লাবলু কাজী
দুঃখের সময় মনের সাথে দেহ সন্ধিবদ্ধ হয়ে জীবনের বিরুদ্ধে যুদ্ধ ঘোষণা করে । কোন কিছুই আর ঘড়ির কাঁটার মতো টিক টিক শব্দে সম্মুখপানে আগায় না। এককথায় জীবন স্থবির হয়ে পড়ে রাস্তায় চলমান বিকল হয়ে যাওয়া গাড়ির মতো । এর চূড়ান্ত গন্তব্য খাঁদ; চালক বেচারা অসহায় ! মনটা খারাপ হলে রাতে ঘুম আসেনা। আমি রাস্তায় রাস্তায় ঘোরা ছেলে; জীবনে যতটুকু এসেছি একা , সামনে পেছনে ফাঁকা । আমার তো কষ্ট পাওয়ার কিছু নেই, ওটা আগেই শেষ হয়ে গেছে । জীবন পরীক্ষাতে আমি আগেই পাশ দিয়েছি । বিনিদ্র রাতে আমি আকাশের নক্ষত্রের প্রতি তাকাই , দেখতে দেখতে ওরা আমার অতি পরিচিত হয়ে গেছে। বনেছে আমার সুখ দুঃখের সাথী , নীরব জীবনসাক্ষী ! ওরা কি মানুষের কষ্ট বুঝতে পারে ? হয়তো পারে, হয়তো পারেনা। কিন্তু এত বড় পৃথিবীতে তারকা আর বাগানের লাল গোলাপ ছাড়া আমার মনের কথা বলার আর কেউ নেই ! জীবন এ দেশে পাওয়া লুজ সিটের ক্লিপে আটকানো কাগজের সমন্বয়ের এক বন্ধন। কখন যে দমকা হাওয়ায় উড়িয়ে নিয়ে অজানায় ফেলে দেয় তা কেউ জানে না, কেউ জানতে চায়না ! অনেকগুলো মানুষকে আমি দেখেছি। তাঁরা অন্তর উজাড় করে অন্যকে নিঃস্বার্থ ভালোবাসা দিয়েছেন, বিনিময়ে কষ্ট ছাড়া আর কিছুই পান নি । তাঁরা অন্যকে সুখী করতে গিয়ে নিজেরাই অসুখী হয়ে পড়েছেন। অতৃপ্ত আত্মা নিয়ে দূর বহু দূর চলে গেছেন ! এইতো জীবন , এই নিয়তি , একটি কষ্টের জীবনের যবনিকা …!
ব্যক্তিগত অভিজ্ঞতার আলোকে জীবন কারো কাছে “তুমি যে আমার ওগো তুমি যে আমার “। অন্যের কাছে “তুমি যে আজ কত দূরে “। কারো জীবনদর্শনে ” এই যে দুনিয়া কিসেরও লাগিয়া ” । জনৈক দার্শনিকের দৃষ্টিতে “লাইফ ইজ এ টেল টোল্ড বাই অ্যান ইডিয়ট ” । আমার ভাষায় জীবন হলো “একটি গোলাপ ফুল অথবা দুনিয়াতে আগত এক নিষ্পাপ মানুষ শাস্তি পাচ্ছে। কারণ জীবন খেলায় তাকে অন্যের পাপের প্রায়শ্চিত্ত করতে হচ্ছে ! ইসলামী মতবাদে মৃত্যু হলো জীবনের খন্ডকালীন সময়ের অবসানান্তে অনন্ত যাত্রাপথে পাড়ি দেয়া। পরকালে মানুষকে পার্থিব জীবনের যাবতীয় কর্মের হিসাব দিতে হবে এবং হিসাব শেষে অনন্তকাল বর্ণনাতীত সুখ কিংবা নরকযন্ত্রণা ভোগ করতে হবে ! অনেককে বলতে শুনি, জীবন মৃত্যু পায়ের ভৃত্য। তারা সাধারণত জীবন বা মরণ নিয়ে মাথা ঘামান না। রেড ইন্ডিয়ান দুবাসিস গোত্রের প্রধান সিটলের মতে ” মৃতরা অক্ষম নন । আসলে মৃত্যু বলে কিছু নেই- এটা শুধু জগতের পরিবর্তন মাত্র” । আরেক কবির ভাষায় ” জন্মিলে মরিতে হবে , অমর কে কোথা রবে চির স্থির করে নীড় , হায়রে জীবন নদে “! রবীন্দ্রনাথের গানের মতো ” তোরা যে যা বলিস ভাই আমার সোনার হরিণ চাই “। মূলত প্রত্যেককে ইচ্ছায় বা অনিচ্ছায় মৃত্যুর স্বাদ গ্রহণ করতেই হবে । কেনই বা এলাম , কেন যেতে হবে কারণ অজানা। চির সত্য চলে যেতে হবে এ গোলাপ ফুল বা পথ মানুষের জীবন হতে …!
আমার বয়স তখন কত হবে বড় জোর ৭/৮। সে বয়সেই বিবেক ও আবেগ দুটোই প্রখর ছিল । অনুভূতি আমায় কোন কিছুতেই ছাড় দিতে অনুমোদন করতো না । এই বয়সেই আমার ফুপা হঠাৎ হার্ট অ্যাটাকে মারা গেলেন । পুরা পরিবার যেন এক মহাসমুদ্রে ডুবে হাবু ডুবু খেতে লাগলো । আমাদের দেশে পরিবারের বড় কেউ মারা গেলে প্রথম যে ভাবনা আসে ,তাহলো গোটা পরিবারকে এখন ভরণ- পোষণ কে করবে? আমি আমার মাকে বার বার জিজ্ঞেস করতাম, নাহিয়াদের এখন কে খাওয়াবে । মা বলতেন আল্লাহ মুখ দিয়েছেন আহার তো দিবেনই ! তোমার চেয়ে তার চিন্তা বেশি। তুমি ভেবনা সব ঠিক হয়ে যাবে । একান্নবর্তী পরিবারের একমাত্র উপার্জনক্ষম ব্যক্তি হিসেবে কাকা যখন ঢাকা ইন্টার কন্টিনেন্টালে কাজ পেলেন তখন গোটা পরিবারটি যেন নতুন করে আলোর মুখ দেখল ও নতুন করে বাঁচার শপথ নিল । আমার বড্ড খুশী লাগতো যখন দেখতাম ওরা আমাদের চেয়ে ভাল আছে ও সুখে আছে । ভাল দামী কাপড় পরে দামী বড় মাছের বাজার আসে । কথাটা এজন্য মনে এলো সাম্প্রতিক জীবনে সে দৃশ্য বিরল । কাজিনরা একে অপরের ভাল থাকার কামনা করা তো দূরে থাক, হানাহানি পীড়াপীড়িতে জর্জরিত । সেই নাহিয়া দেশে ভাল কিছু করতে পারছিল না , বেকার, ভবঘুরে। আমি তখন দুবাই থাকি । ভাল চাকরিতে আমার ঢাকা থেকে বদলি হয়েছিল । দেশে ছুটিতে আসা হতো মাঝে মাঝে । এক ছুটিতে কাকা ও ফুপু শক্ত করে ধরলেন আমার কাছে নেয়ার জন্য । বাড়ির সবাই শঙ্কিত ওকে নিয়ে; দেশের অবস্থা ভালনা কখন কি হয় ? আমি তাঁদের বুঝালাম সে কাজ- কর্ম কিছু জানে না, কিভাবে চাকরি পাবে । এটা অসম্ভব তার চেয়ে আমি কিছু পয়সা দেই কোন এজেন্সী ধরে অন্য কোথা যেতে বলেন । সেটা তারা পারলেন না। কাজেই দায়িত্বটা আমার উপর রয়ে গেল । হিউম্যান রিসোর্স ম্যানেজারকে বলে কয়ে নাহিয়াকে বিনা পয়সায় ভিসা ও চাকরি দিয়ে দুবাই নিয়ে এলাম । তার জীবনের মোড় ঘুরে গেল। আমি দূরে সরে গেলাম । এর পর আমাদের মতো পরিবারে যা হয় সে যোগাযোগ বন্ধ করে দিলো । ফেস বুকে কানেকশন থাকলেও হায় বলতেও তার কষ্ট হয় । দিন চলে গেছে এ দিন আর সেদিন নেই । আমি আত্মীয়দের যাকেই ভাল কিছু করেছি তারাই আমায় ভাল জীবন শিক্ষা দিয়েছে । এখন আগের চেয়ে অনেক বেশি অভিজ্ঞ, আমি অনেক জান্তা। মা বলতেন উপকারীরে বাঘে খায়- আগে বিশ্বেস না করলেও তাতে আমি এখন নিশ্চিত হয়ে গেছি । নিউইয়র্ক।