ডাঃ সওকত আরা বেগম
ক্যান্সার নিয়ে গবেষণার অন্ত নেই সারা দুনিয়া জুড়ে। এই মরণব্যাধির ওষুধ আবিষ্কারের জন্যও গবেষকরা অক্লান্ত পরিশ্রম করে যাচ্ছেন। মহিলাদের বেলায় শরীরের অন্যান্য অঙ্গের তুলনায় স্তনের ক্যান্সারে মৃত্যুর হার সবচেয়ে বেশি । গত অর্ধ শতাব্দী ধরে ধীরে ধীরে এ রোগের সংখ্যা বেড়েই চলেছে। তাই এই রোগ সম্পর্কে আমাদের সকলের জানা দরকার এবং সেই সাথে সতর্ক হওয়াও প্রয়োজন। কারণ ক্যান্সার রোগের নিয়ম অনুযায়ী শরীরের সব জায়গায় ছড়িয়ে পড়ার আগে প্রাথমিক পর্যায়ে যদি এ রোগ ধরা পড়ে এবং চিকিৎসা করা যায় তবে পঁচানব্বই পার্সেন্ট রোগীর পাঁচ বছর আয়ু বাড়িয়ে দেওয়া সম্ভবপর হয়। আবার অনেক সময় রোগী সম্পূর্ণ ভাল হয়ে যায়। বর্তমান চিকিৎসা সম্পর্কীয় এই অগ্রগতির যুগেও অর্থাৎ প্রাথমিক পর্যায়ে রোগ নির্ণয় এবং ঊন্নত চিকিৎসা পদ্ধতি সত্ত্বেও মহিলাদের বেলায় শরীরের অন্যান্য অঙ্গের তুলনায় স্তনের ক্যান্সারে মৃত্যুর হার অনেক বেশি। তাই মহিলাদের বেলায় স্তনের ক্যান্সার এর প্রাথমিক অবস্থায় রোগ নির্ণয় করার বিষয়টি খুবই গুরুত্বপূর্ণ।
রোগের কারণ: স্তন ক্যান্সারের সঠিক কোন কারণ এখনও জানা যায়নি । তবে বিভিন্ন সমীক্ষায় দেখা গেছে, এই রোগে আক্রান্তরোগীদের কিছু কিছু বিষয়ে মিল খুঁজে পাওয়া যায়। যেমন, অনেক ক্ষেত্রে রোগীর কাছ থেকে ইতিহাস নিয়ে জানা গেছে যে, এক পরিবারের আত্মীয়-স্বজনদের মধ্যে স্তনের ক্যান্সারে আক্রান্ত হতে দেখা যায়। তাই বলে বংশগত কারণও সবসময় সঠিক বলে ধরে নেয়া যায় না।
আবার যেসব মায়েদের সন্তান রয়েছে তাদের চেয়ে অবিবাহিতা, চিরকুমার মহিলাদের মধ্যে স্তনের ক্যান্সারের হার বেশি। অনেক সময় দেখা যায় যে সব মহিলার মেনোপজ দেরিতে হয়েছে অর্থাৎ বেশি বয়স পর্যন্ত মাসিক বহাল থাকছে, তাদের মধ্যে স্তনক্যান্সার বেশি দেখা গেছে। আবার যে সকল মা নিয়মিত সন্তানকে স্তন্য দান করে থাকেন, তাদের মধ্যে স্তন ক্যান্সারের হার কম দেখা যায়।
এ কারণেও বর্তমান সময়ে স্তন্যদান করার ক্ষেত্রে মায়েদেরকে বেশি উৎসাহিত করা হয়। এভাবে দেখা যায়, স্তনের ক্যান্সারের সঠিক কারণ জানা গেলেও এ বিষয়গুলো বেশ গুরুত্ব বহন করে। এছাড়া বয়সও এ রোগের জন্য বেশ গুরুত্বপূর্ণ কারণ। সাধারণতঃ মহিলাদের ঋতুস্রারাব বন্ধ হবার পরবর্তী সময়ে অর্থাৎ ৪০ থেকে ৫০ বছর বয়সের সময় থেকেই স্তনের ক্যান্সার হবার সম্ভাবনা বেশি বলে ধরে নেওয়া হয়ে থাকে। তবে কোন ধরাবাধা নিয়ম নেই । এর আগেও হতে পারে ।
রোগের লক্ষণ : অধিকাংশ সময় রোগী পোষাক বদলাবার সময় অথবা গোসল করার সময় হঠাৎ তার স্তনে ছোট চাকা বা পিন্ড অনুভব করেন, যেটি বেশ শক্ত। যেমনটি অন্য স্তনে নেই । স্তনের ক্যান্সার অধিকাংশ ক্ষেত্রে একটি স্তনের একটি স্থানেই হয়ে থাকে।
সাধারণত ডানদিকের চাইতে বামদিকের স্তনই বেশি আক্রান্ত হয়। অনেক ক্ষেত্রে রোগীর হাতে স্তনে কোন চাকা বা টিউউমারর কিছুই অনুভূত হয়না। শুধু অপর স্তনটি থেকে একটু অস্বাভাবিক মনে হয়। অর্থাৎ স্তনটির একটি জায়গা অন্যটির চাইতে কিছুটা মোটা মনে হয়।
সাধারণত স্তনের ক্যান্সারে প্রাথমিক স্তরে টিউমারটিতে কোন ব্যথা অনুভূত হয় না। ব্যাথা হয় ক্যান্সারের শেষ স্তরে। তবে কোন কোন সময় স্তনের চারপাশে লালচে রং হয়ে যায়। আবার কোন সময় স্তনের বোটা ভিতরের দিকে ঢুকে যায় । এইসব লক্ষণ দ্বারা রোগের গভীরতা বোঝা যায়না। রোগ হিসাবে কতখানি খারাপ বা ভাল অবস্থায় আছে তার হিসাব পাওয়া যায় প্যাথলজিক্যাল পরীক্ষা দ্বারা আক্রান্ত কোষসমুহের অবস্থা পরীক্ষা করার পর। ম্যামোগ্রাফী পরীক্ষা দ্বারা স্তনের ক্যান্সার প্রাথমিক অবস্থাতেই ধরা পড়ে ।
চিকিৎসা :- প্রাথমিক অবস্থায় ধরা পড়লে প্রথমেই শল্য চিকিৎসক দ্বারা আক্রান্ত স্তনটিকে কেটে ফেলে দেওয়া হয় । তারপর জধফরধঃরড়হ ঃযবৎধঢ়ু দেওয়া হয় এবং ঈযবসড়ঃযবৎধঢ়ু দেওয়া হয় । কখনও হরমোন থেরাপীও দেওয়া হয়ে থাকে এবং অনেক ক্ষেত্রেই রোগীকে পুরোপুরি সুস্থ করে তোলা যায় বলে চিকিৎসকগণ দাবী করেন। তবে ক্যান্সার সারা শরীরে ছড়িয়ে পড়লে জীবনের আশা থাকেনা এবং স্তন ক্যান্সার রোগীর জীবনের দৈর্ঘ দশ বছরের বেশি কখনই নয় বলে ধরে নেওয়া হয়।
প্রতিরোধ সচেতনতা : আমাদের দেশের মহিলারা স্তন ক্যান্সার সম্পকর্কে মোটেই সচেতন নয় বলা যায় ।তাই রোগের প্রাথমিক অবস্থায় এরোগ ধরা পড়েনা । অথচ প্রাথমিক আবস্থায় ধরা পড়লে এরোগ নিরাময় সম্ভব বলে চিকিৎসকগণ দাবী করেন । তাই মহিলাদেরকে এ রোগ সম্পর্কে সচেতন হতে হবে। আর সে কারণে প্রত্যেক মহিলারই বয়স তিরিশ বা চল্লিশের কাছাকাছি হলে মাঝে মাঝে নিজের স্তন দুটি পরীক্ষা করে দেখতে হবে। হাতে কোন শক্ত চাকা অনুভূত হচ্ছে কিনা অথবা কোন অস্বাভাবিকতা দেখা দিচ্ছে কিনা সেটা খেয়াল করতে হবে । তবে হাতে কোন চাকা অনুভূত হলেই ভয়ের কিছু নেই। স্তনের আরও রোগে এমনটি হতে পারে। তাই কোন রকম অস্বাভাবিকতা লক্ষ্য করলে চিকিৎসকের পরামর্শ নিতে হবে এবং সর্বোপরি চিকিৎসকের পরামর্শ অনুযায়ী নিয়মিত ম্যামোগ্রাফী পরীক্ষা করাতে হবে যা কিনা অতি প্রাথমিক অবস্থায় রোগ নির্ণয়ের জন্য খুবই জরুরী । এই পরীক্ষায় যা সাথে সাথে ধরা পড়ে হাত দিয়ে সেটা ধরা পড়ে বছর খানেক অথবা তারও পরে । এছাড়া কোনসময় যদি তুলনামূলকভাবে একটি স্তন অপরটি হতে ভারী মনে হয় অথবা স্তনের বোটা থেকে কোনরকম নিঃসরণ হয়, তাহলেও স্থানীয় চিকিৎসক, স্ত্রীরোগ চিকিৎসকের কাছে যেতে হবে। তিনিই বলে দেবেন পরবর্তীতে কি পদক্ষেপ নিতে হবে ।
মোটামুটিভাবে এই বিষয়গুলো খেয়াল রাখলে প্রাথমিক রোগ নির্ণয়ে সাহায্য হয় এবং সঠিক চিকিৎসা দ্বারা রোগীকে সুস্থ করে তোলা সম্ভব হয়ে ওঠে। তবে মহিলাদের জন্য সর্বাগ্রে যেটা প্রয়োজন তা হচ্ছে এরোগ সম্পর্কে আত্মসচেতনতা এবং সকল মহিলাদের মাঝে এই সচেতনতা র তাগিদ টা জোরালো করা।
সবশেষ একটি তথ্য দিয়ে শেষ করব আমার বক্তব্য।
গত ২রা মার্চ, ২০১৮; “ঠিকানা” পত্রিকার ৩১ পৃষ্ঠায় প্রকাশিত এক খবরে জানতে পেলাম যে, বিশ্বজুড়ে ব্রেস্ট ক্যান্সারে মৃত্যুর হার বেশ উদ্বেগজনক। তাই, এরোগ নিয়ন্ত্রণ ও মৃত্যুহার কমিয়ে আনার জন্য যুক্তরাষ্ট্রে বিভিন্ন ধরনের গবেষণা চলছে এবং বছরের বেশির ভাগ সময় ধরে চলেছে “এ্যাসপ্যারাজিন বায়োএ্যাভেইলিবিলিটি গভার্ণস্ মেটাসটেসিস্ ইন এ মডেল অব ব্রেস্টক্যান্সার” শীর্ষক গবেষণাটি। দীর্ঘ গবেষণার প্রতিবেদন সম্প্রতি আমেরিকান মেডিক্যাল জার্নালে প্রকাশ করা হয়েছে। সবচেয়ে আনন্দ ও গর্ব করার বিষয় এই যে, ২১ সদস্যের তরুণ চিকিৎসা বিজ্ঞানী গবেষকদের মাঝে আমাদের দেশের ছেলে, সৌখিন খানও ছিলেন । তিনি বলেন- “এ্যাসপারাজিন” এর প্রভাব বেশী থাকলে ব্রেস্ট ক্যান্সারের জীবাণু শরীরে ছড়িয়ে পড়ে। এ ধরনের পরিস্থিতিতে রোগীকে বাঁচানো খুব কঠিন হয়ে যায়। গবেষণার উপর ভিত্তি করে তিনি বলেন, “অনেক রোগী কেমোথেরাপী নিচ্ছেন, এর পাশাপাশি তাদের খাদ্যাভাসেও পরিবর্তন আনা জরুরী।” এ ব্যাপারে বিশেষজ্ঞ চিকিৎসকের পরামর্শের বিকল্প নেই । মিনেসোটা ।