
মোস্তফা কামাল : আমাদের স্বাধীনতার স্বীকৃতি আছে। কিন্তু, স্বাধীনতা প্রাপ্তির আগে টানা ৯টি মাস যে হত্যা-গণহত্যা চলেছে, সেটির আন্তর্জাতিক স্বীকৃতি নেই। এ স্বীকৃতিটা যে কতো দামী, তা বুঝতেও বহু সময় পার হয়ে গেছে। এ জন্য বিএনপি দায়ী- বলেছেন সরকারি দলের সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুর কাদের। কিভাবে দায়ী বিএনপি? তাদের জন্ম কবে? একাত্তরে বিএনপি নামের কোনো দল ছিল?
এসব প্রশ্ন তোলার সুযোগ কই! ওবায়দুল কাদের বলেছেন, একাত্তরের গণহত্যা নিয়ে বিএনপি এবং পাকিস্তানের একই মনোভাব। বিএনপি মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীরের কথাও কম চড়া নয়। তিনি বলেন, ‘একাত্তরের ২৫ মার্চ গণহত্যার কারণ তৎকালীন আওয়ামী লীগের ব্যর্থতা’। মিললো কারো কথা? কিসের মধ্যে কী?
এই কি আর কী-এর কেওয়াজেই আমাদের এগিয়ে চলা। যার মন যা চায়, তা-ই বলে দেয়া যায়। আসল কাজ বাদ দিয়ে খই ভাজায় আকাজে পার করে দেয়া যায় বছরের পর বছর। সেইক্ষেত্রে খইটা ভাজতে হয় আওয়াজ দিয়ে। মানুষকে এটা-সেটা বোঝানো মোটেই কঠিন নয়। একাত্তরের গণহত্যার একটি আন্তর্জাতিক স্বীকৃতি যে দরকার, তা বুঝতে আমাদের অনেক সময় লেগেছে। অনেক দেরিতো যতটুকু গরজ জন্মেছে, তাও হারিয়ে গেছে রাজনীতির চোরাগলিতে। জোর চেষ্টা-তদ্বিরেও এখন কী আর তা সহজসাধ্য?
হত্যা প্রশ্নে ২৫ মার্চ কালরাতকে একাত্তরের ৯ মাসের মধ্যে সব চেয়ে ভয়ঙ্কর মনে করা হয়। স্বাধীনতা অর্জনের সুবর্ণজয়ন্তী পার হয়ে গেলেও পাকিস্তানি বাহিনীর হত্যা-গণহত্যার আন্তর্জাতিক স্বীকৃতির বিষয়টি উপেক্ষিত পর্যায়ে। পাকিস্তান সুযোগ পেলেই বলতে চায়, গণহত্যার প্রমাণ হিসেবে যেসব ছবি দেখানো হয়, সেগুলো ঘটিয়েছে মুক্তিযোদ্ধারা! পাকিস্তানে নানা প্রচারণা এবং বইপুস্তক প্রকাশনার মাধ্যমে সেখানে বোঝানো হয়, বাংলাদেশের সৃষ্টি ভারত-পাকিস্তানের যুদ্ধের ফসল। আর বাংলাদেশের কয়েকটি মহল একাত্তরকে স্রেফ গণ্ডগোলের বছর বলতে সচেষ্ট। ৩০ লাখ শহীদের সংখ্যা সঠিক নয়- এ দাবিও আছে। তাহলে বাকি থাকলো কী?
জাতিসংঘ প্রতি বছর ৯ ডিসেম্বর গণহত্যা প্রতিরোধ ও গণহত্যার শিকার ব্যক্তিদের স্মরণে আন্তর্জাতিক দিবস পালন করে। ১৯৪৮ সালের ওইদিন জাতিসংঘের ‘জেনোসাইড কনভেনশন’ বা ‘গণহত্যা সনদ’ গৃহীত হয়। জাতিসংঘ দিনটিকে প্রথমবারের মতো উদযাপন করে ৯ ডিসেম্বর ২০১৫। প্রথম মহাযুদ্ধকালে ১৯১৫ সালে তুরস্কের অটোমান সাম্রাজ্য আর্মেনিয়ান সম্প্রদায়ের ওপর চালানো গণহত্যায় নিহতের সংখ্যা ৬ লাখ। জাতিসংঘের সদস্য রাষ্ট্র হিসেবে বাংলাদেশও দিনটি মানে। তবে, বাংলাদেশ জাতীয়ভাবে পালন করে ২৫ মার্চ। তাও ২০১৭ সাল থেকে। কেমন হয়ে গেল না ব্যাপারটা?
এ অবস্থার মাঝামাঝি রাস্তা হচ্ছে- দিন-তারিখের দিকে না যাওয়া। যত দ্রুত সম্ভব একাত্তরের ওই গণহত্যার ঘটনার স্বীকৃতি আদায় করা। কারণ, জাতিসংঘ তার ৯ ডিসেম্বর তারিখটি পাল্টাবে বলে ভাবা যায় না। একটা সময় পর্যন্ত ২৫ মার্চ এবং ১৪ ডিসেম্বর দুটি তারিখকেই গণহত্যা দিবস পালনের দাবি ছিল স্থানিকভাবে। যুক্তি ছিল দু’দিকেই। পরে ২০১৭ সাল থেকে দেশে রাষ্ট্রীয়ভাবে ২৫ মার্চ জাতীয় গণহত্যা দিবস হিসেবে পালন হচ্ছে। জাতীয় সংসদে এবং মন্ত্রিসভায় এ সংক্রান্ত একটি প্রস্তাবও পাস হয়েছে। এরপরও আমাদের জন্য এখন জরুরি হয়ে পড়েছে ঘটনার বিশ্ব স্বীকৃতি আদায়। জাতিসংঘ যেখানে ৯ ডিসেম্বর আন্তর্জাতিক গণহত্যা দিবস পালন করে চলছে। তারিখটি কী বদলাবে তারা? তারিখের দিকে না তাকিয়ে গণহত্যার ঘটনার স্বীকৃতি আদায়ে দেরি হলে পরবর্তী চিত্র কেমন হতে পারে, ধারণা করা কি বেশি কঠিন?
লেখক : সাংবাদিক-কলামিস্ট; বার্তা সম্পাদক, বাংলাভিশন, ঢাকা।