বিশেষ প্রতিনিধি : চলমান স্নায়ুচাপে বিভক্ত বিশ্বে চীন ও রাশিয়ার সম্পর্ক দিন দিন গভীর হচ্ছে। ভারত আছে ব্যালেন্সে। ইউরোপের রণাঙ্গনে রাশিয়াকে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র প্রতিরোধ করছে ন্যাটো দিয়ে। আর এশিয়ায় চীনকে অ্যালায়েন্স দিয়ে রুখতে চায় যুক্তরাষ্ট্র। ক্রমশ মিয়ানমার ধেয়ে চলছে আরেকটি ভিয়েতনামের পথে। এসবের নির্যাস থেকে কেবল রক্ষা নয়, লাভবান হওয়ার নানা মন্ত্রে এগোচ্ছে বাংলাদেশ। দেখছে সম্ভাবনাও।
মানবাধিকার-সুশাসন-কর্তৃত্ববাদ নিয়ে বাজে অবস্থায় থাকা বাংলাদেশ তা উতরাতে চেষ্টা করছে সর্বসাধ্য দিয়ে। সুনির্দিষ্টভাবে বাংলাদেশ বেশি সমালোচিত ‘গুম’ নিয়ে। যেই মুহূর্তে জেনেভায় জাতিসংঘের গুমবিষয়ক ওয়ার্কিং গ্রুপের মিটিং চলছে, তখন গুমের মতো একটা সিরিয়াস বিষয়কে হালকা করার মতো সামনে এসেছে মরিয়ম মান্নানের মা রহিমার ঘটনা। মরিয়ম মান্নান বা তার আশপাশের কেউই দাবি করেননি, তাকে গুম করা হয়েছে। অথবা তার মাকে কোনো সংস্থা তুলে নিয়ে গেছে। সরকার বোঝানোর চেষ্টা করছে, অন্যান্য গুমের অভিযোগ এমন ধরনেরই। লুকিয়ে থেকে বা আত্মগোপনে গিয়ে ‘গুম’ অভিযোগ সাজানো হচ্ছে বলে সরকারের দিক থেকে দাবি করা হচ্ছে অনেক দিন থেকে। আঞ্চলিকভাবে সরকারের বেকায়দার ঘটনা রোহিঙ্গা ও সীমান্তে মিয়ানমারের উৎপাত। কায়দা করে এ থেকেও রক্ষার নানা পথ-মত ধরেছে সরকার। এখানে মূল ফ্যাক্টর চীন। পরিস্থিতি বুঝে চীনের সঙ্গে চিকন পথে এগোচ্ছে বাংলাদেশ। দেশটির কাছ থেকে কথা আদায় করেছে এ বিষয়ে অ্যাটেনশন দেওয়ার। গত মাস থেকে বান্দরবানের তমব্রু সীমান্তে কয়েক দফা গোলাবর্ষণ করে মিয়ানমার। এ নিয়ে দফায় দফায় দেশটির রাষ্ট্রদূতকে তলব করে পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়। এ ছাড়া বাংলাদেশে নিযুক্ত বিভিন্ন দেশের রাষ্ট্রদূতদের একত্রিত করে গেল সপ্তাহে আনুষ্ঠানিকভাবে এ ঘটনা সম্পর্কে অবহিত করা হয়েছে। ওই বৈঠকে যুক্তরাষ্ট্র, যুক্তরাজ্য, ভারতসহ প্রভাবশালী বিভিন্ন দেশের দূতাবাসের প্রতিনিধিরা থাকলেও ছিলেন না চীনা দূতাবাসের কেউই। বিভিন্নমুখী দূতিয়ালির জেরে সোমবার পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ে আসেন চীনা রাষ্ট্রদূত লি জিমিং। বসেন ভারপ্রাপ্ত পররাষ্ট্রসচিব খুরশিদ আলমের সঙ্গে।
মিয়ানমার থেকে জোরপূর্বক বাস্তুচ্যুত রোহিঙ্গা নাগরিকদের নিরাপদ প্রত্যাবাসনে চীনের সহযোগিতা চাওয়ার স্পষ্ট রেসপন্স এসেছে বৈঠকে। সীমান্তে চলমান অস্থিরতা কমিয়ে আনতে মিয়ানমারকে চীনের পক্ষ থেকে বার্তা দেওয়া হবে বলে জানিয়েছেন লি জিমিং। দুই দেশের সীমান্তে অস্থিরতাকে দুর্ভাগ্যজনক বলে উল্লেখ করেন তিনি। চীনের রাষ্ট্রদূতের এ আশ্বাস ও উপলব্ধিকে মূল্যবান মনে করছে বাংলাদেশ। সামরিক শক্তিতে শক্তিমান বা বর্তমান বিশ্বের অন্যতম সুপার পাওয়ার হলেও মিয়ানমারের ভেতরগত অবস্থা ভালো নয় উপলব্ধিতে এগোচ্ছে বাংলাদেশ। উপজাতিতে বিভক্ত মিয়ানমার। প্রশাসনিক ঝামেলাও ভেতরে ভেতরে চরমে। এ পরিস্থিতিতে রাজধানী নেপিট এবং আশপাশের শহরগুলোয় রাতে কারফিউ জারি করতে হচ্ছে। গৃহযুদ্ধের শঙ্কায় কারফিউর পাশাপাশি রাজধানীতে বাঙ্কার তৈরি করছে সামরিক বাহিনী। এ ছাড়া পুলিশের নতুন নতুন দল তৈরি করা হয়েছে। বিদ্রোহীরাও বসে নেই। তাদের মোকাবিলায় সরকারকে ঘন ঘন রণকৌশল বদলাতে হচ্ছে। এর প্রভাব এখন পড়তে শুরু করেছে প্রতিবেশী বাংলাদেশ ও ভারতে।
এদিকে মিয়ানমারের মুরব্বি চীনের ভেতরও অস্থিরতা যাচ্ছে। তবে দৃশ্যত নয়। শি জি পিংকে উৎখাতের নীরব তৎপরতা চলছে। সেনা অভ্যুত্থানে শি জি পিং গৃহবন্দী মর্মে গুজব রটেছে। অনলাইন পোর্টালগুলোতে এ নিয়ে অনেক হইচই হচ্ছে গত কদিন ধরে। এর পেছনে ভারতের প্রোপাগান্ডা মেশিনের সম্পৃক্ততা স্পষ্ট। বাংলাদেশ এর সুফলের জন্য অপেক্ষমাণ। মিয়ানমার থেকে হাজার হাজার শরণার্থী মিজোরামেও যাচ্ছে। কিন্তু এ নিয়ে উচ্চবাচ্য না করে ঝিম মেরে থাকার পথ ধরেছে ভারত। চলমান স্নায়ুযুদ্ধে রাশিয়া ব্যস্ত ইউক্রেন নিয়ে। আর এশিয়ায় চীন ও রাশিয়া ব্যস্ত মিয়ানমারকে নিয়ে। এর মাঝে লাভবান হওয়ার কৌশল খুঁজছে ভারতও। বসে নেই পাকিস্তানও। দেশটির প্রধানমন্ত্রী শেহবাজ শরিফ জাতিসংঘের ৭৭তম অধিবেশনে অংশগ্রহণকারী বিশ্বনেতাদের জন্য দেওয়া সংবর্ধনা অনুষ্ঠানে মার্কিন প্রেসিডেন্ট বাইডেনের সঙ্গে বিশেষ দেখা করেছেন। এটি পাকিস্তানের ধীরে ধীরে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে আগের সম্পর্ক ঝালাইয়ের অংশ। চলমান এই স্নায়ুযুদ্ধ বিশ্বাস-অবিশ্বাসের দ্বন্দ্ব বাড়ানোর পাশাপাশি পুরোনো মিত্রতাও তৈরি করছে। ‘শত্রুর শত্রু আমার বন্ধু’ তত্ত্বের সংস্কার আনছে। কুশাসন, দুঃশাসন, অপশাসন, দুর্নীতি, খুনখারাবি এবং একনায়কতন্ত্রের দেশগুলোর মধ্যে এ-সংক্রান্ত হিসাব-নিকাশ খুব বেশি। এসব কারণ ছাড়াও সেসব দেশে রুশ-ইউক্রেন যুদ্ধের আসর বেশি পড়েছে। কঠিন এ বাস্তবতায় উতরানোর আশায় এগোচ্ছে বাংলাদেশ। বিএনপি বা অন্য কারো পক্ষে শেখ হাসিনার মতো এ পরিস্থিতি সামলানো সম্ভব হতো না বলে জোর জনমত গড়ার চেষ্টায় অনেকটাই সফল সরকার।
স্নায়ুচাপ থেকে বাঁচার মন্ত্রে সরকার
পাল্টে যাচ্ছে শত্রু-বন্ধু : একের সম্ভাবনায় অন্যের শঙ্কা