সৌদি আরব: মধ্যপন্থী ইসলামের ঘোষণা স্রেফ কৌশল

সৌদি আরবের সিংহাসনের উত্তরাধিকারী যুবরাজ মোহাম্মদ বিন সালমান। ছবি: রয়টার্স

সৌদি আরবের সিংহাসনের উত্তরাধিকারী যুবরাজ মোহাম্মদ বিন সালমান যখন গত মঙ্গলবার ঘোষণা দিলেন, তিনি দেশটিকে মধ্যপন্থী ইসলামের দিকে নিয়ে যেতে চান, তখন কিন্তু সবাই তাঁর কথা বিশ্বাস করেননি। যা হোক, এই ঘোষণায় অনেকেই আশাবাদী হয়েছেন, এই অতিরক্ষণশীল রাজতন্ত্র সমালোচকদের কথা মেনে নেবে, যাঁরা বহুদিন ধরে আরও স্বাধীনতা ও সহিষ্ণুতা দাবি করে আসছেন। কিন্তু অন্যরা আবার সতর্ক করে বলেছেন, মধ্যপন্থী ইসলাম কী জিনিস, সেটা পরিষ্কার নয়। বস্তুত, এই ঘোষণার সঙ্গে দেশটির বহু পুরোনো রীতিনীতি পরিবর্তনের চেয়ে তার অর্থনীতি চাঙা করার সম্পর্কই বেশি।

মোহাম্মদ এক সম্মেলন ও সাক্ষাৎকারে এই ঘোষণা দেন। ঘোষণায় এই ইঙ্গিত পাওয়া যায় যে তিনি ইসলামের চরম ব্যাখ্যার সঙ্গে লড়াই করে অর্থনীতিতে বেশি নজর দিতে চান। তিনি বলেন, ‘সৌদি আরবে তরুণ নাগরিকের সংখ্যা ৭০ শতাংশ। সততার সঙ্গে বললে, আমরা চরমপন্থী ইসলামি চিন্তার সঙ্গে লড়াই করতে জীবনের ৩০ বছর নষ্ট করব না। আমরা এখনই এটা ধ্বংস করব।’ বলা দরকার, এই সম্মেলনে বিদেশি বিনিয়োগকারীরাও ছিলেন। সেখানে তিনি আরও বলেন, ‘এত দিন আমরা যা করেছি, এখন ঠিক তার উল্টোটা করব। অর্থাৎ আমরা মধ্যপন্থী ইসলাম গ্রহণ করব, যার দ্বার সমগ্র পৃথিবী ও সব ধর্মের জন্য খোলা থাকবে।’

এরপর দ্য গার্ডিয়ান–এর সঙ্গে এক সাক্ষাৎকারে সৌদি আরবের ওয়াহাবি ইসলামের দিকে ঝুঁকে পড়ার জন্য তিনি অপ্রত্যাশিতভাবে চরম শত্রু শিয়া রাষ্ট্র ইরানের ঘাড়ে দোষ চাপান। ওয়াহাবি আন্দোলন ইসলামের এক অতিরক্ষণশীল তরিকা, রিয়াদ দেশের ভেতরে ও বাইরে সব জায়গায় যেটার প্রচারণা চালিয়ে থাকে। গার্ডিয়ানকে তিনি বলেন, ‘দেশে গত ৩০ বছরে যা হয়েছে, সৌদি আরব তা নয়। এই অঞ্চলে গত ৩০ বছরে যা হয়েছে, মধ্যপ্রাচ্য তা-ই নয়। ১৯৭৯ সালে ইরানের ইসলামি বিপ্লবের পর বিভিন্ন দেশ এই মডেল অনুসরণ করতে চেয়েছে। এটা কীভাবে সামাল দিতে হবে, সেটা আমাদের জানা ছিল না। এরপর সমস্যাটি সমগ্র পৃথিবীতে ছড়িয়ে পড়ে। এখন আমাদের এটার হাত থেকে রেহাই পেতে হবে।’

সৌদি আরব রাষ্ট্রের নাড়ি অনেক দিন ধরেই সুন্নি ওয়াহাববাদে গভীরভাবে প্রোথিত। এর সঙ্গে সে আষ্টেপৃষ্ঠে জড়িয়ে আছে। ওয়াহাবি মতবাদের প্রতিষ্ঠাতা মোহাম্মদ ইবন আবদ আল ওয়াহাব তিন শতক আগে এই তরিকা প্রতিষ্ঠা করেন, তিনি সৌদি রাজতন্ত্রের প্রতিষ্ঠাতা মোহাম্মদ ইবন সৌদের ঘনিষ্ঠ মিত্র ছিলেন। এরপর বিশ শতকে আধুনিক সৌদি রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠিত হলে ইসলাম তার রাষ্ট্রধর্ম হিসেবে স্বীকৃতি পায়। তখন দেশটির সব ধর্মবেত্তা সরকারের সমর্থনে ও রাষ্ট্রের অর্থায়নে অতিরক্ষণশীল ওয়াহাববাদ প্রচার করতে শুরু করেন। আর ইসলামের এই তরিকাই মুসলিম দেশগুলোতে ব্যাপকভাবে প্রচারিত হতে শুরু করে। ফলে যুবরাজ যখন এই দীর্ঘদিনের অনুসৃত তরিকার সমালোচনা করলেন, তখন সৌদি নেতৃত্বের মধ্যে এ নিয়ে সন্দেহের অবকাশ তৈরি হয়।

লন্ডন স্কুল অব ইকোনমিকসের মধ্যপ্রাচ্যভিত্তিক বিশেষজ্ঞ মাদওয়াই আল-রশিদ এক ই-মেইলে বলেছেন, সৌদি আরব এমন একটি দেশ, যেখানে মধ্যপন্থী ইসলাম শুধু অতিরক্ষণশীল ইসলামে রূপান্তরিত হয়নি, বরং সেখানে ব্যতিক্রম দেখা গেছে। তিনি বলেন, ‘আমূল সংস্কারকামী ধর্ম রাষ্ট্রধর্মে পরিণত হয়েছে—এটি তার এক অনন্য দৃষ্টান্ত, যে ধর্ম আবার সেই রাষ্ট্রের ন্যায্যতার ভাষ্যে পরিণত হয়েছে।’ তিনি আবার সতর্ক করে দিয়েছেন, ‘যে ধর্মবেত্তারা ইসলামের ভিন্ন ব্যাখ্যা, অর্থাৎ ইসলাম ও গণতন্ত্র কীভাবে একসঙ্গে চলতে পারে—সে কথা বলেছেন, সৌদি নেতৃত্ব তাঁদের জেলে পুরেছে।’

রশিদ প্রশ্ন করেছেন, এই ঘোষিত ধর্ম সংস্কার কি বাস্তবায়িত হবে? ‘নিশ্চিতভাবে বিনিয়োগকারীদের আকৃষ্ট করতে এই ঘোষণা দেওয়া হয়েছে। যে রাজতন্ত্রের ভাবমূর্তি খুব খারাপ, তার সম্পর্কে একটু ভালো ধারণা তৈরি করতেই এই ঘোষণা।’

৩২ বছর বয়সী যুবরাজ মোহাম্মদ দেশটির তরুণ প্রজন্মের প্রিয়পাত্র হওয়ার চেষ্টা করছেন, যাঁরা আগের প্রজন্মের মতো অতটা ধার্মিক নন। এঁদের মধ্যে বেকারত্বের হার সামঞ্জস্যহীনভাবে বেশি। মঙ্গলবারের তাঁর এই ঘোষণা কিন্তু আরেকটি ঘোষণার সঙ্গে জড়িত। সেটা হলো, তিনি দেশটির পশ্চিমাঞ্চলে জর্ডান ও মিসরের সীমান্তের কাছে এক ভবিষ্যৎ–মুখী শহর নির্মাণের ঘোষণা দিয়েছেন। প্রযুক্তি প্রতিষ্ঠানের কেন্দ্র হিসেবে এই শহর গড়ে তোলা হবে। এর জন্য দেশটির সার্বভৌম সম্পদ তহবিল থেকে ৫০ হাজার কোটি ডলার অর্থায়ন করা হবে। সৌদি ভিশন ২০৩০-এর আওতায় দেশটির যে বড় বড় সংস্কার কর্মসূচি হাতে নেওয়ার কথা, এটি তার একটি। অর্থনীতির সঞ্জীবনী সুধা হিসেবে যুবরাজ নিজে এই প্রকল্পের নেতৃত্ব দেবেন।

তেলের দাম অর্ধেকের বেশি পড়ে গেছে, এই পরিপ্রেক্ষিতে আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিলের পূর্বাভাস অনুযায়ী সৌদি অর্থনীতি এ বছর নিশ্চল হয়ে পড়বে। তেলের উচ্চমূল্যই ছিল এত দিন সৌদি আরবের রাজস্ব আয়ের প্রধান উৎস। এই হঠাৎ ও অপ্রত্যাশিত মূল্য হ্রাসের পর সৌদি নেতৃত্বকে তিন বছর আগে খুব কম সময়ের মধ্যে বড় ধরনের সংস্কার কর্মসূচি হাতে নিতে হয়েছিল।

সংস্কারের এই প্রয়োজনীয়তার কারণে নেতৃত্বের অতিরক্ষণশীল অবস্থান পাল্টানোর প্রয়োজনীয়তা সৃষ্টি হয়েছে। গত মাসে তারা নারীদের গাড়ি চালানোর লাইসেন্স দিয়ে পৃথিবীর তাক লাগিয়ে দেয়, যদিও এটা অনেক আগেই দেওয়ার কথা ছিল। তখন এই পদক্ষেপ দেখে মনে হয়েছিল, সৌদি সরকারের মধ্যকার আধুনিকেরা রক্ষণশীল কট্টরপন্থীদের চেয়ে ক্ষমতাশালী হয়ে উঠেছেন।

সৌদি নারীরা সুশিক্ষিত, কিন্তু তাঁরা কর্মসংস্থানে পিছিয়ে আছেন। মোহাম্মদের সংস্কার কর্মসূচির একটি গুরুত্বপূর্ণ লক্ষ্য হচ্ছে কর্মক্ষেত্রে তাঁদের অংশগ্রহণ বাড়ানো। অর্থনৈতিক দুরবস্থা তীব্র হওয়ায় এই প্রস্তাবে সায় দিতে সৌদি আরবের কট্টরপন্থীদের ওপর ব্যাপক চাপ রয়েছে।

তবে জার্মান কাউন্সিল অন ফরেন রিলেশন্সের সৌদি পর্যবেক্ষক সেবাস্তিয়ান সন্স মনে করেন, ‘যুবরাজের কথার অর্থ এই নয় যে সৌদি আরব পূর্ণাঙ্গভাবে বহুত্ববাদী সমাজে পরিণত হবে, যেখানে বিভিন্ন ধর্মের মানুষ সহাবস্থান করতে পারবে। শিয়াদের ওপর নিপীড়ন বন্ধ হবে, এমন লক্ষণও দেখা যাচ্ছে না।’ আবার ‘ইসলামের সংস্কার মানে কিন্তু শুধু নারীদের গাড়ি চালাতে দেওয়া বা বিকিনি পরতে দেওয়া নয়’—বিশেষজ্ঞ রশিদ আমাদের সে কথাও স্মরণ করিয়ে দেন।