সেন্টমার্টিন : এত দিন বর্ষার সময় নলকূপ থেকে লবণ পানি উঠত না। কিন্তু এবার বর্ষাকালজুড়ে সেন্টমার্টিন দ্বীপের বেশির ভাগ নলকূপ থেকে উঠছে লবণ পানি। তাই দ্বীপবাসী খাবার পানির তীব্র সঙ্কটে পড়েছেন। এই বর্ষায় অস্বাভাবিক জোয়ারে সেন্টমার্টিনের নিম্নাঞ্চল বারবার প্লাবিত হওয়ায় এবং দ্বীপের বালুর নিচে (অগভীর অঞ্চলে) লবণ পানি ঢুকে পড়ায় নলকূপ থেকে মিঠাপানি দুষ্প্রাপ্য হয়ে উঠেছে। সেই সাথে সাগর বক্ষে একটু একটু করে চলে যাচ্ছে ভূমি। গত কয়েক দিনে প্রায় ৬ শত নারকেল গাছ সাগরে চলে গেছে। ঘরবাড়িও বিলীন হয়েছে বেশ কয়েকটি। এক কথায় সেন্টমার্টিন দ্বীপ অস্তিত্ব সঙ্কটে পড়েছে।
প্রাপ্ত তথ্য মতে, পূর্ণিমার জোয়ার মানেই সেন্টমার্টিন দ্বীপবাসীর জন্য আতঙ্ক ও তীব্র উদ্বেগ। বিশেষ করে বর্ষার পূর্ণিমার জোয়ার মানে ভয়ঙ্কর রূপ। এই জোয়ারে দ্বীপের উত্তর ও পশ্চিমাঞ্চলের কিছু কিছু অংশ ভেঙে যাচ্ছে সাগর বক্ষে। ঘরবাড়ি, নারকেল গাছ, কেয়া গাছ ও নিশিন্দা বন বিলীন হচ্ছে। গত কয়েক বছরে এই ভাঙনের শুরু। তবে এবার বর্ষায় তীব্রভাবে ভেঙে যাচ্ছে সেন্টমার্টিনের ভূমি।
সেন্টমার্টিন ইউনিয়ন পরিষদের ২নং ওয়ার্ডের সদস্য মোহাম্মদ হাবিব খান জানান, বর্ষাকালে আমাদের খবর কেউ রাখেন না। মানুষ হিসেবে কত মানবেতর জীবনযাপন করি আমরা তার খবর কেউ নেয় না। বর্ষায় দ্বীপের বেশির ভাগ মানুষের কোনো রোজগার থাকে না। সাগরে সতর্ক সঙ্কেতের পর সতর্ক সঙ্কেত। কেউ মাছ শিকারে যেতে পারেন না। আবহাওয়া খারাপ থাকলে সেন্টমার্টিনের সাথে টেকনাফের মালামালবাহী নৌযোগাযোগও বন্ধ থাকে। এ বছর বর্ষায় চাল ডালসহ নিত্যপ্রয়োজনীয় সামগ্রীর দাম আকাশছোঁয়া। কাঁচামরিচ ৪০০ টাকা কেজিতেও পাওয়া যাচ্ছে না। এমতাবস্থায় দ্বীপবাসীর দুঃখ দুর্দশার যেন শেষ নেই। সেই সাথে এবার বর্ষাজুড়ে দ্বীপের উত্তরপাড়া ও পশ্চিমপাড়া প্রায় ৩ কিলোমিটার ৫০ ফুট পর্যন্ত ভূমি সাগর বক্ষে বিলীন হয়েছে। সাগরে চলে গেছে প্রায় ৬০০ নারকেল গাছ। জোয়ারের পানিতে দ্বীপের অধিকাংশ এলাকা প্লাবিত হচ্ছে নিয়মিত।
কিন্তু বর্ষার সময় প্রায়ই আবহাওয়া খারাপ থাকে। সে কারণে তাদের স্বাভাবিক আয়ের উৎসও কমে যায়। তার ওপর জিনিসপত্রের সরবরাহ ঠিক না থাকায় দামও বেড়ে যায়, যা সাধারণের নাগালের একেবারে বাইরে চলে যায়। অভিজ্ঞ মহলের মতে, মাত্রারিক্ত গণউৎপাত, দূষণ ও নানা রকম পরিবেশবিরোধী কর্মকা-ের ভারে ন্যুব্জ হয়ে পড়েছে দেশের একমাত্র প্রবাল দ্বীপ সেন্টমার্টিন। এসবের ফলে প্রকৃতিই এখন এমন বৈরী আচরণ শুরু করেছে। প্রতিটি পূর্ণিমার জোয়ারেই দ্বীপের কিছু না কিছু অংশ ভেঙে যাচ্ছে। গণউৎপাতে সামুদ্রিক কাছিম আর আগের মতো ডিম দিতে আসে না। খাদ্য সঙ্কটে হারিয়ে যাচ্ছে পাখিসহ স্তন্যপায়ী প্রাণি। দূষণে গণহারে মারা যাচ্ছে প্রবাল। সব মিলিয়ে প্রবাল দ্বীপ সেন্টমার্টিনের জীববৈচিত্র্য ও প্রাকৃতিক অন্যসব অবস্থা ভয়াবহ হুমকিতে পড়েছে। লম্বায় ৩৩৭ কিলোমিটার দ্বীপের ছেরাদিয়ায় কোনো জনবসতি নেই। গলাচিপা থেকে উত্তরদিকে জনবসতি সব। ১৮৯২ সালের (সিএস) জরিপে সেন্টমার্টিনের জমির পরিমাণ ছিল ৮০১৮৬ একর এবং তা ছিল মাত্র ১২ ব্যক্তির নামে। ১৯২৯ সালে (আরএস) জরিপে ভূমি কিছুটা বৃদ্ধি পায়। ৪৯ ব্যক্তির নামে ওই সময় ৮২৩৮৮ একর জমি রেকর্ড হয়। ১৯৭২ সালের (বিএস) জরিপে ৯৭১ জনের নামে পাওয়া যায় ৮৩৫৮০ একর জমি। বর্তমানে সার্ভে হলে জমির পরিমাণ অবিশ্বাস্যভাবে কম পাওয়া যাবে।
জাতীয় সমুদ্র গবেষণা ইনস্টিটিউটের জ্যেষ্ঠ বৈজ্ঞানিক কর্মকর্তা এ এস এম শরীফ বলেন, আগে সেন্টমার্টিন দ্বীপে ন্যাচারাল প্রটেকশন ছিল। ছিল কেয়াগাছের বাউন্ডারি। গত কয়েক বছরে সেন্টমার্টিন দ্বীপের প্রায় সবগুলো ন্যাচারাল প্রটেকশন ধ্বংস করায় উত্তর ও পশ্চিম অংশ ভেঙে যাচ্ছে।