
এস এম মোজাম্মেল হক :
মানুষ ও অন্যান্য প্রাণীর মধ্যে মৌলিক যে পার্থক্য, তা হলো অন্যান্য প্রাণীকে সঠিক স্বভাবসুলভ প্রাণী হতে ও সার্থকতার জন্য চেষ্টা, অধ্যবসায় বা সাধনা করতে হয় না কিন্তু মানুষকে প্রকৃত মানুষ হতে হলে এগুলোসহ আরও বহু কিছু করতে হয়। একমাত্র মানুষ ব্যতীত অন্যান্য সকল প্রাণীই জন্মের পর তার নিজের চেষ্টায় খাদ্য গ্রহণ করে বেঁচে থাকার ও নিজের চেষ্টায় চলাফেরার সামর্থ্য লাভ করে থাকে। এ তো কেবল শুরুর কথা, অপরপক্ষে আস্তে আস্তে বয়স বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে অন্যান্য প্রাণীর চেয়ে ঢের বেশি চ্যালেঞ্জ মোকাবিলা করতে হয় মানুষকে তার দৈনন্দিন জীবন পরিচালনা, ভবিষ্যতের সুখ-সমৃদ্ধি ও সমাজে নিজেকে যথোপযুক্ত সম্মান ও মর্যাদাপূর্ণভাবে প্রতিষ্ঠার জন্য। এ জন্য প্রয়োজন শিক্ষা, নেতৃত্ব প্রদানের গুণাবলি, অর্থ উপার্জনের যোগ্যতা, সর্বোপরি একজন পূর্ণাঙ্গ মানুষ হিসেবে নিজেকে তৈরি করা। আর এ কাজ সকল মানুষের পক্ষে সমানভাবে অর্জন করা কোনোভাবেই সম্ভব নয়। কারণ, জন্মগতভাবে যে যে পরিবারে জন্মগ্রহণ করে, সে পরিবারের ভৌগোলিক ও আর্থসামাজিক অবস্থানের ওপর বেড়ে ওঠা ও অন্যান্য অগ্রগতি অনেকটা নির্ভরশীল। তবে এর ব্যতিক্রম যে নেই তা নয়, যদিও ব্যতিক্রম কখনো উদাহরণ নয়।
গ্রাম ও শহরের মধ্যে এখন যে ঢের তফাত, বর্তমান সময়ের মতো স্বাধীনতা-পূর্ব সময়ে তা এতটা স্পষ্ট ছিল না। কারণ তখন শহরের আয়তন ছিল খুবই কম, এখনকার মতো এত উঁচু ভবন ও চওড়া পাকা সড়ক ছিল না। গ্রাম ও শহরের মধ্যে কর্মসংস্থান, শিক্ষা, চিকিৎসা ও অন্যান্য সুযোগ-সুবিধার এত বেশি পার্থক্যও ছিল না। তাই মানুষ শহুরে জীবনের চেয়ে গ্রাম্য জীবনে বেশি স্বচ্ছন্দ্যবোধ করত। গ্রাম ছিল সুজলা-সুফলা শস্য-শ্যামলা শান্তির লীলাভূমি। নিজের ফলানো ফসল ও নিজের পোষা প্রাণী থেকে মাছ, মাংস, দুধ, ডিম খেয়েপরে মোটামুটি সম্মানজনকভাবে বেঁচে থাকাকেই মানুষ সার্থক জীবন বলে ধরে নিত। মানুষের মধ্যে এত বেশি অর্থবিত্তের আকর্ষণ ছিল না।
সম্পদের প্রাচুর্যকে মানুষ বাড়তি বোঝা মনে করত। এ ক্ষেত্রে রবীন্দ্রনাথের একটি কবিতার দুটো লাইন এরূপ, ‘তুমি যত ভার দিয়েছ সে ভার করিয়া দিয়াছ সোজা, আমি যত ভার জমায়ে তুলেছি সকলই হয়েছে বোঝা।’ তখন সম্পদের চেয়ে জ্ঞান-বুদ্ধিকেই মানুষ বেশি মর্যাদাপূর্ণ মনে করত। গ্রামাঞ্চলে তখন যাতায়াত ও চলাফেরার জন্য সড়কপথে হাঁটা এবং জলপথে নৌকাই ছিল একমাত্র ভরসা। কারণ তখন পাকা রাস্তা, গাড়ি, রিকশা, ভ্যান ও ইঞ্জিনচালিত নৌকাÑএসব ছিল কল্পনাতীত। অতি শৌখিন কিছু পরিবারে বাইসাইকেল থাকলেও তা ধর্তব্যের মধ্যে পড়ত না। পড়ালেখার জন্য প্রাইমারি ও উচ্চ বিদ্যালয় এখনকার মতো এত ঘন ঘন ছিল না। যে কারণে উচ্চ বিদ্যালয় ও কলেজে পড়ার জন্য চার-পাঁচ মাইল হেঁটে গিয়ে পড়ালেখা করা ছিল বেশির ভাগ লোকের জন্যই অস্বাভাবিক ব্যাপার। তখনকার যুগে গ্রামে বেশির ভাগ লোকেরই পঞ্চম শ্রেণির পরে খুব একটা লেখাপড়া হতো না। আবার অনেকের ক্ষেত্রে উচ্চ বিদ্যালয়ের বিভিন্ন শ্রেণি থেকেও ঝরে যেতে দেখা যেত। তবে যেসব পরিবারের আর্থিক সচ্ছলতা এবং পূর্ববর্তী বংশধরদের শিক্ষাদীক্ষার ধারাবাহিকতা ছিল, সেসব পরিবারের সন্তানদের অধিক পড়ালেখার রেওয়াজ ছিল বৈকি!
১৯৭১ সালে অনেক আশা-আকাক্সক্ষা ও স্বতঃস্ফূর্ত মন নিয়ে ষষ্ঠ শ্রেণিতে ভর্তি হলেও উত্তাল মার্চে স্বাধীনতাযুদ্ধ শুরু হয়ে যাওয়ার ফলে পড়ালেখায় ছেদ পড়ে। একাত্তর সালে যারা মেট্রিক পরীক্ষায় অংশগ্রহণের উপযুক্ত ছিল ৭২-৭৩ সালে তাদের স্বাচ্ছন্দ্যে পাসের সুযোগ সৃষ্টি করা হয়। যে কারণে পরীক্ষা শেষে পরীক্ষাকেন্দ্র পরিষ্কার করতে অনেক সময় লেগে যায়। আমার এক চাচা পরীক্ষার্থী থাকায় অনেকের মতো আমারও পরীক্ষাকেন্দ্র ঘুরে দেখার সুযোগ হয়। মুক্তিযুদ্ধকালীন ইচ্ছেমতো চলাফেরার সুযোগ না থাকায় অনেকেরই কাজকর্ম, ব্যবসা-বাণিজ্যে আমূল পরিবর্তন হয়, এমনকি অল্প পুঁজির অনেক ব্যবসায়ীকে পুঁজি হারিয়ে প্রান্তিক জনগোষ্ঠীতে পরিণত হতে হয়। এ কারণে অনেক দরিদ্র পরিবারের সন্তানেরা সারা জীবনের জন্য পড়ালেখা বাদ দিয়ে স্থায়ীভাবে বিভিন্ন কর্মে আত্মনিয়োগ করতে বাধ্য হয়। যাদের পড়ালেখার প্রতি প্রবল আগ্রহ ও পড়ালেখা চালিয়ে নেওয়ার মতো সচ্ছলতা ছিল, তাদের কিছুসংখ্যক স্বাধীনতা লাভের পর পুনরায় পড়ালেখা শুরু করে। যুদ্ধকালের জন্য অটো প্রমোশনের ব্যবস্থা করা হলে অনেকে পরবর্তী ক্লাসে ভর্তি হয়, তবে দীর্ঘ বিরতি এবং পূর্ববর্তী ক্লাসে না পড়ার জন্য ভিতটা রয়ে যায় কাঁচা। ফলে অনেকেই এসএসসি পরীক্ষায় খারাপ করে এক বছরের বাড়তি সুবিধাটা কাজে লাগাতে ব্যর্থ হয়। ফলে ১৯৭২ সালে যাদের পেছনে ফেলে এসেছিল, দুর্ভাগ্যক্রমে তাদের সঙ্গেই একত্রে এসএসসির গণ্ডি পার হতে হয়।
যুদ্ধের কারণে অনেকের মধ্যে ব্যাপক পরিবর্তন সাধিত হয়। যুদ্ধ-পূর্ববর্তী সময়ে যারা কর্মজীবী ছিলেন, তাদের অনেকে নিজ পেশায় আত্মনিয়োগ করেন। তবে যুদ্ধবিগ্রহের কারণে অনেকে মানসিক পরিবর্তনের ফলে পেশা বদল করে নেয়। বিশেষ করে, যারা শিক্ষায় অগ্রগামী ছিল, ব্যাপক চাহিদা থাকায় তাদের অনেকেই পছন্দসই চাকরি গ্রহণ করেন। সরাসরি যুদ্ধে অংশগ্রহণকারী অনেকে পেশাদার বাহিনীতে যোগদান করেন। অনেকে ভালো ব্যবসায়ী হন আবার অনেকে নিজেকে রাজনীতিতেও সোপর্দ করেন। ষষ্ঠ শ্রেণিতে পড়ালেখা বন্ধ হয়ে যাওয়ায় স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্রের অনুপ্রেরণামূলক চরমপত্র দেশাত্মবোধক অনুষ্ঠান মুক্তিযোদ্ধাদের বীরত্বগাথা অপারেশনের খবর শুনে ও স্থানীয়ভাবে অপারেশনে অংশ নেওয়া মুক্তিযোদ্ধাদের খাবার ও পানীয় সরবরাহ এবং খবরাখবর আদান-প্রদানে যুদ্ধকালীন পুরো সময় কেটে যায়। অতঃপর স্বাধীন দেশে নতুন করে শুরু হয় পড়ালেখার পাট এবং সঙ্গে কবিতা লেখার দৃঢ় প্রত্যয়। প্রথম কবিতা ছিল স্বাধীনতা-সংশ্লিষ্ট কিন্তু অপরিপক্ব বয়স এবং সংরক্ষণের প্রয়োজনীয়তার প্রতি অমনোযোগী থাকায় তা আর সংরক্ষণ করা হয়ে ওঠেনি। শুরুর দিকে পুস্তক আকারে প্রকাশের তেমন চিন্তা না থাকায় শুধু মনের আনন্দেই লেখালেখি চলে এবং গুরুত্বসহকারে সংরক্ষণের অভাবে স্কুলজীবনের বহু লেখা হারিয়ে যায়। কলেজ-জীবন ও পরবর্তী সময়ের কবিতার সংকলন হিসেবে ৫২টি কবিতা নিয়ে ১৯৮৬ সালে প্রকাশিত হয় প্রথম কাব্যগ্রন্থ ‘অভিসার’। (চলবে)
লেখক : কবি, প্রাবন্ধিক, কলামিস্ট ও গবেষক।
কুইন্স ভিলেজ, নিউইয়র্ক।