
মুহম্মদ ফজলুর রহমান :
১৯৭১ সালে স্বাধীনতা অর্জনের পর ৫২ বছর পার করে এলাম। ১ মার্চ জাতীয় পরিষদের অধিবেশন স্থগিত। ১৯৭০-এর সাধারণ নির্বাচনে আওয়ামী লীগের ভূমিধস বিজয়কে নস্যাৎ করার ষড়যন্ত্র। ৭ মার্চ বঙ্গবন্ধুর ঐতিহাসিক ভাষণÑ ‘এবারের সংগ্রাম আমাদের মুক্তির সংগ্রাম/এবারের সংগ্রাম স্বাধীনতার সংগ্রাম।’ মুক্তির জন্য বাঙালির চূড়ান্ত লড়াইয়ের সংকেত। প্রস্তুতির জন্য জরুরি নির্দেশনা: ঘরে ঘরে দুর্গ গড়ে তোলা এবং যার যা কিছু আছে, তাই নিয়ে শত্রুর মোকাবিলা করার নির্দেশনা। এরপর ১৬ থেকে ২৪ মার্চ সংলাপের নাটক। বাঙালি নিধনের নীলনকশা। অতঃপর ২৫শে মার্চের কালরাত্রি। দখলদার পাকিস্তানি বাহিনীর ‘অপারেশন সার্চ লাইট’। গণহত্যার শুরু। ঢাকা শহর এক রাতেই লাশের নগরী। যদিও আন্তর্জাতিকভাবে এখনো গণহত্যার স্বীকৃতি মেলেনি। তবে মানব সভ্যতার ইতিহাসে ১৯৭১-এ পাক দখলদার বাহিনীর বর্বর, নিষ্ঠুর, নির্মম, নির্বিচার হত্যাযজ্ঞÑ অন্যতম গণহত্যা বলে একদিন অবশ্যইং স্বীকৃতি পাবে।
আসলে ২৫শে মার্চ কালরাত্রি থেকেই বাঙালির প্রকৃত মুক্তিযুদ্ধ শুরু। আর কেউ ‘বাঙালিদের দাবায়ে রাখতে পারবা না’। নেতাকে পাকিস্তানে ধরে নিয়ে মৃত্যুর ভয় দেখিয়ে, কবর খুঁড়ে সে কবরে বাঙালির নেতা, জাতির জনক, বঙ্গবন্ধুর জীবন শেষ করে দেয়ার সুখস্বপ্নই তারা কেবল দেখছিল না, একই সঙ্গে জাতির মুক্তি ও স্বাধীনতার স্বপ্নসহ সব স্বপ্ন কবর-চাপা দেয়ার আনন্দে ভাসছিল। ২৪ বছর ধরে বাঙালিদের শোষণ-নিপীড়ন চালিয়ে, সব ন্যায্য অধিকার থেকে বঞ্চিত করে দখলদার বাহিনী ভেবে নিয়েছিলÑ বাঙালিদের দৌঁড় ঐ মিটিং-মিছিল আর গরম গরম স্লোগান পর্যন্ত, আর গন্তব্য জেলখানা! ওরা বাঙালিদের সম্পূর্ণটা দেখেছিল না। বাঙালির বীরত্ব, বাঙালির শৌর্য্য-বীর্যের আসল খবর জানতো না। জানতো না বাঙালি ভাঙে, কিন্তু মচকায় না। জান দিয়ে মান রাখে। তবু হার মানে না।
তাইতো ৩০ লাখ মানুষ জীবন দিলো, ২ লাখের অধিক মা-বোন সম্ভ্রম হারালো, তবুও পরাজয় মানলো না। বিশ্বের অন্যতম এক চৌকষ বাহিনীকে বাংলার কাদা-পানিতে চুবিয়ে পরাজয়ের মালা পরিয়ে, প্রায় ৯৫ হাজার সৈন্যসমেত সব নামী-নামী জেনারেলকে ভারতীয় মিত্র বাহিনীর হাতে তুলে দিলো ১৬ ডিসেম্বর সেই রেসকোর্স ময়দানে। যেখানে ৯ মাস আগে বঙ্গবন্ধু ঘোষণা করেছিলেনÑ ‘এবারের সংগ্রাম আমাদের মুক্তির সংগ্রামÑ এবারের সংগ্রাম স্বাধীনতার সংগ্রাম।’ বাঙালিরা জীবন দিয়ে নেতার কথা রাখলো। কেউ ‘দাবায়া’ রাখতে পারলো না।
বিশ্বের বাঙালিরাই মনে হয় একমাত্র জাতি, যাদের মাত্র ২৪ বছরের মধ্যে স্বাধীনতার জন্য দু’বার লড়াই করতে হয়। একবার বৃটিশের ২০০ বছরের উপনিবেশিক শাসনের বিরুদ্ধে লড়াই করে ১৯৪৭ সালে স্বাধীনতা অর্জন করে পাকিস্তান। জীবন দেন নেতাজী সুভাষ চন্দ্র বসু, ক্ষদিরাম, তীতুমীর, সূর্যসেন, প্রীতিলতা, আরো কত শত-সহস্র দেশপ্রেমিক হিন্দু, মুসলিম, বৌদ্ধ, খৃস্টান। দ্বিতীয়বার পাকিস্তানের শাসন, শোষণ, বঞ্চনার বিরুদ্ধে ২৪ বছর লড়াই করে ১৯৭১ সালে ৩০ লাখ মানুষের জীবন, ২ লক্ষাধিক নারীর সম্ভ্রমের বিনিময়ে স্বাধীনতা অর্জন এবং পাকিস্তানের শাসনমুক্ত লাল-সবুজের বাংলাদেশ লাভ।
যে বিশ্বাস, যে স্বপ্ন ও ভাবনা নিয়ে মানুষ নিজের জীবন, নিজের স্ত্রী-পুত্র-কন্যা, সংসার ত্যাগ করে মুক্তিযুদ্ধে ঝাঁপিয়ে পড়েছিল, এখন নীতি নির্ধারক, সরকার পরিচালক, সমাজপতি অনেকের মধ্যেই সেসবের খামতি আছে বলে সাধারণ মানুষের মনে বিশ্বাস। জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের মনে সাধারণ মানুষের স্বপ্ন সবসময় সজীব ছিল। তিনি যা বলতেন, তা গভীর বিশ্বাস থেকেই বলতেন। সবসময় সে বিশ্বাসকে তিনি বাস্তবে পরিণত করার সমস্ত সততা নিয়ে কাজ করে গেছেন। যেকোন বৈরী পরিবেশেও তিনি মানুষের কথা ভেবে তাদরে স্বপ্ন বাস্তবে রূপ দিতে লড়াই করেছেন। ওয়াদা রক্ষার জন্য তিনি নিরন্তর নিজেকে প্রস্তুত রাখতেন। আজ ৫২ বছর পেছনে রেখে যখন সামনে দৃষ্টি মেলে মানুষ, তখন বঙ্গবন্ধু যে কতভাবে সামনে এসে দাঁড়ান।
আমরা বলি এবং বিশ^াস করি যে, ১৯৭৫-এর ১৫ আগস্ট যেসব আদর্শহীন বিশ্বাসঘাতকরা স্বাধীন বাংলাদেশকে আরেকবার পাকিস্তান বানিয়ে উল্লাস করতে চেয়েছিল। তারা ব্যর্থ হয়েছে। তারা তাদের কর্মের শাস্তিও পেয়েছে। কিন্তু জাতির জনকের স্বপ্ন এখনও বাস্তবে রূপলাভ করতে পারেনি। পৃথিবী জানে পাকিস্তানিরা ইসলামের কথা মুখে বললেও অন্তরে বিশ্বাস করে না। তারা অঙ্গীকার করে অঙ্গীকার রাখে না। ১৯৪৮ সাল থেকে ১৯৭০-এর সাধারণ নির্বাচনের ফলাফলÑ সব ক্ষেত্রেই পাকিস্তানের প্রতিশ্রুতি রক্ষা করার কোন নজির নেই। তাই আমরা মুক্তিযুদ্ধ করেছি। আমরা জয়ী হয়েছি।
সাধারণ মানুষের মনে এখন যে প্রশ্ন গভীর ক্ষত সৃষ্টি করছে, তা হলোÑ আমরা বঙ্গবন্ধুর সৈনিক হয়ে কেন তাঁর স্বপ্ন সফল করতে পারছি না? অনেকে মনে করেন, বড় একটা গোষ্ঠী লোভের বৃত্তে আটকা পড়েছে। সেই বৃত্ত থেকে তারা কোনভাবেই মুক্ত হতে পারছে না। সে কারণেই আগে যা কখনোই শোনা যায়নি যে কথা, এখন তাও শোনা যাচ্ছে। বাজারের দিকে তাকালে তার প্রমাণ মেলে। আগে লবণ, চিনি, তেল, গুড়া দুধ, চাল, ডালের দাম বাড়লেও কখনও ডিম, মুরগি নিয়ে করপোরেট কারসাজির কথা শোনা যায়নি। এখন মানুষ তার নিজের জীবন দিয়ে অনুভব করতে পারছে তাদরে বাড়াবাড়ি। বাংলাদেশের বাজারের দিকে তাকালে মনে হয় পাগলা ঘোড়া ছুটছে তো ছুটছেই! লাগাম টানা যাচ্ছে না কিছুতেই।
বাংলাদেশের হাল এখন বঙ্গবন্ধু-কন্যা শেখ হাসিনার হাতে। পিতার স্বপ্ন এবং আদর্শ বাস্তবায়নে তিনি বদ্ধপরিকর। বিশ্বময় তাঁর সাফল্যের সুনাম। তিনি রাত-দিন পরিশ্রম করে যাচ্ছেন দেশকে উন্নয়নের শীর্ষ শিখড়ে নিয়ে যেতে। বিশ্বব্যাপী বাংলাদেশ এখন উন্নয়নের রোল মডেল। বিশ্বসভায় বাংলাদেশ এখন সবদিক থেকে উচ্চাসনে আসীন। বাংলাদেশের এই উন্নয়নের জন্য শেখ হাসিনাও বিশ্বময় প্রশংসিত। কিন্তু কতিপয় রাজনীতিবিদ, কতিপয় ব্যবসায়ী, কতিপয় আমলাকে এমনভাবে লোভে পেয়ে বসেছে যে, ডানে-বাঁয়ে মুনাফা ছাড়া, অর্থের আমদানি ছাড়া তাদের মনে আর কিছুই জায়গা পায় না। চোখেও আর কিছু দেখতে পায় না। সাধারণ মানুষের কোন মূল্যই নেই তাদের কাছে। ভয়ংকর লোভে-আক্রান্ত এইসব মানুষ মুনাফা শুষছে, নাকি মানুষের রক্ত পান করছে, তা বুঝতে পারছে না।
এইসব রক্তপিপাসু মানুষ এও বিস্মৃত হয়েছে গেছে যে, বঙ্গবন্ধু-কন্যা শেখ হাসিনা ’৭৫-এ মা-বাবা, ভাই-ভাবি, স্বজনদের হারিয়ে কোন অবস্থায় দেশে ফিরেছিলেন, আর দেশের আজ কী অবস্থা! মুক্তিযুদ্ধের পর যে অবস্থা হয়েছিল যুদ্ধবিধ্বস্ত দেশের, তার চেয়েও তখন করুণ অবস্থা দেশের। চারদিকে ঘোর অন্ধকার। ঐ ঘোর অন্ধকার সময়ে মানুষের দিশেহারা অবস্থা। চারিদিকে বিশৃঙ্খলতা, অরাজকতা। ঐ অন্ধকার সময়ে দাঁড়িয়ে কেউ ভাবতে পারেনিÑ অন্ধকার কেটে গিয়ে আবার আলো ফুটবে। মানুষ আবার বুক ভরে নিঃশ্বাস নিতে পারবে। জয়বাংলা স্লোগান দেয়া যাবে। আবার বঙ্গবন্ধুর কথা, মুক্তিযুদ্ধের কথা শোনা যাবে।
বাঙালিরা সত্যি ভাগ্যবান। জাতির জনকের কন্যা ধরেছেন পিতার স্বাধীন করা বাংলাদেশের হাল। তিনি সর্বাত্মক চেষ্টা করে যাচ্ছেন পিতাকে অনুসরণ করে দেশ পরিচালনা করতে। তিনি ঘুষ-দূর্নীতির বিরুদ্ধে ‘জিরো টলারেন্স’ ঘোষণা করেও সবকিছু নিয়ন্ত্রণে আনতে পারছেন না। তবে এ বিশ্বাস রাখতে হবে যে, আজ যা পারা যাচ্ছে না, ভবিষ্যতে অবশ্যই তিনি পারবেন। ২১ বছর উল্টো স্রোতে বাংলাদেশ চলেছে। চালিয়েছে মুক্তিযুদ্ধের বিরোধীরা। সামনে তকিয়ে আমাদের আশাবাদী হতেই হবে। আমাদের অন্তরে এতদিনে যত ‘কু’ বাসা বেঁধেছে, তা কি একদিনে পরিত্যাগ করা সম্ভব? কু-চিন্তা, কু-কর্ম, কু-অভ্যাস, কু-আচরণÑ কখনো ইচ্ছা করলেই সঙ্গে সঙ্গে ত্যাগ করা যায় না। এর জন্য অনুকূল পরিবেশ লাগে, সময় লাগে। কু-অভ্যাস যত তাড়াতাড়ি রপ্ত হয়, ততো তাড়াতাড়ি ত্যাগ করা যায় না।
আশা ছেড়ে দিলে হবে না। আমাদের আজকের পরিস্থিতিতে আত্ম-বিশ্লেষণ জরুরি। স্মরণে, বোধে, চেতনে আমাদের মুক্তিযুদ্ধকে কঠিনভাবে স্থাপন করতে হবে। বিকৃত ভাবনা, বিকৃত চিন্তা, বিকৃত ইতিহাস চর্চা সম্পূর্ণরূপে বর্জন করতে হবে। লোভের বৃত্ত থেকে বের হয়ে আসতে হবে। কুচিন্তা পরিত্যাগ করতে হবে। মুক্তিযুদ্ধকে নিরন্তর চর্চায় রাখতে হবে। সঠিকভাবে অবিকৃতরূপে সে চর্চা থাকতে হবে। মুক্তিযুদ্ধের আদর্শগুলো অনুসরণ করতে হবে। বাস্তবে প্রয়োগ করতে হবে। তবেই হবে স্থায়ী মুক্তি। পাওয়া যাবে নির্মল আলো।
লেখক : প্রধান সম্পাদক, ঠিকানা।
নিউইয়র্ক, ২৫ মার্চ, ২০২৩