আহবাব চৌধুরী খোকন : গত ১০ ডিসেম্বর বিএনপির ঢাকা বিভাগীয় জনসভাকে বানচাল করতে সরকার নয়াপল্টনে রাষ্ট্রীয় সন্ত্রাস সৃষ্টি, মানুষ হত্যা ও গণগ্রেফতার করে কী লাভ করেছে, তা আমার বোধগম্য হয়নি? বিএনপির বিভাগীয় সমাবেশ শেষ পর্যন্ত সফল হয়েছে। পুলিশ ও আওয়ামী লীগ নারকীয় সন্ত্রাস সৃষ্টি করে বন্ধ করতে পারেনি এই জনসভায় সাধারণ মানুষের স্বতঃস্ফূর্ত উপস্থিতি। তাহলে এই জনসভা বিনা বাধায় নয়াপল্টনে করতে দিলে সরকারের কী এমন ক্ষতি হতো? কথায় আছে, ‘সেই তো নথ খসালি, তবে কেন লোক হাসালি।’ হামলা, মামলা, গণগ্রেফতার কিছুই ঠেকাতে পারেনি বিএনপির বিভাগীয় সমাবেশ। নয়াপল্টনে জনসভা করলে নাকি জনদুর্ভোগ সৃষ্টি হয়? কিন্তু সরকারি এজেন্টরা ডিসেম্বরের শুরু থেকে এই জনসভা বানচাল করতে পুরো নয়াপল্টন এলাকায় পুলিশ বেষ্টনী সৃষ্টি, জলকামান ও অস্ত্রধারী ক্যাডার নামিয়ে যেভাবে জনআতঙ্ক সৃষ্টি করেছিল, তাতে কি জনদুর্ভোগ হয়নি? শুনেছি, মানুষ এখন এই পথ দিয়ে রাতে দূরে থাক, দিনের বেলায়ও রিকশা, গাড়ি দিয়ে যেতে ভয় পায়!

এখন আবার দেখছি প্রধানমন্ত্রী একদিকে সারা দেশে রাজনৈতিক সভা-সমাবেশ শুরু করেছেন, অন্যদিকে বিরোধী দলকে সমাবেশ করতে বাধা প্রদান করা হচ্ছে। বিএনপি সমাবেশ করতে চাইলে তাদের জনসভায় লোক আসতে প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি করা হয়। বিগত দিনে দেখেছি, বিএনপির বিভাগীয় সমাবেশগুলোর দিন সরকার সহযোগী সংগঠন দিয়ে শুধু পরিবহন ধর্মঘট ডেকে কান্ত হয়নি, বিএনপির নেতাকর্মীরা যাতে বিভাগীয় শহরগুলোর আবাসিক হোটেলে রাতযাপন করতে না পারেন, সে জন্য জোর করে সকল হোটেল ও রেস্তোরাঁ বন্ধ করে দেওয়া হয়। বিএনপি যখন ঢাকায় জনসভা করার জন্য নয়াপল্টনে অনুমতি চেয়েছিল, তখন তাদেরকে সেখানে অনুমতি না দিয়ে শর্ত সাপেক্ষে অনুমতি দেওয়া হলো সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে, যেখানে যাওয়ার জন্য রয়েছে মাত্র একটি প্রবেশপথ। আর আওয়ামী লীগ কিংবা প্রধানমন্ত্রী জনসভা করতে গেলে দেখা যায়, একটি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের পুরো দেয়াল ভেঙে স্কুলের ওপর দিয়ে রাতারাতি রাস্তা তৈরি করতেও প্রশাসন কুণ্ঠিত হয় না। এমন বৈষম্যমূলক আইন দেখার জন্য কি দেশের মানুষ ১৯৭১ সালে রক্ত দিয়ে এই দেশকে স্বাধীন করেছিল? প্রধানমন্ত্রীর জনসভার দিন স্কুল, কলেজ, সরকারি অফিস-আদালত বাধ্যতামূলক বন্ধ করে দিয়ে সবাইকে জনসভায় যেতে বাধ্য করা হয়। বিভিন্ন জায়গা থেকে লোক ভাড়া করে এনে তারপর গোয়েবলসের কায়দায় বলা হয়, প্রধানমন্ত্রীর জনসভায় বিশাল লোকসমাগম হয়েছে। এগুলো যে শুভঙ্করের ফাঁকি, জনগণ কিন্তু বুঝতে পারে। কোনটা জোরপূর্বক আর কোনটা স্বতঃস্ফূর্ত জনসমর্থন, মানুষ তা বুঝতে পারে। একসময় এটা করে রেহাই পাওয়া যেত, কারণ তখন প্রযুক্তি এতটা উন্নত ছিল না। এখন কোথাও অনিয়ম হলে সেটা আর গোপন থাকে না, মুহূর্তে ছড়িয়ে পড়ে সর্বত্র। বিএনপি অফিসে পুলিশ ব্যাগে করে বোমা নিয়ে রেখে গেছে, এটা যেমন দেশে-বিদেশে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমের সুবাদে সাধারণ মানুষ দেখতে পেরেছে, তেমনি কোথাও কোনো অনিয়ম হলে সেটা মুহূর্তের মধ্যে ছড়িয়ে পড়ে সর্বত্র। লোক ভাড়া করে এনে কিংবা মানুষকে জনসভায় যেতে বাধ্য করে সেই জনসভাকে হয়তো বিশাল জনসভা হিসেবে ইলেকট্রনিক কিংবা প্রিন্ট মিডিয়ায় দেখানো যাবে কিন্তু তা জনগণের নিকট বিশ্বাসযোগ্য হবে না। আবার বিরোধী দলকে পদে পদে বাধা প্রদান কিংবা জোর করে দলের কেন্দ্রীয় কার্যালয় বন্ধ করে দিয়ে সেখানে দলের নেতাকর্মীরা বোমা রেখেছে এমন আজগুবি বক্তব্য হয়তো মিডিয়ায় দেখানো যাবে কিন্তু সেটা জনগণের নিকট বিশ্বাসযোগ্য হবে না।
গত ৭ ডিসেম্বর আমরা দেখেছি একটি নৃশংস ঘটনা। রাজধানীর ওয়ারী এলাকায় যুবদল নেতা ফয়সাল মাহবুবকে বাড়িতে না পেয়ে পিটিয়ে হত্যা করা হয়েছে তার বৃদ্ধ পিতা আজগর আলীকে। মানুষ যদি তার নিজ ঘরে থেকেও নিরাপত্তা না পায়, তাহলে আর কোথায় যাবে? ঘরে-বাইরে কোথাও আজ মানুষের নিরাপত্তা নেই। শুধু মিছিল-মিটিং করার অপরাধে পুলিশ বিএনপির নিরস্ত্র নেতাকর্মীদের জোর করে থানায় উঠিয়ে নিয়ে যেতে পারঙ্গমতা দেখালেও নিরপরাধ পিতা আজগর আলীকে হত্যার দায়ে একজন সন্ত্রাসীকেও এখন পর্যন্ত গ্রেফতার করা হয়েছে বলে শোনা যায়নি। সাধারণ মানুষের নিরাপত্তা প্রদান পুলিশের সাংবিধানিক দায়িত্ব হলেও পুলিশকে সেটা পালন করতে দেখা যায় না। মানুষ আজ বিচার ছাড়াই প্রাণ হারাচ্ছে। এই অবস্থা দেখে পুরো দেশটা এখন সাধারণ মানুষের নিরাপদ আবাসস্থল নাকি ডাকাত-সন্ত্রাসীদের অভয়ারণ্য, তা বোঝার উপায় নেই।
রাষ্ট্রবিজ্ঞানীদের ভাষায় একটি কল্যাণধর্মী ও সফল রাষ্ট্রের সংজ্ঞা হচ্ছে প্রত্যেক নাগরিককে অনাচার ও অবিচার থেকে রক্ষা করা এবং তাদের মর্যাদা সমুন্নত রাখা। সকল সরকারি প্রকল্প ও নীতির লক্ষ্য হবে নাগরিকদের জীবনযাত্রার মান উন্নয়নে কাজ করা ও সর্বাবস্থায় জনগণের নিরাপত্তা নিশ্চিত করা। কিন্তু আমাদের রাষ্ট্র কি সেটা করতে পারছে? আর পারছে না বলেই ব্যর্থ রাষ্ট্রের তালিকায় উঠে এসেছে বাংলাদেশের নাম। এখন প্রশ্ন থাকে, এই দেশকে ব্যর্থ প্রমাণের জন্য দায়ী কে? যে সরকারের দায়িত্ব জনগণের জান-মালের নিরাপত্তা নিশ্চিত করা, সেই সরকার আজ শুধু ক্ষমতা কুক্ষিগত করে রাখার জন্য সাধারণ মানুষের প্রতিপক্ষ হয়ে দাঁড়িয়েছে। জনগণ শুরু থেকে লক্ষ করেছে, ঢাকার সমাবেশকে বানচাল করতে সরকার এমন কোনো অপকর্ম নেই, যা করেনি। সরকার হয়তো-বা মনে করছে, ঢাকার রাজপথে বিএনপি বড় শোডাউন করতে সক্ষম হলে এটা পরবর্তী সময়ে তাদের পতনের কারণ হতে পারে। কিন্তু আন্দোলন বানচাল করে সরকার কি পতন ঠেকিয়ে রাখতে পারবে? পৃথিবীতে কোনো স্বৈরাচারী শক্তিই জনগণের ওপর জুলুম চালিয়ে কিছুদিন ক্ষমতায় থাকতে সক্ষম হলেও তাদের পরকাল কিন্তু ভালো হয়নি। এই আওয়ামী সরকারের ক্ষেত্রেও এর ব্যতিক্রম হবে না। তাই সময় থাকতে এই সাধারণ বিষয়টা সরকার ও সরকারি মহলের অনুধাবন করা উচিত।
লেখক : কলামিস্ট ও কমিউনিটি অ্যাক্টিভিস্ট, নিউইয়র্ক।