
বিশ্বচরাচর ডেস্ক : বিমানবন্দরে লাল গালিচা সংবর্ধনা। প্রটোকল ভেঙে সরকার প্রধানদের আলিঙ্গনসহ সবই পেলেন সৌদি আরবের ‘কার্যত ক্ষমতাধর’ যুবরাজ মোহাম্মদ বিন সালমান। চীন বাদে এশিয়ার দুটি দেশে সফরে এই দৃশ্যই দেখা গেল। অথচ ওয়াশিংটন পোস্ট পত্রিকার কলামিস্ট জামাল খাশোগি হত্যাকে কেন্দ্র করে ব্যাপক সমালোচনার মুখে আছেন প্রভাবশালী এই ব্যক্তি। খাশোগি হত্যার প্রায় পাঁচ মাসের মাথায় তাকে ঘিরে এই সংবর্ধনা অনেককে হতবাক করলেও বাস্তবতা ভিন্ন। যুবরাজ বিন সালমান যেমন ক্ষুণ্ন ভাবমূর্তি পুনরুদ্ধারে সচেষ্ট, তেমনি কতটা অর্থ আর বিনিয়োগ সৌদি আরবের কাছ থেকে বাগিয়ে নেওয়া যায় সেই চেষ্টায় রত ছিল তিনটি দেশ। তবে কোনো কোনো বিশ্লেষক বলছেন, কেবল ভাবমূর্তি পুনরুদ্ধারই নয়, পশ্চিমা বিশ্বের বাইরে এশিয়ায় নতুন মিত্র খোঁজাও যুবরাজের অন্যতম লক্ষ্য।
স্বচ্ছ ভাবমূর্তির আশা
গত বছরের ২ অক্টোবর তুরস্কের ইস্তাম্বুলে সৌদি কনস্যুলেটের ভেতর হত্যার শিকার হন খ্যাতিমান সাংবাদিক জামাল খাশোগি। তাকে হত্যার কথা স্বীকার করে সৌদি আরব। এ জন্য ১১ জনকে বিচারের মুখোমুখিও করা হয়েছে। মার্কিন গোয়েন্দা সংস্থা সিআইএ বলেছে, খাশোগিকে হত্যার পেছনে সৌদি যুবরাজের হাত আছে। তুরস্কের তদন্তেও এমন ইঙ্গিত আছে। মার্কিন প্রেসিডেন্ট ট্রাম্প যুবরাজের পাশে দাঁড়ালেও প্রতিনিধি পরিষদ এবং সিনেট যুবরাজের বিরুদ্ধেই কাজ করছে। খাশোগি হত্যার পেছনে যে যুবরাজ দায়ী সেই সংক্রান্ত একটি প্রস্তাব উত্থাপনে সায় দিয়েছেন সিনেটররা। এমনকি সৌদি আরবে অস্ত্র বিক্রিতেও বাধা দিচ্ছেন তারা। জাতিসংঘও খাশোগি হত্যার তদন্ত করছে।
যুক্তরাষ্ট্রসহ পশ্চিমাদের সমালোচনায় সৌদি আরবের অতীত যুবরাজদের চেয়ে অনেকটাই অপছন্দের হয়ে পড়েছেন ‘এমবিএস’ খ্যাত যুবরাজ। গত বছরের নভেম্বরে জি-২০ সম্মেলনেও নিন্দার মুখে পড়েছিলেন তিনি। সেজন্য বিশ্ব মিডিয়ায় নিজের ইতিবাচক ভাবমূর্তি প্রকাশ করতেই এশিয়া সফরে এসেছেন যুবরাজ।
পাকিস্তানে প্রথম সফরে আসেন বিন সালমান। প্রটোকল ভেঙে তাকে স্বাগত জানান প্রধানমন্ত্রী ইমরান খান। নিজে গাড়ি চালিয়ে যুবরাজকে তার গন্তব্যে নিয়ে যান। উপহার দেন গোল্ড পেলেটেড তলোয়াড়। ভারতের ইচ্ছায় পাকিস্তান থেকে সৌদি আরবে ফিরে যান এমবিএস। এরপর নয়াদিল্লিতে আসা যুবরাজকে প্রটোকল ভেঙে স্বাগত জানান এবং বুকে টেনে নেন প্রধানমন্ত্রী মোদি। যুবরাজের সম্মানে মধ্যাহ্ন ভোজের আয়োজন করেন। প্রধানমন্ত্রী মোদি নিরামিষভোজী হলেও যুবরাজের জন্য ছিল গরুর মাংসসহ নানা পদের খাবার। এসব দৃশ্য দেখে সিঙ্গাপুরের নানিয়াং টেকনোলজি ইউনিভার্সিটির সিনিয়র ফেলো জেমস ডরসির ভাষ্য, যুক্তরাষ্ট্রে এবং ইউরোপের সমালোচনার শিকার হওয়া যুবরাজ এশিয়া এসে তা নিরসনের প্রচেষ্টায় অনেকটাই সফল হয়েছেন।
নতুন মিত্র ও লাভ-লোকসান
পাকিস্তান, ভারত এবং চীন খাশোগি হত্যার বিষয়টি যুবরাজের সঙ্গে বৈঠকে তুলেছে এমন তথ্য পাওয়া যায়নি। সবাই চেষ্টা চালিয়েছে নিজেদের সুধিবা আদায় করতে। পাকিস্তানের সঙ্গে ২০ বিলিয়ন ডলারের চুক্তি করেছে সৌদি। পাকিস্তানের ঋণের বোঝা অনেক। বিশ্ব অর্থনৈতিক সংস্থা আইএমএফ কর্তৃক দেউলিয়া ঘোষণার হুমকিতে দেশটি। তাই প্রধানমন্ত্রী ইমরান খানের মূল লক্ষ্য দেউলিয়াত্ব এড়ানো। এ জন্য সম্প্রতি ইরানের সঙ্গে সম্পর্ক খারাপ হলেও তাতে ইমরানের ভ্রৃক্ষেপ নেই। ইরানের প্রভাবশালী রেভ্যুলেশনারি গার্ডের ওপর হামলার জন্য (২৭ সদস্য নিহত) পাকিস্তান ভিত্তিক একটি জঙ্গি গোষ্ঠীকে দায়ী করা হয়েছে। সৌদি যুবরাজের সফরের আগে হামলার ঘটনা ঘটে। আর ইরান-সৌদি সম্পর্ক বিশ্লেষণ করলে দেখা যায়, ইরানে হামলায় সৌদি আরব যে খুশি হবে তা বলার অপেক্ষা রাখে না তা সে যেই করুক না কেন।
একটি তেল পরিশোধানাগার স্থাপনে ভারতের সঙ্গে ১০ বিলিয়ন ডলারের চুক্তি করেছে সৌদি। যুবরাজ আবার দুই বছরে নয়াদিল্লিতে ১০০ বিলিয়ন ডলার বিনিয়োগের ঘোষণা দিয়েছেন। চীনের সঙ্গে ২৮ বিলিয়ন ডলারের অর্থনৈতিক চুক্তি হয়েছে সৌদি আরবের। এর মধ্যে ১০ বিলিয়ন ডলার ব্যয়ে একটি তেল পরিশোধানাগার তৈরির প্রকল্প আছে।
পশ্চিমারা যখন খাশোগি হত্যায় যুবরাজের সমালোচনা করছেন তখন চীন পাশে থাকার ঘোষণা দেয়। চীন সফরের সঙ্গে জড়িত এক কর্মকর্তা জানিয়েছেন, চীন খাশোগি হত্যাকাÐকে ততটা গুরুত্ব দিচ্ছে না। তাদের হিসেব-নিকেশটা ভিন্ন। উইঘুর মুসলিমদের সঙ্গে আচরণ নিয়ে চীনের সমালোচনা আছে বিশ্বে। তুরস্ক চীনের সমালোচনা করলেও সৌদি আরবকে তেমন একটা করতে দেখা যায় না। বরং যুবরাজ চীন সফরে গিয়ে বলেছেন, নিরাপত্তার স্বার্থে উইঘুর মুসলিমদের আটকে রাখার অধিকার চীনের আছে। গত বছর চীন-সৌদি দ্বিপক্ষীয় বাণিজ্যের পরিমাণ ছিল ৪২ দশমিক ৪ বিলিয়ন ডলার। চীন সৌদিতে ২০ মিলিয়ন ডলারের অস্ত্র রপ্তানি করে। এবার সেটি বাড়বে বলেই বেইজিং আশা করছে। অন্য দিকে চীনা প্রেসিডেন্ট শি জিনপিং সৌদি যুবরাজের সঙ্গে বৈঠকের আগে ইরানের পার্লামেন্টের স্পিকার আলী লারিজানির সঙ্গে বৈঠক করেছিলেন।
সৌদি আরব ভোগৌলিকভাবে তাদের পররাষ্ট্র নীতিতে পরিবর্তন আনছে। দেশটির রাষ্ট্রীয় টেলিভিশনেও তেমনটি বলা হয়েছে। এত দিন দেশটির ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক ছিল পশ্চিমা বিশ্বের সঙ্গে। যুবরাজ তেলের বাইরেও অর্থনীতিকে শক্তিশালী করতে চান। তিনি পশ্চিমা বিশ্বের চেয়ে এখন এশিয়াকে গুরুত্ব দিচ্ছেন। এক বছর আগেও প্রকাশ্যে তাকে প্রকাশ্যে ইংরেজিতে কথা বলতে তেমন দেখা যেতো না। কিন্তু এশিয়া সফরে তাকে ইংরেজিতে কথা বলতে দেখা গেছে এবং প্রকাশ্যে। মক্কা নগরীতে চীনা বিনিয়োগের ওপরও গুরুত্ব দিচ্ছে সৌদি আরব। দেশটি আফ্রিকায় তাদের বিভিন্ন পণ্য রপ্তানি করতে চায়। আফ্রিকায় চীনের প্রচুর বিনিয়োগ আছে। বিশ্লেষকরা বলছেন, সফরের মূল উদ্দেশ্য-যুবরাজ পশ্চিমাদের দেখিয়ে দিয়েছেন যে, সারা বিশ্বেই তার প্রবেশাধিকার আছে।