
রেভারেন্ড ফাদার স্ট্যানলী গমেজ
যেকোনো দেশের স্বাধীনতার পেছনেই বহু দেশপ্রেমিক ও মুক্তিপিয়াসী জনগণের ক্ষুদ্র কিংবা বৃহৎ, প্রত্যক্ষ কিংবা পরোক্ষ, জ্ঞাত কিংবা অজ্ঞাত অবদান থাকে। বাংলাদেশের স্বাধীনতার ক্ষেত্রেও তা সত্য। অর্ধশতাব্দীর একটু বেশি সময় ধরে আমরা এখনো স্বাধীনতাসংগ্রামের ইতিহাস জানছি, আরো ঐতিহাসিক তথ্য খুঁজছি, গবেষণা করে যাচ্ছি। যতই জানছি, বিভিন্ন পটভূমির খোঁজ পাচ্ছি, অজ্ঞাত অনেকের আত্মত্যাগের কাহিনি শুনছি; ততই গর্বে বুক ভরছে, শ্রদ্ধায় মাথা অবনত হচ্ছে, সম্মানে-কৃতজ্ঞতায় আমাদের হৃদয়-মন আপ্লুত হচ্ছে। সৃষ্টিকর্তার কাছে বিনীত প্রার্থনা, বাংলাদেশের স্বাধীনতার জন্য সকল আত্মত্যাগী, কষ্টভোগী বীর-বীরাঙ্গনাদের যেন তিনি ইহজীবনে ও পরজীবনে তাদের যোগ্য আশীর্বাদ ও পুরস্কার দান করেন।
স্বাধীনতা অর্জনে যত মহৎ, সাহসী, বীর নেতৃবৃন্দ, মাঠকর্মী, বিভিন্ন পেশায় নিয়োজিত দেশপ্রেমিক জনগণ এবং মুক্তিযোদ্ধাবৃন্দ সংগ্রাম করেছেন, তাদের মধ্যে জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান অন্যতম। ওনার সংগ্রামী ও আত্মত্যাগী জীবনের শুরু হয়েছিল বহু আগে, সেই ১১ মার্চ ১৯৪৮ সালে। বাংলা ভাষাকে রাষ্ট্রভাষার মর্যাদা দেওয়ার দাবিতে আন্দোলন শুরু করার জন্য গ্রেফতার হন এবং ১৫ মার্চ ছাড়া পান। এরপর বহুবার সেই বন্দিত্ব ও মুক্তি, গ্রেফতার ও হয়রানি। বাংলার সর্বস্তরের খেটে খাওয়া মানুষের অধিকার অর্জনের ও তার স্বীকৃতির জন্য তিনি মুখ খুলেছেন বারবার। অন্যায্য শাসক ও শোষকদের অত্যাচারের বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়াতে গিয়ে বারবার তাঁকে গ্রেফতার হতে হয়েছে, নির্দোষ হয়েও কারাগারে বন্দী থাকতে হয়েছে বহুবার, পরিবার থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে জেলের ভেতর কাটাতে হয়েছে ঈদ, সামাজিক ও পারিবারিক বিশেষ বিশেষ দিন। তাঁর নামে মিথ্যা মামলা দিয়ে হয়রানি করা হয় অনেকবার। আইয়ুব-মোনায়েম স্বৈরাচারী সরকার অকারণে বেআইনিভাবে মামলা দিয়ে তাঁকে অপদস্থ করতে, তাঁর মনোবলকে দুর্বল করতে চেয়েছে বহুবার।
কিন্তু জন্মভূমির জন্য, জনগণের জন্য, সর্বোপরি স্বাধীনতার জন্য তিনি শত কষ্টের মাঝেও শক্ত থেকেছেন, দৃঢ় রেখেছেন তাঁর মনোবল, জোরালো রেখেছেন তাঁর উদ্দীপনাদায়ী কণ্ঠকে। জন্মভূমির ও আপামর জনগণের স্বাধীনতার জন্য কারারুদ্ধ অবস্থায় ওনার যে কষ্ট, ত্যাগ স্বীকার, অন্যান্য বন্দীর জন্য তাঁর মায়া তিনি নিজের হাতে লিখে রেখেছিলেন থানার হাজতে, মহকুমার জেলে এবং কেন্দ্রীয় কারাগারে বন্দী থাকার সময়ে; সেই রোজনামচার খাতাগুলো দুবার উদ্ধার করেছেন তাঁর সুযোগ্য কন্যা শেখ হাসিনা (বর্তমান মাননীয় প্রধানমন্ত্রী) ধানমন্ডির ৩২ নম্বর সড়কের বাসা থেকে, যা কিনা তাঁর মায়ের প্রেরণা ও অনুরোধের ফসল। সেই উদ্ধার কাহিনিও ভয়ানক। মর্মান্তিক পরিস্থিতি এবং সেগুলো লুকিয়ে রাখার জায়গাগুলোর বর্ণনা করতে অনেক সময়ের প্রয়োজন। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান যতবার জেলে যেতেন, তাঁর স্ত্রী বেগম ফজিলাতুননেছা খাতা-কলম দিতেন কারাগারের অভিজ্ঞতা লিখে রাখার জন্য। জেলমুক্তির পর তিনি নিশ্চিত করতেন, যেন সেই লেখাসহ খাতাগুলো আসে এবং সেগুলো তিনি যত্নভরে সংরক্ষণ করে রাখতেন। এই মহীয়সী নারীর দূরদর্শী চিন্তার জন্যই আমরা এই মূল্যবান অভিজ্ঞতাগুলো জানতে পারছি, আমাদের স্বাধীনতার উৎস খুঁজে পাচ্ছি। বঙ্গবন্ধুর লিখিত ডায়েরিগুলো প্রকাশে শেখ হাসিনা, ড. এনায়েতুর রহিম ও বেবী মওদুদের উদ্যোগ যেমন তুলনাহীন, তেমনি ইতিহাস সংরক্ষণের ক্ষেত্রেও দূরদর্শী এক কাজ। তাঁদেরকে বিভিন্নভাবে সহায়তা করতে গিয়ে শেখ রেহানা বইয়ের নাম ‘কারাগারের রোজনামচা’ রেখেছেন।
বঙ্গবন্ধু বিভিন্ন সময়ে বিভিন্ন কারাগারে রাজবন্দী হিসেবে অবরুদ্ধ হন। সেই নানা প্রকার অভিজ্ঞতার কথা তিনি লিখেছেন বিভিন্ন খাতায় এবং কিছু কিছু খাতার নামকরণও করেছিলেন। যেমন ১৯৫৮ সালের ৭ অক্টোবর আইয়ুব খান সামরিক আইন জারি করেন এবং ১২ অক্টোবর শেখ মুজিবুর রহমানকে গ্রেফতার করেন। তিনি কারাগার থেকে মুক্তি পান ১৯৬০ সালের ডিসেম্বরে। সেই সময়কার অভিজ্ঞতা তিনি যে খাতায় লিখেছিলেন, তার নামকরণ করেন :
‘থালা বাটি কম্বল
জেলখানার সম্বল।’
সেই লেখাগুলোর মাধ্যমে পাঠক জানতে পারবেন সেই সময়ে জেলখানার পরিবেশ, পরিস্থিতি, কয়েদিদের জীবনের অনেক অজানা কাহিনি, বন্দীদের হৃদয়ের গুমোট ব্যথা, এমনকি অপরাধীরা কেন অপরাধের জগতে পা দিয়েছিল ইত্যাদি। সে কথা বোঝাতে গিয়ে বঙ্গবন্ধু লিখেছেন, ‘জেলের ভিতর অনেক ছোট ছোট জেল আছে।’ অর্থাৎ জেলখানা ভিন্ন একটা জগৎ। কয়েদিদেরই জেলের কাজ করতে হতো, অফিসারদের সহায়তা করা থেকে শুরু করে রান্না, পরিষ্কার করা, কাপড় ধোয়া, বাগানে কাজ করা ইত্যাদি। হাজতিদের এক জায়গায় রাখা হতো, সেখান থেকে তারা বের হতে পারত না। রাজবন্দীরা থাকতেন আরেক জায়গায় অবরুদ্ধ হয়ে। কয়েদিদের জন্য আলাদা জায়গা ছিল, ছোট ছোট দেয়াল দিয়ে ঘেরা। আরেকটা এলাকা ছিল, যাকে বলা হতো সেল এরিয়া। এটা ছিল জেলের ভেতর কেউ কোনো অপরাধ/অন্যায় করলে তাদের সাজা ছিল এই সেল এরিয়ায় আটক থাকা। কিছু সেল ছিল একাকী বা solitary confinement. দিনের বিভিন্ন সময়ে কয়েদিদের গুনতি দিতে হতো, লাইন বেঁধে দাঁড়িয়ে কিংবা কখনো বসিয়ে গণনা করা হতো। জেলের ভেতর হাসপাতাল বা চিকিৎসার এলাকা ছিল। তবে চিকিৎসার মান, সেটা আরেক ব্যাপার। পাহারাদারদের বিভিন্ন শ্রেণি ছিল, সে অনুযায়ী তারা তাদের দায়িত্ব পালন করত। কয়েদিরাই অন্য কয়েদিদের চালনা করত তাদের জেলখানায় থাকার সময়সীমা বুঝে তাদের শ্রেণি অনুযায়ী। কাজ বুঝিয়ে দিয়ে আবার কাজ বুঝে নিতে হতো। কয়েদিদের ওপর যে অত্যাচার হতো বা তাদের মারপিট করা হতো, তা অনেক ক্ষেত্রে কয়েদিরাই করত। এ বিষয়ে বঙ্গবন্ধুর মন্তব্য, ‘ইংরেজদের কায়দা, কাঁটা দিয়েই কাঁটা তোলা হয়।’
তাঁর লেখাগুলো থেকে আরো জানা যাবে অনেক শব্দমালা, যা শুধু জেলখানাতেই ব্যবহৃত হতো। সেগুলোর মধ্যে কয়েকটি উল্লেখযোগ্য হলো :
রাইটার দফা : লেখাপড়া জানা কয়েদিরা অফিসের কাজ করত, চিঠিপত্র লিখে দিত, আপিল/দরখাস্ত লিখত, কয়েদির চিঠি এলে তা বিলি করত, কয়েদিদের জেল খাটার সময়ের হিসাব রাখত। কেউ আবার জেলখানার ডাক্তারদের সাহায্য করত ওষুধপত্রের হিসাব রেখে কিংবা কম্পাউন্ডারের কাজ করে।
চৌকি দফা : যেখানে কয়েদিদের রান্না হতো। মুসলিম ও হিন্দুদের জন্য আলাদাভাবে রান্নার ব্যবস্থা ছিল। এখানে প্রচুর কয়েদি কাজ করত।
জলভরি দফা : এরা পানি টানত ও বিভিন্ন ওয়ার্ডে পানি সরবরাহ করত।
ঝাড়ু দফা : এদের কাজ ছিল ঝাড়ু দেওয়া, ময়লা পরিষ্কার করা। যেসব কয়েদি একটু বয়স্ক কিংবা অসুস্থ ছিল, তাদের এই কাজে দেওয়া হতো।
বন্দুক দফা : একদল কয়েদি ছিল, যারা মেথরের কাজ করত। কাঁধে বন্দুক বহন করতে করতে যেমন কাঁধে দাগ পড়ে যায়, তেমনি পায়খানার ময়লা-আবর্জনা কাঁধে বহন করতে করতে দাগ হয়ে গেলে ব্যঙ্গাত্মকভাবে বলা হতো বন্দুক দফা। বঙ্গবন্ধুর আন্তরিকতার জন্য কয়েদিরা তাঁকে অনেক মনের কথা, গোপন কথা বলে দিত।
পাগল দফা : জেলখানায় অনেক কয়েদি পাগল হয়ে যায় বিভিন্ন কারণে। পাগলদের আলাদা রাখার ব্যবস্থা ছিল। এদের পাশেই এক সেলে বঙ্গবন্ধুকে রাখা হয়েছিল। রাতে অনেক পাগলের পাগলামি থামে না বরং বাড়ে। এদের চিৎকারে বহু রাত তিনি ঘুমাতে পারেননি।
শয়তানের কল : প্রথম দিকে বঙ্গবন্ধু বুঝতে পারেননি এই বিভাগটিকে শয়তানের কল বলা হতো কেন। ঢাকা জেলে এটা ছিল কম্বলের ফ্যাক্টরি। কয়েদিদের জন্য কম্বল বানানোর পাশাপাশি জেল কর্তৃপক্ষ কম্বল বাইরেও বিক্রি করত। তুলা দিয়ে কম্বল তৈরি করতে গিয়ে যে কয়েদিরা সেখানে কাজ করত, তাদের সারা শরীর, কাপড় তুলার কণায় ও ধুলায় ভরে যেত এবং তাদের শয়তানের মতো নাকি দেখা যেত। সে কারণে এই বিভাগকে বলা হতো শয়তানের কল।
আরো অন্যান্য বিভাগের সঙ্গে ছিল দরজি ও মুচি বিভাগ কাপড় ও জুতা/স্যান্ডেল তৈরি ও মেরামত করার জন্য।
কারাগারে আবদ্ধ থাকাকালে বঙ্গবন্ধু তাঁর কষ্টভোগের কারণ সম্বন্ধে মন্তব্য করতে গিয়ে লিখেছেন, ‘পাকিস্তান হওয়ার পরে রাজবন্দীদের যে সমস্ত সুযোগ-সুবিধা ইংরেজ আমলে ছিল তাহা উঠাইয়া দেওয়া হয়। রাজবন্দীদের কোনো বিশেষ সুবিধা দেওয়া হতো না। তাদের ব্যবহার করা হতো সাধারণ কয়েদিদের মতো। কাহাকেও তৃতীয় শ্রেণীর মতো ব্যবহার করত।’ খাবারের মান নিম্ন থেকে নিম্নতর হতে থাকে, চিঠি লেখা ও পাওয়াতে অনেক বিধিনিষেধ বাড়তে থাকে, আত্মীয়স্বজনের সঙ্গে সাক্ষাতের সময় কমিয়ে ২০ মিনিট দেওয়া হয়, তাও আবার একজন আইয়ুবি কর্মচারী সেখানে বসে থাকত আর জেলের পক্ষ থেকেও একজন ডেপুটি জেলার উপস্থিত থাকতেন। কারাগারে সাক্ষাৎ বিষয়ে তিনি লিখেছেন : ‘জেল কারাগারে সাক্ষাৎ করতে যারা যায় নাই তাহারা বুঝতে পারে না সেটা কী বেদনাদায়ক ও মর্মান্তিক। ভুক্তভোগীরা কিছু বুঝতে পারে।’ তিনি নিজেও এ ব্যাপারে কষ্ট পেয়েছেন, অন্য কয়েদিদের কষ্ট দেখেও অনেক ব্যথা পেয়েছেন : ‘দুঃখ হয় যখন বৃদ্ধা মা-বাবা, স্ত্রী এবং ছোট্ট ছোট্ট ছেলেমেয়েরা বিদায় নেয়, কেহ বা কাঁদতে কাঁদতে, কেহ বা মুখ কালো করে।’
প্রকাশনার ভূমিকায় শেখ হাসিনা লিখেছেন, ‘বাংলার মানুষ যে স্বাধীন হবে এ আত্মবিশ্বাস বারবার তাঁর লেখায় ফুটে উঠেছে।’ সত্যি তা-ই। কারাগারের রোজনামচা পড়তে গিয়ে পাঠক তা বুঝতে পারবেন ও অনুভব করবেন। সেই সঙ্গে বঙ্গবন্ধু ও অন্য কয়েদিদের দুরবস্থার কাহিনি জেনে চোখের জল সামলে রাখা কষ্টকর হবে। স্বাধীনতা এমনি এমনি আসে না, এর জন্য কাউকে না কাউকে কষ্ট স্বীকার, আত্মত্যাগ, এমনকি জীবনও দিতে হয়। দার্শনিকেরা বলেছেন, ‘Freedom is not free, someone has to pay for it.’ আমরা সবাই কৃতজ্ঞ স্বাধীনতা লাভের সঙ্গে যারা সংশ্লিষ্ট ছিলেন ও আছেন। মহান সৃষ্টিকর্তা সকলের মঙ্গল করুন। সকলের প্রতি স্বাধীনতা দিবসের অভিনন্দন ও শুভেচ্ছা।
তথ্যসূত্র : শেখ মুজিবুর রহমান, ‘কারাগারের রোজনামচা’, প্রকাশক বাংলা একাডেমি, ৮ম মুদ্রণ : শ্রাবণ ১৪২৫/জুলাই ২০১৮
কৃতজ্ঞতা স্বীকার : শ্রদ্ধেয় মি. পল বি. বালা (বইটি আমাকে পড়ার সুযোগ দেওয়ার জন্য)
লেখক : একজন রোমান ক্যাথলিক যাজক, ঢাকায় জন্মগ্রহণকারী, নিউজার্সিবাসী এবং ধর্মবিষয়ক কলামিস্ট।