স্পাই ইন দ্য স্কাই

বাহারুল আলম :

জানুয়ারি মাসের ২৮ থেকে ফেব্রুয়ারি মাসের ৪ তারিখ পর্যন্ত মার্কিন আকাশে সন্দেহভাজন চীনা স্পাই বেলুন আবির্ভাবের ঘটনা মিডিয়াসহ দেশের বিভিন্ন মহলে ব্যাপকভাবে আলোচিত-সমালোচিত হতে দেখা যায়। চীনের মতো বৈরী একটি পরাশক্তির প্রেরিত স্পাই বেলুন কিভাবে প্রায় গোটা এক সপ্তাহজুড়ে মার্কিন আকশে অবস্থান করে গোয়েন্দা তথ্য সংগ্রহের কার্যক্রম অনেকটা নির্বিঘ্নে চালিয়ে যেতে সক্ষম হলো, তা ভেবে অনেককেই উদ্বেগ ও বিস্ময় প্রকাশ করতে দেখা যায়।

২৮ জানুয়ারি দু-তিনটি বাসের সমান বড় একটি চীনা স্পাই বেলুন আলাস্কার আকাশে প্রবেশ করে। পরে ১ ফেব্রুয়ারি এটাকে মন্টানা রাজ্যের আকাশে উড়তে দেখা যায়। বহু মানুষ খালি চোখেও এটিকে দেখতে পান। প্রাপ্ত তথ্যে জানা যায়, মার্কিন সামরিক কর্মকর্তারা বেলুনটির মার্কিন আকাশসীমায় প্রবেশ সম্পর্কে অবহিত থাকলেও, এ বিষয়ে তাদের পক্ষ থেকে ৪ ফেব্রুয়ারির পূর্ব পর্যন্ত জনগণকে কিছুই জানানো হয়নি। অবশ্য প্রেসিডেন্ট জো বাইডেনকে বেলুনের বিষয়ে জানানো হলে, তিনি সেটিকে ধ্বংস করে দিতে তাদের নির্দেশ দেন।

প্রতিরক্ষামন্ত্রী লয়েড আস্টিন ও পেন্টাগনের শীর্ষ সামরিক কর্মকর্তা জেনারেল মিলি প্রেসিডেন্টকে জানান যে, এ মুহূর্তে এটাকে ধ্বংস করা হলে এর ধ্বংসাবশেষ মাটিতে পড়ে জানমালের ব্যাপক ক্ষয়ক্ষতির সম্ভাবনার কারণে তারা যথোপযুক্ত সময়ে ও স্থানে এটাকে ধ্বংস করতে চান। প্রেসিডেন্ট তাদের পরামর্শ মেনে নেন। সেই উপযুক্ত সময়টি আসে ৪ ফেব্রুয়ারি দুপুরের কিছু পর। বেলুনটি ইতোমধ্যে ক্যানসাস, মিজোরি রাজ্য অতিক্রম করে সাউথ ক্যারোলাইনার সার্ফ সাইড বিচ এলাকার আটলান্টিক মহাসাগরে মার্কিন সমুদ্রসীমায় অবস্থান করছিল। এ সময় মার্কিন বিমানবাহিনীর একটি যুদ্ধ বিমান থেকে একটি বিশেষ ধরনের মিসাইল দিয়ে বেলুনটিকে ধ্বংস করে দেয়া হয়। বেলুনের ধ্বংসাবশেষ সমুদ্রের পানিতে পতিত হয়। পরে মার্কিন নৌবাহিনীর একদল ডুবুরি সেগুলো উদ্ধার করে পরীক্ষার জন্য এফবিআইয়ের ল্যাবে পাঠায়।

ধারণা করা হচ্ছে, স্পাই বেলুনটিতে ক্যামেরাসহ সার্ভেল্যান্স কাজে ব্যবহৃত হয় এমন ধরনের নানা যন্ত্রপাতি ছিল।
মার্কিন আকাশে চীনা স্পাই বেলুনের উপস্থিতি পুরো সপ্তাহজুড়ে টিভি সংবাদের প্রধান আলোচনার বিষয় হয়ে দাঁড়ায়। চীনা স্পাই বেলুন যেসব রাজ্যের উপর দিয়ে উড়ে যায়, সেসব রাজ্যে মার্কিন প্রতিরক্ষাবাহিনীর বেশ কয়েকটি গুরুত্বপূর্ণ স্থাপনা অবস্থিত। যার মধ্যে মার্কিন ইন্টারকন্টিনেন্টাল ব্যালিস্টিক মিসাইল ও অত্যাধুনিক বি-২ বোমারু বিমানের ঘাঁটি রয়েছে। মার্কিন জাতীয় নিরাপত্তার ক্ষেত্রে এগুলো অত্যন্ত সংবেদনশীল হওয়ায় বেলুনটির কর্মপ্রক্রিয়া নিয়ে মার্কিন সামরিক-বেসামরিক ও রাজনৈতিক মহলে ব্যাপক চাঞ্চল্যেও সৃষ্টি হয়।

চীনের পক্ষ থেকে অবশ্য বেলুনটিকে স্পাই বেলুন না বলে এটাকে নিছক আবহাওয়া নিয়ে গবেষণায় নিয়োজিত একটি ওয়েদার বেলুন বলে দাবি করে বেলুনটি বাতাসের তোড়ে দুর্ঘটনাবশত গতিপথ ভুল করে মার্কিন আকাশে প্রবেশ করেছে বলে জানানো হয়। তাদের ভাষায় এটা নেহায়েত মামুলি একটা ঘটনা (he Ballon is not a big deal)। এ বিষয়ে মার্কিন প্রতিক্রিয়াকে বাড়াবাড়ি বলে বর্ণনা করা হয়।

মার্কিন আকাশে চীনা স্পাই বেলুনের উপস্থিতির কারণে এর নিন্দা ও প্রতিবাদ জানিয়ে মার্কিন পররাষ্ট্রমন্ত্রী টনি ব্লিংকেন তার ৪ ও ৫ ফেব্রুয়ারির নির্ধারিত বেজিং সফর বাতিল করেন। প্রেসিডেন্ট বাইডেন ও চীনের প্রেসিডেন্ট শি জিন পিং-এর মধ্যে একটি শীর্ষ বৈঠকের ক্ষেত্র প্রস্তুতের জন্য তার সে সফরে যাওয়ার কথা ছিল।

টনি ব্লিংকেন এ ঘটনাকে মার্কিন সার্বভৌমত্ব ও আন্তর্জাতিক আইনের সুস্পষ্ট লংঘন বলে উল্লেখ করেন।
প্রসঙ্গত উল্লেখ করা যেতে পারে যে, গোয়েন্দা তথ্য-উপাত্ত সংগ্রহের উৎসগুলোকে প্রধানত দুটি ক্যাটাগরিতে ভাগ করা হয়। একটি হলো প্রকাশ্য সূত্র বা Overt Source, যার মধ্যে পড়ে সংবাদপত্র, ম্যাগাজিন, সাময়িকী, রেডিও-টিভি, বইপত্র ইত্যাদি এবং অপরটি হলো গোপন সূত্র বা Covert Sources, যার মধ্যে পড়ে বাগিং (Bugging) বা আড়িপাতা, টেলিফোন টেপিং, স্যাটেলাইন, সার্ভেল্যান্স, ড্রোন, স্পাই প্লেন ও বেলুন, মানব সূত্র ইত্যাদি। এসব মাধ্যমে সংগৃহীত তথ্যসমূহ সাধারণত সামরিক, রাজনৈতিক ও কমার্শিয়াল বিষয়ক হয়ে থাকে।

১৯৬০ সালে চীনা স্পাই বেলুনের অনুরূপ একটি মার্কিন স্পাই প্লেন (U-2) গোয়েন্দা তথ্য সংগ্রহের জন্য পাকিস্তানের পেশোয়ার থেকে তদানীন্তন সোভিয়েত ইউনিয়নে পাঠানো হয়। মস্কোর আকাশে প্লেনটি আসলে সোভিয়েত মিলিটারি গুলি করে বিমানটিকে ভূপাতিত করে। প্লেনের পাইলট গ্যারি পাওয়ার্স ইজেক্ট করে প্যারাসুটের সাহায্যে অক্ষত অবস্থায় নিচে নেমে আসেন। প্রথমে মার্কিন কর্তৃপক্ষ প্লেনটিকে স্পাই প্লেন বলতে অস্বীকৃতি জানালেও পরে এটিকে স্পাই প্লেন বলে স্বীকার করে নেয়া হয় এবং ভবিষ্যতে সোভিয়েত আকাশে এ ধরনের কোনো ফ্লাইট করা হবে না বলে আশ্বাস দেয়া হয়। বিমানের পাইলট অবশ্য রুশ গোয়েন্দাদের কাছে তিনি সিআইএর হয়ে গোয়েন্দা তথ্য সংগ্রহের কথা স্বীকার করেন। গুপ্তচর বৃত্তির অভিযোগে রুশ আদালত তাকে ১০ বছরের কারাদণ্ড দেয়। পরে মার্কিন কারাগারে বন্দী জনৈক রুশ গুপ্তচরের মুক্তির বিনিময়ে তাকে মুক্তি দেয়া হয়।

এ ঘটনায় ১৯৬০ সালের ১৭ মে প্যারিস অনুষ্ঠেয় মার্কিন প্রেসিডেন্ট আইজেন হাওয়ার ও সোভিয়েত নেতা নিকিতা ক্রুশ্চেভের মধ্যকার শীর্ষ বৈঠক পন্ড হয়ে যায়। তাছাড়া জুন মাসে আইজেন হাওয়ারের প্রস্তাবিত মস্কো সফরও বাতিল করা হয়।

মার্কিন আকাশে চীনা স্পাই বেলুন ধ্বংসে বাইডেনের ভূমিকায় বাইডেন-বিরোধী ও রিপাবলিকান মহল ব্যাপক অসন্তোষ ব্যক্ত করে বাইডেন বেলুন ধ্বংসে বিলম্বের মাধ্যমে জাতীয় নিরাপত্তাকে হুমকির মুখে ফেলেন বলে অভিযোগ করেন।
তাদের মতে, মার্কিন আকশে প্রবেশ মাত্রই বেলুনটিকে ধ্বংস করা উচিৎ ছিল।

বেলুন থেকে মার্কিন ভূমিতে বোমা না ফেলা হলেও চীনারা এই বেলুনের সাহায্যে বহু মার্কিন কৌশলগত তথ্য-উপাত্ত হস্তগত করতে সক্ষম হয়েছে বলে মনে করা হচ্ছে। চীনা স্পাই বেলুনের মার্কিন আকাশে অনুপ্রবেশের ঘটনা মার্কিন গোয়েন্দা তথ্য সংগ্রহে তাদের অসীমা আগ্রহের প্রমাণ দেয়। এই অসীম আগ্রহ নিবৃত্ত করতে তারা ভবিষ্যতে এ ধরনের ঘটনার পুনরাবৃত্তি করবে না, সেটা হলফ করে বলা যায় না। সে কারণে এটাকে একটি Wakeup call হিসেবে ধরে নিয়ে এ ধরনের ঘটনা প্রতিরোধে পূর্ব থেকেই প্রয়োজনীয় সতকর্তামূলক ব্যবস্থা গ্রহণ জরুরি বলে অভিজ্ঞ মহল মনে করেন।

লেখক : কলামিস্ট।