শামসুল আরেফিন খান
নিজের প্রাণকাড়া একজোড়া অনন্তবালা, হৃদয় ছোঁয়া সাতলরি হার, অনেক সোহাগমাখানো স্মৃতিজড়ানো আসল রূপোর সেই ঢাউস কোমর বিছেটা ; আর গতায়ু জীবনসাথীর সারাজীবনে দেয়া গয়নার বাক্সখানা বুকফেড়ে বের করে প্রাণের নিধি সবেধন নীলমণির হাতে তুলে দিয়ে মা বললেন, সাতপুরুষের ব্যবসা, দেখিস যেন নষ্ট না হয় বাছা! “জীবনঘনিষ্ঠ এক বারোয়ারি গল্পের সেই নাড়িছেঁড়া ধনই পাখিডাকা এক ভোরে আহ্নিকের সময় ঠাকুর ঘরে গিয়ে কাচুমাচু হয়ে জননীকে বললে, “মা তোমার নতুন নাকফুলটা খুলে দাও তো দেখি“। মা বললেন, ওটা দিয়ে কী করবিরে খোকা? তোর পুঁজিতে আবার টান পড়লো নাকী ?“ ছেলে নিজেই স্বর্ণকার। বংশ পরম্পরায় শাহু। সে একটুখানি থতমত খেয়ে ঢোক গিলে বললে, “না মা । তুমি দিলে আশীর্বাদ, বাবার আটকেপড়া বাকি বকেয়ার আদায় অশুল পেয়ে গেলুম; শ্বশুর মশাই দিলেন যৌতুক। তাই দিয়ে, ব্যবসা আমার বেশ ফুলে ফেঁপেই উঠেছে। তাই তো তোমাকে নাকফুলটা গড়ে দিলুম’’।
মা বললেন, তো? ছেলে বললে, মা তাতেই তো হয়েছে যত ল্যাটা। আমার পেট গেছে ফেপে! মা বললেন, কেনরে খোকা, সেই সব ছাই-ভস্ম আবার গিলিসনি তো? নাকি ভেজাল ট্যাজাল খেলি?
ছেলে সপ্রতিভ হয়ে গলা নামিয়ে বললে, না মা। ভেজাল আর খেলাম কোথায়? শালাবাবু দামি একটা বিলেতি বোতল দিলে; তার সাথে তোমার বৌ-মার নিজের হাতে রান্না কচুরি আর কাছিম ভাজা ! তাতে ভেজাল আসবে কোত্থেকে মা? কিন্তু তোমার নাকফুলটায় ভেজাল জুড়িনি, সে ‘জন্যি‘ তো এ অবস্থা। নিজের মায়ের গয়না বলে ‘কতা‘! তোমার ওটায় একটুথানি বাড়তি খাদ দিলেই ল্যাটা যাবে চুকে। এক চিলতে সোনা যা বেরুবে তা দিয়েই তোমার বৌমার গোসাটাও মিটে যাবেখন“। মা বললেন, সেই ভালো। তবে তাই করগে খোকা। আর দেরি করিসনি বাছা“। সবার জানা এ পুরানো গল্পটা আর ‘রবাটের‘ মত টানতে চাইনা। স্বর্ণকার গহনায় বাড়তি খাদ দেবেই। সেটা শুধু তার খাসলতই না, তার ব্যবসায়িক ধর্ম বটে । গদিনসিন দলের রাঘব বোয়াল ও চুনোপুটি, এমপি, মন্ত্রী, মেম্বার চেয়োরম্যানের ছেলেরা মাঝরাতে চাঁদের আলোয় প্রকৃতির ডাকে সাড়া দিতে বাইরে যাওয়া গরীব ঘরের বৌ-বেটিদের তুলে নেবে; সেটাও তাদের জন্মগত অধিকার শুধুনা খাসলত বটে! “সাক্ষী কই ,সাবুদ নেই? মামলা ডিসমিস“। ময়লা যায়না যেমন কয়লা ধুইলে, তেমনি দুষ্ট লোকের নষ্ট খাসলতও যায়না মলে। বাতকা বাত যদিও , জীবনের সাথে রয়েছে তার অনেক মিল তবুও । ইতিহাসের সাথেও। নুপংসুক জার নিকোলাসের যৌবনবতী সুন্দরী বৌয়ের খসম ভন্ডপীর রাসপুতিনের শিস্ন ছেদন করে হিমজলে চুবিয়ে না মারলে তার ইল্লত-খাসলতগুলো রাশিয়ার না খাওয়া তুষার-শীতে মরা সর্বহারাদের আরও কিছুকাল জ্বালিয়ে-পুড়িয়ে কয়লা করে ছাড়তো। জার নিকোলাস(২)কে খতম না করলে রুশ বিপ্লব, শৈশবেই হঠকারি ম্যাকমিলান রবসপিয়ারির অপরিণত ফরাসী বিপ্লব কিংবা বঙ্গবন্ধু মুজিবের বান্ধবহীন অসময়োচিত ‘ দ্বিতীয় বিপ্লব‘ এর মত খাবি খেতো কিনা তাই বা কে জানে ?
কথায় আছে, সাতশ‘ ইঁদুর মেরে হুলো যায় তীর্থে। শাব্দিক অর্থে এতে একটা শ্লেষ থাকলেও মর্মার্থে রয়েছে তাতে একটা শুদ্ধির টনিক । পাপী মানুষও দৃঢ় চিত্তে নিজের সমস্ত পাপ নিকাশের পথে এগিয়ে যেতে পারে। তারও একটা বড় নীল নকশা রয়েছে আমাদের ধর্ম সংশ্লিষ্ট বাল্মিকী কাহিনীতে।
কৃত্তিবাসের রামায়ণ থেকে হরণ করে, বাল্মিকী-প্রতিভার আখ্যানভাগে কবিগুরু রবীন্দ্রনাখ ঠাকুর লিখেছেন, মহাকবি বাল্মীকি প্রথম জীবনে ছিলেন হন্তারক, লুন্ঠক ভয়ানক এক দস্যুসর্দার । অরণ্যবাসী কালীভক্ত সেই রতœাকর ডাকাতের অনুচরবৃন্দ একদা নরবলীর জন্য এক বালিকাকে বেঁধে আনলো বধ্যভূমিতে। গঙ্গাস্নান ও পূজা সমাপ্ত করে নরবলী দিতে উদ্যত হতেই বালিকার কন্ঠে করুণ গান শুনে বিহ্বল হয়ে বলী বর্জন করলেন দস্যু সর্দার। পরবর্তী মৃগয়ায় তার এক নির্দয় অনুচর একটি মাসুম বাচ্চা হরিণকে বধ করতে গেলে দয়াবশে দস্যুরাজ অন্তরায় হলেন।। অনুচরবর্গ ভাবলে, সর্দার ব্যাটা পাগল হয়ে গেছে। অকস্মাৎ রণে ভঙ্গ দিলে তারা। নিসঙ্গ হয়ে একাকী অরণ্যে বিচরণকালে একদিন এক ব্যাধকে ক্রৌঞ্চমিথুন বধ করতে দেখে শোকার্ত দস্যুসর্দারের মুখ দিয়ে নির্গত হল প্রথম স্বর্গীয় শ্লোক:
“মা নিষাদ প্রতিষ্ঠাং ত্বমগমঃ শাশ্বতীঃ সমাঃ।// যৎ ক্রৌঞ্চমিথুনাদেকমবধীঃ কামমোহিতম্।।“
নিজ উচ্চারণে বিস্মিত হলেন রতœাকর। দৃশ্যপটে আবির্ভূত হলেন , মা স্বরস্বতী। তিনি দিলেন তারে উপহার :“এই নে আমার বীণা, দিনু তোরে উপহার/ /যে গান গাহিতে সাধ, ধ্বনিবে ইহার তার“। ‘বাল্মিকী প্রতিভায়‘ কাহিনীভাগে কবিগুরু খানিকটা মনের মাধুরি ঢেলেছেন। পূরাণকাহিনীতে ঈষদ পরিবর্তন এনেছেন। সেখানে মর্তে আগত স্বর্গের নারদমুনি দস্যু রতœাকরের খড়গের তলে দাঁড়িয়ে বলেছিলেন , “দারা- পুত্র-পরিবার কেউ হবেনা তোর পাপের ভাগিদার , ওরে পামর; আমারে বধিলে বাড়িবে পাপাচার, অনন্ত নরকবাস হবে পরিণাম তার’’। পরক করি সে উক্তি, ঘটিল তাহার মহামুক্তি, হাজার বছর তপস্যায় পাপমুক্ত হয়ে জন্ম নিলেন বাল্মিকী , লুপ্ত হইলো রতœাকর“। কবিগুরু নারদকে সরিয়ে তার জাগায় সরস্বতীকে এনেছেন মাত্র।
প্রেক্ষাপট যাইহোক না কেন , পরিবর্তনটাই আসল কথা। বাস্তবে যে পরিবর্তন ও রূপান্তর ঘটছে, আমরা স্বচক্ষে দেখছি অহরহ, দুর্ভাগ্যক্রমে সেটার গতিপথ বহলাংশেই , এগোয় ভালো থেকে মন্দের দিকে। সমস্যাটা সেখানেই। পানি গড়ায় ঝর্ণাধারায় পাহাড় বেয়ে সমতলে। সুপেয় সে জলেরই অপর নাম জীবন। সেই পানি যখন নর্দমায় নামে তখন তার স্থিতি ঘটে অবিরাম পঙ্ক থেকে পঙ্কে। পাপ থেকে মহাপাপ। লোভে পাপ , পাপে মৃত্যু। পাপ বাপকেও ছাড়েনা। পুণ্য অপরাজেয় । পাপের ক্ষমতা অপরিসীম, পাপ অজেয়। এক কড়াই দুধে একবিন্দু ‘গো-মূত্র‘ যথা। তাই যখন পাপের পঙ্কে কোন পঙ্কজ দেখি ফুটতে সেটা গেঁথে যায় মনের গহীনে। তেমনি পাপী থেকে রূপান্তরিত পুণ্যবান এক চরিত্রের কথা আংশিক করেছি বর্ণনা এর আগের পর্বে।
আমার নিবিড় পর্যবেক্ষণে ধরা পড়েছে ভালো থেকে নষ্ট হওয়া এবং মন্দ থেকে ভালো হওয়া গত শতাব্দীর কিছু নিন্দিত ও নন্দিত মানুষ। ১৯১২ সালে মহিয়সী সরজিনী নাইডু যারে সাম্প্রদায়িক ঐক্যের অগ্রদূত মেনে নিবিড় সান্নিধ্য দিলেন; পন্ডিত মতিলাল নেহেরুর বিদূষি কন্যা শ্রীমতি বিজয়লক্ষ্মী পন্ডিত যারে, কথিত অগাধ প্রেম দিলেন (?), তিনি আর কেউ নন; তিনি শান্তির বরপুত্র মহাত্মা গান্ধীর ধর্মান্তরিত ঘনিষ্ঠ জ্ঞাতি(?) পুনা জিন্নার এন্ট্রান্স পাশ ব্যারিস্টার পুত্র মোহাম্মদ আলী জিন্নাহ। অবাক হচ্ছেন?
১৯২০-২২ সালে মহাত্মা গান্ধী ভারতবর্ষের ব্রিটিশবান্ধব মুসলমানদের একটি বিদ্রোহী ধারাকে অসহযোগ আন্দোলনে সম্পৃক্ত করতে খেলাফতের সাথে রাখি বাঁধলেন। সে সময় সাম্রাজ্যবাদী ব্রিটিশের রণতান্ডবে তুরস্কের অটোমান সাম্রাজ্য ভুমিসাত হয়েছিল। বিলুপ্ত হয়েছিল ইসলামের ধ্বজাধারি বাদশাহ ওসমানের শক্ত হাতে গড়া ও “জিনের রাজা“ খ্যাত সোলেমান বাদশার অতুল কীর্তিবাহী ৬শ বছরের বলদর্পী খেলাফত । জেনে রাখা ভালো যে, প্রথম মহাযুদ্ধের সূচনাতেই অটোমান সাম্রাজ্যের সঙ্কোচন শুরু হয়। অটোমান তুর্কীরা ১৯১৪ সালে জার্মানি এবং অস্ট্রিয়া-হাঙ্গেরীর সমর্থনে যুদ্ধে ঝাঁপিয়ে পড়ে অপরাজেয় ব্রিটিশের ঈগল দৃষ্টি থেকে পরিত্রাণ লাভের আশায়। ১৯১৮ সালে তাদের ভরাডুবি ঘটে। যুদ্ধোত্তর একটি চুক্তির মাধ্যমে বিজয়ী ব্রিটিশ, ফ্রান্স, গ্রীস এবং রাশিয়ার মধ্যে ভাগাভাগি হয়ে যায় বিজিত অটোমান সাম্রাজ্য মালে গনিমতের মত । ১৯২২ সালে আনুষ্ঠানিকভাবে অটোমান যুগের অবসান হয় এবং ১৯২৩ সালে মোস্তফা কামাল আতাতুর্কেও নেতৃত্বে তুর্কী প্রজাতন্ত্র প্রতিষ্ঠা পায়। গণহত্যা লাঞ্ছিত আর্মেনিয়ায় ১৫ লক্ষ মানুষ খুনের কলঙ্ক মাথায় নিয়ে শেষ অটোমান সম্রাটও নির্মূল হন। তাতেই ক্ষেপেছিল ভারতের ধর্মান্ধ গোঁড়া মুসলমান। মারমুখি হয়ে উঠেছিল তারা । সেই প্রেক্ষিতে ‘অহিংসার অবতার‘ লেঙটিপরা হরিজনরাজা বাপুজি মোহনদাশ করমচাঁদ গান্ধী ‘ধর্মের সাথে রাজনীতির রাখিবন্ধন‘ ঘটালেন। ক্ষোভে ফেটে পড়লেন তায় নিভাজ বিলেতি সুবেশধারী সেক্যুলার জিন্নাহ। পদত্যাগ করলেন কংগ্রেস থেকে। গোস্বা করে বিলেত গিয়ে ঘরে খিল দিলেন। সেখানেই দুষ্টলোকের মিষ্ট কথায় ভুলে ইসলামের ধ্বজাধারী ধর্মান্ধ মুসলিম লীগের হাল ধরলেন সেই ভন্ড সেক্যুলার জিন্নাই। বাল্মিকীর সন্নাস থেকে বুঝি দস্যু রতœাকর বেরিয়ে এলো।“সাধুবেশে ব্যাটা পাকা চোর অতিশয়“!!
।।২।। দ্বিতীয় মহাযুদ্ধে (১৯৩৯-১৯৪৫) পরাধীন ভারতবর্ষ তথা স্বাধীন ভারত , পাকিস্তান , নেপাল ও বাংলাদেশ ভূখন্ডের ৮৭ হাজার বীর গুর্খা রাজপুত পাঠান বেলুচ সেনানী হাসিমুখে প্রাণ দিলো প্রভু ব্রিটিশের পক্ষে লড়তে গিয়ে। পঁয়ষট্টি লক্ষ ভারতীয় আদম অনাহারে প্রাণ হারালো ইংরেজ সৈন্যদের আহার যোগাতে বাধ্য হয়ে। তদানীন্তন ব্রিটিশ প্রধানমন্ত্রী রণোন্মাদ স্যার উইনস্টন চার্চিলের প্রত্যক্ষ নির্দেশে তস্কর ব্রিটিশ ভারতীয় কৃষকের গলাটিপে শস্য গোলা খালি করে লুটে নিলো যত ছিল খাদ্যদানা । আহার বাড়ন্ত হলো তাদের । রইলো না বীজধান টুকুও। ভারতের আমজনতা বিশেষ করে বাংলার নিরন্ন নরনারী যখন আস্তাকুড়ে শরমেয়র সাথে করছে পচাগলা উচ্ছিষ্ট খাদ্য নিয়ে কাড়াকাড়ি; সে দুঃসময়ে হৃদয়হীন চার্চিল প্রত্যাখ্যান করেছিলেন ভারতবাসীর জন্যে জরুরি খাদ্য ত্রাণের আবেদন। অথচ ভারতীয় গোলাম সৈন্যরা তখন বীরদর্পে লড়ছিল মিত্রবাহিনীর পক্ষে জার্মানি, ইতালি ও জাপানের বিরুদ্ধে। ইউরোপ উত্তর আফ্রিকা ও ইতালির রণাঙ্গন সয়লাব হয়েছিল ভারতীয় শোনিতে। ব্রিটিশ বলবান ছিল তখন ভারতের সম্পদ ও শিল্পিত অর্থনীতি , প্রভুত অস্ত্র উৎপাদন ও সশস্ত্র জনবল দিয়ে। ভাগ্যের কী নির্মম পরিহাস! ১৯৪২ সালে ভারতীয় বাহিনীর প্রধান অধিপতি ফিল্ডমার্শাল স্যার ক্লডি অচিনলেক ( ঋরবষফ গধৎংযধষ ঝরৎ ঈষধঁফব অঁপযরষবপশ) বেশ জোরে শোরেই বলেছিলেন “ভারতীয সেনাবাহিনী না থাকলে ব্রিটিশরাজ ১ম ও ২য় মহাসমর তরাতে পারতো না“। ১৭টি ভিক্টোরিয়া ক্রস জয়ী ইঙ্গ-ভারতীয় বাহিনীর সৈন্য সংখ্যা ছিল ২০৫,০০০ ; সাথে ছিল জবরদস্তি তলব করা অগণিত বাধ্যতামূলক ‘স্বেচ্ছাসেবক‘ যাদের সংখ্যা ১৯৪৫ অবধি দাঁড়িয়েছিল ২৫ লক্ষে ; পেটেভাতে রণাঙ্গনে মরতে দাঁড়ানো হুকুমদাসের এই মহাসমারোহই ছিল ইতিহাসের বৃহত্তম নরমেধযজ্ঞ। ভারতবাসীকে সেই স্বেচ্ছামৃত্যুর দিকে ঠেলে দিয়েছিল কে? বা কারা? সেটা জেনে রাখা ভালো।
সময়টা ছিল ১৯৩৯ সাল। নবাগত ব্রিটিশ ভাইসরয় লর্ড লিঙলিথগাও (খড়ৎফ খরহষরঃযমড়)ি ভারতের সর্বদলীয় নেতৃবৃন্দকে জড়ো করে বললেন, মহামহিম ব্রিটিশ সরকার বাহাদুর জার্মান ও ইতালীয় ফ্যাসিবাদের বিরুদ্ধে এখন যুদ্ধ করছে। আমরা ভারতকেও আমাদের পাশে পেতে চাই। জবাবে ভারতের প্রধান রাজনৈতিক দল সর্বভারতীয় কংগ্রেস বললো, আমরা আগে স্বাধীনতা চাই, গণতন্ত্র চাই, মুক্তি চাই। ‘তারপরে সেন যুদ্ধ‘! কিন্তু জিন্নার নেতৃত্বে নিখিল ভারত মুসলিম লীগ ব্রিটিশরাজের যুদ্ধবাজিতে অকুন্ঠ সমর্থন জানালো বিনা শর্তে। গোঁয়ার গোবিন্দ জিন্নাহ নির্লজ্জভাবে বললেন, ভারতের মুসলমানরা বীরের জাতি; একটি পৃথক জাতি সত্ত্বা । তারা লড়বে। ভারতের মুসলমানদের পক্ষে কথা বলার অধিকার রাখে কেবলমাত্র মুসলিম লীগ। অন্য কেউ না। আমরা অবশ্যই যুদ্ধে যাবো“। তখন ভারতের ৬ প্রদেশে কংগ্রেস সরকার অধিষ্ঠিত ছিল। একমাত্র বাংলায় ছিল নাজিমুদ্দীনের নেতৃত্বে মুসলিম লীগ সরকার । পাঞ্জাবে ক্ষমতাসীন তখন সিকান্দার হায়াত খানের অকংগ্রেসী কোয়ালিশন।
সাফ ‘না’ বললেন গুরুত্বপূর্ণ ভারতীয় নেতা মোহনদাস করমচাঁদ গান্ধী , মওলানা আবুল কালাম আজাদ, পন্ডিত নেহেরু ও বল্লভ ভাই প্যাটেল, সীমান্ত গান্ধী খান আব্দুল গাফ্ফার খান , বেলুচ নেতা নবাব বুগতাই , পাঞ্জাবের সেকেন্দার হায়াত খান ও মার্কসবাদী ধনকূবের মিঞা ইফতেকারউদ্দীন, মাহমুদুল হক কাসুরি এবং সিন্ধুর জিঁয়ে সিন্ধ নেতা জি এম সৈয়দ ও বাংলার প্রগতিশীল নেতৃবৃন্দ । তাঁরা দ্ব্যর্থহীন প্রত্যয়ে বললেন,“আমরা জার্মানি ও তার সুগ্রীব দোসর ইতালির ফ্যাসিবাদদের যেমন বিরোধী তেমনি ব্রিটিশ সাম্রাজ্যবাদেরও চরম বিরোধী। আগে সাম্রাজ্যবাদ ভারত ছাড়ুক তারপরে আমরা লড়তে যাবো কিনা ফ্যাসিবাদের বিরুদ্ধে সেটা ভেবে দেখা হবে“। ব্রিটিশ রাজের তল্পিবাহকরা ভারতের বরেণ্য নেতৃবৃন্দের বক্তব্য প্রত্যাখ্যান করলো। ভাইসরয় ভারতীয় নেতাদের মতামতের তোয়াক্কা না করে একতরফাভাবেই ভারতবাসীকে যুদ্ধের আগুনে ছুঁড়ে দিলেন । কংগ্রেস দুর্বার হয়ে “কুইট ইন্ডিয়া (ব্রিটিশ ভারত ছাড়ো) “ আন্দোলন শুরু করলো ১৯৪২ সালে। মহাত্মা গান্ধীসহ হাজার হাজার ভারতীয় নেতা কারাগারে নিক্ষিপ্ত হলেন।
নেতাজী সুভাষচন্দ্র বসু কংগ্রেস সভাপতির পদ ছেড়ে জাপানের সহায়তায় প্রবাসী ভারত সরকার প্রতিষ্ঠা করলেন সিঙ্গাপুরে। জাপান যুদ্ধবন্দী ভারতীয়দের (চঙড) মুক্ত করে অস্ত্র হাতে তুলে দিলো। তারা নেতাজীর আজাদ হিন্দ ফৌজ গঠনে মদদ যোগালো ।
নেতাজী ব্রিটিশের বিরুদ্ধে স্বাধীনতার জন্য লড়াই করতে জার্মানির মদদ চাইলেন স্বয়ং হিটলারের সাথে দেখা করে। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ৭ বছর সশস্ত্র যুদ্ধ চালিয়ে ব্রিটিশের গোলামির জিঞ্জির ছিঁড়ে স্বাধীন হয়েছিল। ফ্রান্সের মদদ নিয়েছিলেন সে যুদ্ধের নেতা জর্জ ওয়াশিংটন। নেতাজী চেয়েছিলেন “সেই পথ লক্ষ্য করে , স্বীয় কীর্তি ধ্বজা ধরে“ সশস্ত্র সংগ্রামের মাধ্যমে ভারত স্বাধীন করতে। ব্যাটে বলে হোল না। গান্ধিজী হাঁটলেন অহিংস অসহযোগের পথে। সোভিয়েত ইউনিয়ন গাঁটছঢ়া বেঁধেছিল ইঙ্গ-মার্কিন মিত্রশক্তির সাথে। তাই বামপন্থীরা সে দিকেই ছাতা ধরলো। জিন্নাহ পা রাখলেন ষড়যন্ত্রের অন্ধগলিতে। পাপ ছাড়লো না বাপকে। ব্রিটিশের তল্পীবাহক জিন্নাহ ষড়যন্ত্রের জাল বুনে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের সাথে গাঁটছড়া বেঁধেছিলেন দেশভাগের আগেই । কিন্তু তাঁকে ডিঙ্গিয়ে সবাইকে বিস্মিত করে প্রধানমন্ত্রী লিয়াকত আলী খান অনুসরণ করলেন সুকর্নোর পঞ্চশীলা পন্থী সাম্রাজ্যবাদ ও নয়া-উপনিবেশবাদ বিরোধী জোট নিরপেক্ষ পররাষ্ট্র নীতির রোডম্যাপ । পারস্পরিক সমঝোতায় ছিটমহলসহ সীমান্ত বিরোধ মীমাংসার অঙ্গীকারে ও কাশ্মীর প্রশ্নে জাতিসংঘের শর্তে লিয়াকত নেহেরু -চুক্তি স্বাক্ষর হলো। জিন্নাহ চেয়েছিলেন মার্কিন সাহায্যপুষ্ট সামরিক সমাধান। লিয়াকত সে নির্দেশ লঙ্ঘন করলেন। যুক্তরাষ্ট্র লাল চোখ দেখালো । সেই ঐতিহাসিক রূপান্তর তাঁর বুলেটবিদ্ধ শবদেহে “শহীদে মিল্লাতের “ তকমা এঁটে দিলো। এদিকে জিন্নার যে আজন্ম বক্ষব্যাধি তার স্বপ্নে লালিত প্রেম ভালোবাসা হরণ করেছিল, স্ত্রী বিচ্ছেদ ঘটিয়েছিল , একমাত্র কন্যাকে দূরে সরিয়ে রেখেছিল সেই মরণ ব্যাধিই এবার তার প্রাণ বধ করলো। এবোটাবাদের এক স্বাস্থ্য নিবাসে একরকম বিনা চিকিৎসায় কেবলমাত্র আজীবন সাথী সহোদরা ফাতেমা জিন্নার সান্নিধ্যে নির্জন নিঃসঙ্গতায় তার জীবনাবসান হলো ১১ সেপ্টেম্বর ১৮৪৮।
জিন্নাহ কী তাঁর ভুল বুঝতে পেরেছিলেন? ভারতের অন্যতম প্রধান নেতা বল্লভ ভাই প্যাটেল যখন বললেন, “ভারতবর্ষের সব মুসলমান যদি তাদের নিজস্ব আবাসভূমি পাকিস্তানে চলে যায় তাহলেই মঙ্গল! স্বাধীন ভারতে উপমহাদেশের সব হিন্দুর স্থান সঙ্কুলান হবে অনায়াসে“। তখনই জিন্নার বোধদয় হয়েছিল বোধ করি। কোথায় থাকবে ভারতবর্ষের ১৬ কোটি মুসলমান এই ক্ষুদ্র পাকিস্তান ভূখন্ডে ?“ ঠাঁই নাই ঠাঁই নাই ছোট সে তরী , আমারই সোনার ধানে গিয়াছে ভরি!“দ্বিজাতি তত্ত্বের বেলুনটা তখনই চুপসে গিয়েছিল । কফিনে শেষ পেরেকটি ঠুকেছিলেন জিন্নাহ নিজেই সংখ্যাগরিষ্ঠ বাঙালির মাতৃভাষার উপর খড়্গ তুলে। সুন্দরবনে রয়েল বেঙ্গল টাইগারের তখনই মনে হয় গর্জে উঠেছিল ‘জয় বাংলা‘ বলে ! কেঁপে উঠেছিল ভুভারত ভূমিকম্পের প্রথম ঝাঁকুনিতে। সে গর্জন আমিও শুনতে পেয়েছিলাম মাত্র ৮ বছর বয়সে , আমার প্রথম স্কুল জীবনে, ১১ মার্চ ১৯৪৮ । যশোর মুসলিম একাডমির ৩য় শ্রেণীর এক নাদান ছাত্র তখন আমি।
ফ্রিমন্ট, ক্যালিফোর্নিয়া ।