর্ম প্রচারের কাজ শেষে ১৭ মার্চ ৪৬১ সালে বিশপ প্যাট্রিক মৃত্যুবরণ করেন। ক্যাথলিক মণ্ডলী (Catholic Church) তাকে সাধু হিসেবে আখ্যায়িত করেন এবং তার মৃত্যুর দিনটিকে তার পর্বদিবস (Feast Day) হিসেবে ঘোষণা করেন। সেই সঙ্গে তাকে আয়ারল্যান্ডের পালক সাধু (Patron Saint) হিসেবেও ঘোষণা করা হয়। সে জন্যই তার পর্বদিবসকে সেইন্ট প্যাট্রিক’স ডে এবং আয়ারল্যান্ডের জাতীয় দিবস হিসেবে উদ্্যাপিত হয় ক্যাথলিক চার্চে এবং যেখানেই আইরিশরা বসবাস করেন সেখানে।
সবুজ-শ্যামলের দেশ বাংলাদেশের সকল বাংলাদেশির পক্ষ থেকে ৪০ স্তরের শ্যামলের দেশ আয়াল্যান্ডের সঙ্গে নিবিড় বন্ধনে আবদ্ধ সকল আইরিশকে জানাই ☘️ Happy St. PatrickÕs Day🍀। আইরিশরা গর্বভরে বলে, এই দিনে আমরা সবাই আইরিশ, তেমনিভাবে ২৬ মার্চে সবাই বাংলাদেশি।
লেখক : একজন রোমান ক্যাথলিক যাজক, ঢাকায় জন্মগ্রহণকারী, নিউজার্সিবাসী এবং ধর্মবিষয়ক কলামিস্ট।