স্বাগতম ২০২৩, পৃথিবী হয়ে উঠুক শান্তিময়

এবিএম সালেহ উদ্দীন :

বিপুল আকাক্সক্ষা, স্বপ্নময় উচ্ছ্বাস, অপরিমেয় প্রত্যাশার দোলাচলে হর্ষবিষাদ ঘটনাবলি আর সাফল্য-ব্যর্থতার মধ্য দিয়ে কালের গর্ভে হারিয়ে যাচ্ছে ২০২২ সাল। সময় কারো জন্য অপেক্ষা করে না। এই সময়ের মধ্যে পৃথিবীর কত পালাবদল ঘটে গেল। কত পরিবর্তন হলো। কতজন আবির্ভূত হলো। একইভাবে কত মানুষ চিরকালের তরে হারিয়ে গেল। এই প্রাপ্তি আর অপ্রাপ্তির মধ্যেই আগামীকে অর্থাৎ বিপুল উৎসাহ-উদ্দীপনায় স্বাগত জানানো হবে ২০২৩ সাল। নতুন বছরকে বরণ করে নেওয়ার জন্য মেতে উঠবে পৃথিবীর মানুষ। আনন্দ-উল্লাসে মাতোয়ারা হবে। স্বাভাবিক নিয়মে চলবে আগামী পৃথিবী।
কিন্তু এই আনন্দ-উল্লাসের পাশাপাশি কত স্বপ্ন ও সম্ভাবনা এবং সাফল্য-ব্যর্থতায় কেটে গেছে বিগত দিনগুলো। পৃথিবীর কত মানুষ হারিয়ে গেল। সমগ্র পৃথিবীর স্বজনহারার আর্তনাদ, দুঃখ-কষ্ট, বেদনার যন্ত্রণায়ও কেঁদে বুক ভাসিয়েছে পৃথিবী ও তার মানুষ। এখানে তবু উল্লেখ করতে হয়, আসলে পৃথিবী খুব সুন্দর। সুন্দরের অপরূপ বৈচিত্র্যের মধ্যেই জীবনের তৃপ্তি ও সার্থকতা। এই পৃথিবী ও প্রকৃতির পরিবেশ কত মনোরম, মোহময় ও মায়াময়।

যারা শুধু বল্গাহীন উল্লাস কিংবা বিপুল আনন্দে মাতোয়ারা হয়ে ওইসব মৃত্যু ও স্বজনহারার কথা ভাবে না (!), তাদের জন্য পৃথিবীর একটা নীরব কান্নাধ্বনি আছে। যারা নিরন্ন মানুষের কথা মনে রাখে না, অন্যায়ভাবে অমানবিক অত্যাচার ও নিপীড়ন চালিয়ে সাধারণ মানুষকে হত্যা করে, শুধু নিজের স্বার্থটাই দেখে, তাদের জন্য পৃথিবীর কান্নার সঙ্গে অভিশাপও বর্ষিত হয়।

মানুষের রাশি রাশি স্বপ্ন, উচ্ছ্বাস ও আকাক্সক্ষা থাকে। কিন্তু সব আশা পূরণ হয় না। আমরা এই বিষয়টি নিয়ে অনেকেই ভাবি না যে, একদিন সময় ফুরিয়ে যাবে। সবকিছু পড়ে থাকবে। সহসা কোনো একদিন আমিও চলে যাব অনন্তের পথে অন্য এক অজানায়। আমাদের ভাবনাবৃত্তিতে সেই কঠিন সত্যটি কতটুকু উপলব্ধ হয়?

এখানে দেখা যাক, আমরা কীভাবে কাটালাম গত বছরটি! কী পেলাম। কী পরিমাণ মানবসম্পদ হারালাম। এক বছর পূর্বে কত স্বপ্ন, কত আশার দোলাচলে আমরা মেতে ছিলাম। আশা-নিরাশার ঘূর্ণিপাকে প্রত্যেকের জীবনে কতটুকু তা পূরণ হয়েছে। হ্যাঁ! যাদের অনেক হয়েছে, তাদের জন্য আনন্দ আছে, পরিতৃপ্তি আছে। কিন্তু যাদের জীবনের আশা পূর্ণ হয়নি, তাদের জীবনে নেমে এসেছে দুঃখ, কষ্ট, শোক ও বেদনা। এভাবেই চরম হতাশা, বেদনা-বিষাদ, সংকট আর বঞ্চনার মধ্য দিয়ে কেটে গেল পুরো বছরটি। রাষ্ট্রপুঞ্জের বৈষম্য, শোষণ, নিপীড়ন বিশ্বের অনেক দেশে ছিল। মানবাধিকার লঙ্ঘন, শ্রেণিবৈষম্য, মানবতা-বিবর্জিত কাজ বিশ্বের সুপিরিয়র রাষ্ট্রপুঞ্জ থেকে শুরু করে স্বল্পোন্নত দেশ এবং সর্বব্যাপী নৈতিক অবক্ষয়ের চরম পর্যায়ে উপনীত হয়েও যেখানে প্রাপ্তির চেয়ে অপ্রাপ্তির আধিক্য, স্বস্তির পরিবর্তে ছিল একধরনের অস্বস্তিকর পরিবেশ। নির্মম হত্যাযজ্ঞ, যুদ্ধবিগ্রহের ভয়াবহতা, মারামারি, হানাহানি ও নৃশংসতায় কেটেছে। ঘটেছে অনেক দেশের নাগরিক জীবনের চরম নাভিশ্বাস।

এ ছাড়া বিশ্বব্যাপী ভারসাম্যহীন পরিবেশ ও প্রাকৃতিক দুর্যোগে অসংখ্য মানুষের ঘটেছে অকালমৃত্যু। যদিও কোথাও কোথাও গণমানুষের অধিকার প্রতিষ্ঠা, স্বাধীনতাসংগ্রাম আর স্বৈরাচারী শাসকের ক্ষমতার উগ্রায়ণ ছিল লক্ষণীয়। বিশ্বের বিভিন্ন দেশে নির্যাতন, নিপীড়ন আর নির্মম হত্যাকাণ্ডে অগণিত মানুষের প্রাণহানি ঘটেছে।

সমগ্র বিশ্বের সামাজিক, রাজনৈতিক অবক্ষয়, কর্মহীন মানুষের বেকারত্ব আর চরম অর্থনৈতিক বিপর্যয়ের নাভিশ্বাস ঘটেছে পৃথিবীময়। এ ছাড়া রাষ্ট্রতান্ত্রিক বঞ্চনা, শোষণ, নিপীড়ন এবং স্বৈরতান্ত্রিক ব্যবস্থাধীনে ক্ষমতার অপব্যবহার পৃথিবীর কোনো কোনো দেশে বহাল ছিল আগের মতোই।
তবে হানাহানি কিংবা মানববিধ্বংসের মধ্যেও পৃথিবীর কিছু কিছু দেশে রাজনৈতিক, রাষ্ট্রীয় পটপরিবর্তনসহ মানবিক ও সামাজিক উন্নয়ন ঘটেছে। মানুষের মাঝে সুখ-শান্তির ছোঁয়াও ছিল। আর তা-ই হচ্ছে মানুষের আগামী দিনের আশার আলো।

সকল ধ্বংসযজ্ঞকে হার মানিয়ে ২০২২ সালের মানববিধ্বংসের সবকিছুকে ডিঙিয়ে এক ভয়ংকর মারণব্যাধির ধকল না সইতেই আরও কত রকমের মহামারির নতুন প্রাদুর্ভাব দেখা গেছে। উৎকণ্ঠা ও ভয়ভীতির মধ্য দিয়ে সমগ্র পৃথিবী অচল ও স্থবিরতা কাটিয়ে ওঠার চেষ্টা করছে। মানুষের জীবন সংহারকারী এই ভয়াবহ পরিস্থিতির মূলে যে ভাইরাসটি (মহামারি) সমগ্র বিশ্বময় ছড়িয়েছে, যার নাম করোনাভাইরাস। এই করোনাভাইরাসের পোশাকি নাম কোভিড-১৯।
এই ভয়ংকর ভাইরাসের উৎপত্তি নিয়ে রয়েছে দ্বিমত। এখনো গবেষণা চলছে। প্রাথমিক তথ্য অনুপাতে প্রথমে ১৯৬০ সালের দিকে মুরগি থেকে এলেও বর্তমানে এটি এসেছে একধরনের সাপের কাছ থেকে। চীনের মানুষ সাপসহ এমন আকৃতির নানা ধরনের প্রাণী খায়। অনেকের ধারণা, সেখান থেকেই তার উৎপত্তি। কিন্তু কথা হলো, কেন চীনের একটি মাত্র শহর থেকে বর্তমানে তা এত দ্রুত বিশ্বব্যাপী ছড়িয়ে গিয়ে সমগ্র মানবতাকে কীভাবে গ্রাস করল? এটা কি শুধু রোগ নাকি আকাশ থেকে নেমে আসা প্রকৃতির কোনো ধ্বংসলীলা! তা নিয়েও রয়েছে নানাবিধ প্রশ্ন ও ধূম্রজাল।

ইতিহাসে মানবজাতির আবির্ভাবের সাথে রোগবালাইসহ অসংখ্য রকমের ভাইরাসের (মহামারি) দৃষ্টান্ত আছে। যুগে যুগে শতাব্দীকালে অনেক বড় ধরনের মহামারি মরণব্যাধি ভাইরাসের প্রাদুর্ভাব ঘটেছে। কিন্তু এবারের ভাইসারটির সংক্রমণ-প্রক্রিয়া সম্পূর্ণ ভিন্ন এবং তার ভয়ংকর রূপ সম্পূর্ণ আলাদা। ফলে চারদিকে আতঙ্ক! পৃথিবী অস্থির ও অশান্ত। কোথায় গিয়ে থামবে (?) এখনো কেউ বলতে পারছে না। এ জন্য ধরণিকুলের মানবালোকে নেমে এসেছে অন্ধকারের কালো ছায়া। মানববিধ্বংসী মারণব্যাধি করোনাভাইরাস বিপজ্জনকভাবে দ্রুত ছড়িয়ে পড়েছে বিশ্বময়। মানুষের ভয়জড়িত জীবন হয়ে উঠছে ভীতিকর ও আতঙ্কময়! নাগরিক জীবন থেকে শুরু করে পৃথিবীর সকল রাষ্ট্রপুঞ্জে বয়ে যাচ্ছে এক অনাকাক্সিক্ষত আতঙ্ক! কীভাবে এই রোগের নিরাময় হবে, কী হবে পরিত্রাণের উপায়, তা নিয়ে পৃথিবীর বড় বড় চিকিৎসক ও বিজ্ঞানীরা উৎকণ্ঠিত ও গবেষণারত। সমগ্র বিশ্বের বিভিন্ন শহর-বন্দর, গ্রামাঞ্চল, আকাশপথ, নৌযান, রাষ্ট্রীয় ভবন থেকে শুরু করে সুরক্ষিত রাজপ্রাসাদেও এই ভয়ংকর ভাইরাসটি আঘাত করে বসেছে। প্রতিনিয়ত অসংখ্য মানুষ অকালে মৃত্যুর কোলে পড়েছিল। স্বজনহারার আর্তনাদে চতুর্দিকে বয়েছিল মহা আতঙ্ক ও হাহাকার।

তবে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রসহ সমগ্র বিশ্বে দ্রুত ভ্যাকসিন আবিষ্কারের মাধ্যমে এবং মহান স্রষ্টার কৃপায় পৃথিবী আবার ঘুরে দাঁড়িয়েছে। সেটি আমাদের জন্য আশার আলো। পৃথিবীর মানুষের জন্য এসব ভ্যাকসিন এবং ইত্যাকার চিকিৎসাব্যবস্থা হোক স্বস্তিকর ও নিরাময়ের প্রধান অবলম্বন। আমাদের প্রত্যাশা, এই মহা আতঙ্কময় করোনাভাইরাস এবং অন্যান্য সকল বিপদ থেকে পৃথিবীর মানুষকে মহামহিম আল্লাহ রক্ষা করবেন।

২০২২ সালের সাফল্যের সাথে ব্যর্থতার গ্লানি, রাজনৈতিক হানাহানি, রাষ্ট্রীয় সন্ত্রাস, পাশবিকতা, নির্যাতন, অত্যাচারসহ মানবিকতার বিপর্যয় ঘটেছে পৃথিবীর কোনো কোনো অঞ্চলে। সবচেয়ে বেদনাদায়ক কষ্টের বিষয়টি হচ্ছে ভয়ংকর করোনাভাইরাসের মধ্যেও রাষ্ট্রক্ষমতায় চেপে থাকা স্বৈরশাসনের উন্মত্ততায় বিভিন্ন দেশে বহু নিরীহ মানুষের প্রাণহানি ঘটেছে। মানবাধিকার লঙ্ঘিত হয়েছে। রাশিয়া ইউক্রেন রাষ্ট্রটির ওপর আগ্রাসন চালিয়ে দেশটির প্রচুর ক্ষতিসাধন করেছে। বহু লোকের প্রাণহানি ও বিপুল ধ্বংসাবশেষ ঘটানো হয়েছে। যার জের হিসেবে সমগ্র বিশ্বে চরম অর্থনৈতিক মন্দাভাব ও চরম সংকট বৃদ্ধি পেয়েছে। বিশ্বব্যাপী করোনাভাইরাসের স্থবিরতার মধ্যেও উন্মত্ত যুদ্ধবাজ রাশিয়া যে একটি নিয়মতান্ত্রিক রাষ্ট্রব্যবস্থার স্বাধীন দেশকে ধ্বংস করে দিল (!), তার কোনো বিচার হয়নি। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র (বাইডেন প্রশাসন) দেশটির সাহায্যার্থে বিপুল পরিমাণ অর্থ প্রেরণ করেছে। আমেরিকা অনেক রাজনৈতিক প্রতিবন্ধকতার মধ্যেও যুদ্ধবিধ্বস্ত ইউক্রেনের পাশে দাঁড়িয়েছে।

অথচ ইতিহাসের কী নির্মম পরিহাস, মধ্যপ্রাচ্যের সবচেয়ে ঝঞ্ঝা-বিক্ষুব্ধ অবরুদ্ধ ও অশান্ত ভূখণ্ড অসহায় ফিলিস্তিন রাষ্ট্রটিকে ইসরাইল আগ্রাসন চালিয়ে যুগের পর যুগ গ্রাস করে নিল। কোনো প্রতিকার করা হলো না। ১৯৪৮ সালের পূর্ব থেকে ইসরাইল ফিলিস্তিনের ভূখণ্ডে আগ্রাসন চালিয়ে বসে থাকেনি। রাশিয়া ও ইউরোপ থেকে ইহুদিদের এনে ফিলিস্তিনে বসতি করার সুযোগ করে দিয়েছে এবং এখনো তা ভয়ংকরভাবে চলমান রয়েছে।
ফিলিস্তিন ও আরব বিশ্বের মতো অনেক রাষ্ট্রতান্ত্রিক দেশে মানববিধ্বংসী পাশব হত্যাযজ্ঞ ও ধ্বংসলীলার ঘটনা ঘটেছে। মধ্য এশিয়ার আজারবাইজান ও আর্মেনিয়ার যুদ্ধ, সেন্ট্রাল আফ্রিকা, ইথিওপিয়াসহ আফ্রিকার কয়েকটি দেশে নির্মম হত্যাযজ্ঞ ঘটেছে।

বিশ্বের ঘটনাবলির সাথে, বিশ্ব পাশবিকতার সাথে আরও কিছু নতুন মাত্রা যোগ হয়েছে। সিরিয়া, মিসর, সুদান, তিউনিসিয়া, উত্তর কোরিয়া, চীন, মিয়ানমারসহ বিক্ষুব্ধ কয়েকটি দেশের স্বৈরতন্ত্রের সাথে আরও ভয়ংকরভাবে যুক্ত হয়েছে সৌদি আরব। সৌদি রাজতান্ত্রিক সকল বৈষম্যের নীতিকে লঙ্ঘন করে বাদশাহ সালমান কর্তৃক স্বীয় পুত্রকে ক্রাউন প্রিন্স বানিয়ে সৌদির পরবর্তী বাদশাহ হওয়ার বাসনা পূর্ণ করার পথকে প্রশস্ত করা অন্যতম। রাষ্ট্রের সামরিক বাহিনীর দায়িত্বসহ অন্যান্য ক্ষেত্রে পুত্র মুহাম্মদ বিন সালমান ইতিপূর্বে তার একক ক্ষমতাবলে ইয়েমেনকে ধ্বংস করে দিয়েছে। ইসরাইলের সাথে বন্ধুত্ব গড়ে তুলেছে। ইসরাইলি অত্যাধুনিক বোমারু বিমান গোলার মাধ্যমে নারী, শিশুসহ ইয়েমেনের অসংখ্য মানুষকে নৃশংসভাবে হত্যা করা হয়েছে। ইয়েমেনের রাষ্ট্রব্যবস্থা ধ্বংস করে দেওয়া হয়েছে। এই সালমান-পুত্রের নির্দেশনায় সবচেয়ে নিষ্ঠুরতম হত্যাকাণ্ড ঘটানো হয়েছে। দুই বছর আগে তুরস্কের নিজ দূতাবাসের অভ্যন্তরে সৌদি বংশোদ্ভূত আমেরিকার শীর্ষ সাংবাদিক ও কলামিস্ট জামাল খাসুগিকে নৃশংসভাবে হত্যা করা হয়েছিল। যেখানে পৃথিবীর রাষ্ট্রপুঞ্জের সবচেয়ে নিরাপদ আশ্রয়স্থল যেকোনো রাষ্ট্রের দূতাবাস। সেখানে সৌদি সরকারের নিষ্ঠুরতার মধ্য দিয়ে ওই নিয়ম ভেঙে চুরমার হয়ে গিয়েছিল।
ইতিপূর্বেকার অন্য একটি প্রবন্ধে উল্লেখ করেছি, সমগ্র বিশ্ব এমনকি মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র পর্যন্ত রাষ্ট্রীয়ভাবে ধিক্কার, ঘৃণা ও নিন্দা জানিয়ে এই বর্বরতার সুষ্ঠু তদন্তের জন্য সৌদিকে চাপ দিয়েছে এবং বাদশাহ-পুত্রকে সরাসরি দায়ী করেছে। সর্বশেষ আমেরিকার সিনেট ও হাউস ঘোষণা দিয়েছে, সোদি ক্রাউন প্রিন্সই সেই নিষ্ঠুর হত্যাকাণ্ডের জন্য দায়ী।

এর চাইতেও বেশি বিপজ্জনক ঘটনা ছিল, বহু বিতর্কিত সাবেক প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প ফিলিস্তিনের ঐতিহ্যবাহী শহর পবিত্র জেরুজালেমকে ইসরাইলের রাজধানী ঘোষণা দিয়ে এসেছেন। তার সেই ঘোষণায় বিশ্ববাসী হতবাক হলেও তা এখনো একই অবস্থায়। কোভিড-১৯ আক্রান্ত প্যান্ডামিকের সময় ২০২০ সালে ইসরাইল কর্তৃক ফিলিস্তিনের আরো কয়েকটি গ্রাম দখল করে নেওয়া হয়েছিল। সেই আগ্রাসন এখনো বর্তমান রয়েছে।
২০২২ সালে উপসাগরীয় দেশ আরব আমিরাত/দুবাইয়ের সঙ্গে ইসরাইলের রাজনৈতিক বন্ধুত্ব ও বাণিজ্যিক সম্পর্ক স্থাপন এবং সেটি আরও বেগবান হয়েছে। সেই চুক্তির পক্ষে-বিপক্ষে মুসলিম বিশ্ব এবং অন্যান্য দেশ প্রতিক্রিয়া ব্যক্ত করলেও পরিশেষে সেটিই টিকে গেছে।
আগের বছরগুলোর মতো ২০২২ সালের শেষের দিকে অত্যন্ত বেদনাদায়কভাবে বাংলাদেশে চলেছে রাজনৈতিক নিপীড়ন ও বিচার-বহির্ভূত হত্যাকাণ্ড। ধর্ষণের মাত্রার পরিবৃদ্ধি ঘটেছে। দুর্নীতির লাগামহীন দৌরাত্ম্যে দুর্নীতিবাজের কয়েকজন রাঘব বোয়ালকে ধরা হয়েছে। ধর্ষক, সন্ত্রাসী এবং পাকড়াওকৃত সেই সব ভয়ংকর অপরাধীর বিচার কেমন হবে, তা সরকার ও সময়ের ওপর ছেড়ে দেওয়া ছাড়া কোনো মন্তব্য নেই। কিন্তু ২০২২ সালের শেষ দিকে বাংলাদেশের রাজনীতির মাঠ যেভাবে উত্তপ্ত হয়ে উঠছে, আগামী বছরটি নিয়ে অনেকের মনে বিপুল শঙ্কা দেখা দিয়েছে। রাষ্ট্রপুঞ্জের ক্ষমতাসীন দল এবং ক্ষমতার বাইরের বিরোধী রাজনৈতিক দলসমূহের মধ্যে সংঘাতের অশনিসংকেত নিয়েও সবাই উদ্বিগ্ন ও উৎকণ্ঠিত।
তবে প্যান্ডামিকের মধ্যে আমাদের শিল্প ও সাহিত্যাঙ্গনের বেশ কয়েকজন স্বনামধন্য ব্যক্তিত্ব, শিক্ষক, রাজনীতিক ও বুদ্ধিজীবীকে হারিয়েছি। বাংলাদেশ ও বহির্বিশ্বের অকালপ্রয়াত সকল মানুষের আত্মার শান্তি কামনা করছি।
পৃথিবীতে ভয়ংকর করোনাভাইরাসের ধকল কাটতে না কাটতেই বিভিন্ন দেশের মানুষের ওপর নির্দয় আচরণ ও নির্বিচার ধ্বংসযজ্ঞ ক্রমাগত শঙ্কা ও উৎকণ্ঠাকেই বাড়িয়ে দিয়েছে।

এরই মধ্যে ২০২২ সালে বিশ্বের সবচেয়ে আলোড়ন সৃষ্টিকারী মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের মধ্যবর্তী নির্বাচন হয়ে গেল। এবারের নির্বাচনে ডেমোক্র্যাটরা হাউসের সংখ্যাগরিষ্ঠতা হারিয়েছে। তবে কোনো কোনো রাজ্যে রিপাবলিকানদের ভরাডুবি হয়েছে। নিউইয়র্ক স্টেটের ইতিহাসে এবারের নির্বাচনে ডেমোক্র্যাট থেকে একজন নারী গভর্নর বিপুল ভোটে নির্বাচিত হয়েছেন। একইভাবে ডেমোক্র্যাট থেকে একজন কৃষ্ণাঙ্গ (এরিক অ্যাডামস) নিউইয়র্ক সিটির মেয়র হিসেবে বিপুল ভোটে নির্বাচিত হয়েছেন এবং ইতিহাস সৃষ্টি করেছেন।

তবে আমেরিকার ইতিহাসে যেমন সর্বাধিক সংখ্যক ভোট পেয়ে জো বাইডেন প্রেসিডেন্ট নির্বাচিত হয়ে বিশ্ব রেকর্ড করেছেন, তেমনি তার সময়ে নানা দিক দিয়ে অর্থনৈতিক ভারসাম্য বিঘ্নিত হচ্ছে। অন্যদিকে প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প তার স্বভাবসুলভ নিকৃষ্টমানের মন্তব্য, অর্বাচীন উক্তি ও লম্পঝম্প চালিয়ে আগামী প্রেসিডেন্ট নির্বাচনে নিজের প্রার্থিতার কথা ঘোষণা করলেও তার বিরুদ্ধে অসংখ্য অভিযোগপূর্ণ মামলায় শেষ পর্যন্ত কী হয়, তা বলা মুশকিল। আইনি মারপ্যাঁচ না ঘটলে তিনি বেশ কয়েকটি সুনির্দিষ্ট অপরাধের জন্য প্রেসিডেন্ট নির্বাচনে অযোগ্য ঘোষিত হতে পারেন বলে বিশেষজ্ঞদের ধারণা।
পৃথিবীর অন্য সকল দেশের নির্বাচন-ব্যবস্থাপনার চেয়ে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের নির্বাচন-পদ্ধতির বিশ্বব্যাপী সুনাম রয়েছে। সেই আশাবোধকে সামনে রেখে বলা যায়, আগামীতেও যুক্তরাষ্ট্রের নির্বাচন-সংক্রান্ত ঐতিহ্য সমুন্নত থাকবে।

তবু ডোনাল্ড ট্রাম্পই প্রথম ব্যক্তি, যিনি যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট থাকা অবস্থায় এক কলঙ্কজনক অধ্যায়ের সূচনা করে বিদায় নিয়েছিলেন! যদি তিনি পুনরায় রাষ্ট্রক্ষমতায় আসেন (যার শাসনামলের বিগত চার বছরের কর্মকাণ্ড নিয়েও বিশ্বে রয়েছে নানা প্রশ্ন ও বিতর্ক), তখন পরিস্থিতি কোন দিকে গড়াবে, তা বলা মুশকিল। আগামী নির্বাচন এবং আসন্ন বছরগুলো কেমন হবে, তা সময়ের ওপর ছেড়ে দেওয়া ছাড়া এখনই নিশ্চিতভাবে কোনো ভবিষ্যদ্বাণী বলে দেওয়া যায় না।

তবে ডোনাল্ড ট্রাম্প কর্তৃক মানবতাবিবর্জিত ঝুলে থাকা মেক্সিকান সীমান্তের ৫ বিলিয়নের বর্ডারওয়াল বিল, ইমিগ্রেশন-সংক্রান্ত অমানবিক ব্যবস্থা মেক্সিকোসহ লাতিন আমেরিকান দেশসমূহের বর্ডারের (সীমান্ত) ওয়াল (প্রাচীর) নির্মাণ করা, ১১ মিলিয়ন অবৈধ নাগরিককে বৈধতা দেওয়া, নিষিদ্ধঘোষিত দেশসমূহের ওপর থেকে নিষেধাজ্ঞা তুলে নেওয়া, কোভিডে আক্রান্ত মানুষদের রক্ষা, সর্বব্যাপী সমগ্র দেশের বেকারত্ব দূরীকরণ এবং যুক্তরাষ্ট্রের অর্থনীতিকে গতিশীল ও চাঙা করে তোলাসহ অনেক গুরুত্বপূর্ণ কাজ প্রেসিডেন্ট বাইডেন এবং তার সরকারকে মহাপরীক্ষার মধ্য দিয়েই এগোতে হচ্ছে। বিশেষজ্ঞদের মতে, প্রেসিডেন্ট বাইডেন যেমন কোভিড-১৯-কে কঠোরভাবে শক্ত হাতে মোকাবিলা করে দেশবাসীর জান-মালের স্বার্থে এগিয়ে এসেছেন, ধারণা করা হচ্ছে, তেমনি তিনি যুক্তরাষ্ট্রের অর্থনৈতিক মন্দাভাবও কাটিয়ে উঠতে পারবেন।
দক্ষিণ এশিয়ার অশান্ত দেশ আফগানিস্তান, পাকিস্তান, ভারত, কাশ্মীর ছাড়াও মিয়ানমারের মানবতাবিরোধী স্বৈর শাসনের উৎপাত এখনো বহাল আছে। দেশের প্রাচীন বাসিন্দা রোহিঙ্গা মুসলমানদের ওপর অত্যাচারের মধ্য দিয়ে বর্তমানে বাংলাদেশে আশ্রয় নেওয়া লাখ লাখ রোহিঙ্গা মুসলমান নারী-শিশুর করুণ অবস্থার এখনো কোনো সমাধান হয়নি। সিরিয়ার লাখ লাখ উদ্বাস্তু যেমন তুরস্কের সীমান্তে মানবেতর জীবনযাপন করছে, বর্তমানে ইথিওপিয়ার লক্ষাধিক উদ্বাস্তু সুদান ও অন্যান্য দেশে আশ্রয় নিচ্ছে। এগুলো সভ্য জগতের বেদনাদায়ক স্থায়ী এক অন্তহীন বিষাদ।
কবিগুরু রবীন্দ্রনাথ বলেছেন, ‘হিংসায় উন্মত্ত পৃথ্বি/ নিত্য নিষ্ঠুর দ্বন্দ্ব, ঘোর কুটিল পন্থ তার/ লোভ জটিল রন্ধ।’
ভোগ-বিলাস, লোভ-লালসা, মানববিধ্বংস আর হিংসার রাজত্ব চালানোর উগ্র উল্লাসে সবচেয়ে নিষ্ঠুরতম কর্মকাণ্ড, অসভ্যতা, বর্বরতা ও পাশবিকতা চলে আসছে। আগামী বছরসমূহে আর যেন তার পরিবৃদ্ধি না ঘটে, তা-ই আমাদের কাম্য।
মানুষকে ভালোবাসার মধ্য দিয়ে, মানুষের মঙ্গল কামনা এবং মানুষের কল্যাণবোধের মধ্য দিয়েই শ্রেষ্ঠত্ব অর্জন করা সম্ভব। মানুষকে অগ্রাহ্য এবং মানববিধ্বংসের মধ্য দিয়ে কখনো শ্রেষ্ঠ হওয়া যায় না। অসাম্প্রদায়িক ও মানবতার কবি, বিদ্রোহী কবি কাজী নজরুল ইসলাম বলেছেন :
‘গাহি সাম্যের গান-
যেখানে আসিয়া এক হয়ে গেছে সব বাধা ব্যবধান,
যেখানে মিশেছে হিন্দু-বৌদ্ধ মুসলিম-ক্রীশ্চান।’

বিশ্বকাঁপানো করোনাভাইরাসের কবল থেকে এবং যুদ্ধবিগ্রহ থেকে মানুষকে রক্ষাকল্পে মহান আল্লাহর নিকট আমাদের সম্মিলিত প্রার্থনা। আল্লাহ পাক পৃথিবীর সকল মানুষকে রক্ষা করুন। আমরা সবাই যেন এই মহা বিপদের দিনে ধৈর্য ও শক্তি নিয়ে সুস্থ ও সবল হয়ে উঠি।
আমাদের সবাইকে মনে রাখা উচিত, এই কোলাহলমুখর সুন্দর পৃথিবী, এই সবুজ প্রান্তর, এই নদী-সমুদ্র, প্রকৃতির নিদাঘ শোভা, সুনীল আকাশ, নক্ষত্র-নীহারিকা অপরূপ সৌন্দর্যের পৃথিবী থাকবে। কিন্তু আমাদের অনেকেই থাকব না। একদিন অনন্তের অতলস্পর্শ আমাদের সবাইকে টেনে নিয়ে যাবে। আমরা চাইলেও থাকতে পারব না। কিন্তু নিয়মতান্ত্রিক সুশৃঙ্খল জীবনের মধ্য দিয়ে পৃথিবীকে নির্মল ভালোবাসা ও শান্তির আবাসস্থলে পরিণত করার জন্য মানুষকেই এগিয়ে আসতে হবে। মানবতার মাঝে প্রেম-প্রীতি ও মমত্ববোধকে ছড়িয়ে দিতে হবে। হিংসা আর পাশবিকতা মানবতার শত্রু। এ মুহূর্তে এইচ জি ওয়েলেসের একটি উক্তি মনে পড়ছে : ‘হিংসা করো না। কারণ, হিংসা তোমাকে ধ্বংসের শেষ ধাপে নিয়ে যাবে।’ ২০২২ সালের শেষ দিকে বিশ্বব্যাপী সবচেয়ে বড় চমক কাতারে সদ্য অনুষ্ঠিত আলোড়ন সৃষ্টিকারী বিশ্বকাপ। অনেক শঙ্কা ছিল কাতারে বিশ্বকাপ হতে পারবে কি না। এই স্থান নির্বাচন করার পর ফিফা প্রেসিডেন্টকে অনেক প্রতিবন্ধকতার সম্মুখীন হতে হয়েছে। শেষ পর্যন্ত তিনিই জিতেছেন।

বলা বাহুল্য, বিশ্বকাপের ইতিহাসে কোনো মুসলিম দেশ এবং আরব বিশ্বে বিশ্বকাপ পৃথিবীতে পালাবদলের নতুন মাত্রা যোগ করেছে। সমগ্র বিশ্বময় শান্তি ও স্বস্তির সুবাতাস হিসেবে এটা এক শুভ লক্ষণ।

আমরা চাই, এবারের বিশ্বকাপের মতো সকল প্রকার বৈষম্য ও প্রতিবন্ধকতা উতরে সমগ্র পৃথিবীতে যুদ্ধহীন সমাজ ও শান্তি-স্বস্তি ফিরে আসুক।
এই সুন্দর পৃথিবী যেন মানুষের জন্য কল্যাণকর, শান্তিময় হয়ে ওঠে। পৃথিবী যেন হয়ে ওঠে নির্মল, আরও সুন্দর। বিশ্বব্যাপী করোনাভাইরাসের ভয়ংকর বিপদ থেকে বিশ্ব মানবতা যেমন আপাতত রক্ষা পেয়েছে, তেমনি সকল সংকট উতরে নিঃসীম অন্ধকার থেকে পৃথিবী ও প্রকৃতি আবার আলোকিত হয়ে উঠবেÑএ প্রত্যাশা সবার।

সকল হাহাকার ও বেদনাত্মক বিষাদ, সকল কষ্টবোধ ও দুঃখের অবসান হোক। আগামী দিনের বিশ্ব যেন এগিয়ে যায় শান্তির দিকে, মানবিক উন্নয়ন ও সমৃদ্ধির দিকে। বিশ্ব মানবতার জয় হোক। প্রকৃতি জেগে উঠুক। হেসে উঠুক পৃথিবী আবার। সবাইকে ইংরেজি নববর্ষের শুভেচ্ছা।
লেখক : কবি ও প্রাবন্ধিক