জিয়াউদ্দিন আহমেদ
ফজলে হাসান আবেদ ভাই সম্পর্কে আমাদের আবেগের শেষ নেই। যত জানতাম, তত অবাক হতাম। আমার এক বন্ধু বলতে পৃথিবীতে সত্যিকারের সম্মান করার মতো মানুষের এত অভাব যে বড় কষ্ট হয়। আবেদ ভাই সেই কষ্ট অনেকটা লাঘব করেছেন। অনেক কিছুর মধ্যে কয়েকটি স্মৃতি আমাকে বেশ তাড়া করে ফেরে।
বহু বছর ধরে মানুষ ব্র্যাকের সাহসী ও মহান কাজগুলোর কথা জানত কিন্তু কোনো দিন তাতে আবেদ ভাইয়ের নাম আসত না। তিনি হেসে বলতেন, সময় হলে মানুষ এমনিই জানবে। বেশি জানলে বিপদও বেশি হয়। সমাজের উন্নতিতে অবদান রাখায় অনেক দিন আগে জাতিসংঘের পক্ষ থেকে তিনি একটি পুরস্কার পেলেন। প্রথমটি পেয়েছিলেন ব্রাজিলের প্রেসিডেন্ট, দ্বিতীয়টি আবেদ ভাই। আমাদের যেতে বললেন অনুষ্ঠানে। ফিলাডেলফিয়া থেকে আমরা দুজন হাজির। ছোট হল। কিছুসংখ্যক বাঙালি, সবই তার ঘনিষ্ঠজন। সংবাদপত্রকে খবর দেওয়া হয়নি। প্রচার বিমুখতা। অনুষ্ঠানেই শুরুতে চারজন আন্তর্জাতিক বিচারক ভিডিও করা বক্তব্যে আবেদ ভাইকে কেন পুরস্কার দেওয়া হলো, তার সুন্দর ও শক্তিশালী ব্যাখ্যা দিলেন। ইউএনডিপির সভাপতি বললেন, ‘আমি যদি ফজলে হাসান আবেদের মতো সারা পৃথিবীতে আরো ছয়জন মানুষ পেতাম, তাহলে পৃথিবীর খাদ্য সমস্যাসহ বহুবিধ শক্ত সমস্যা আমি সহজেই মোকাবিলা করতে পারতাম।’ তিনি আরো বললেন, ‘আফগানিস্তান যখন প্রথমে তালেবানদের দখলে এবং সকল স্বাস্থ্যসেবা বন্ধ হয়ে গেল, আমি যখন আন্তর্জাতিক সকল এনজিওর মিটিংয়ে এই বিরাট বিপর্যয়ে তাদের সহায়তার জন্য অনুরোধ করলাম কিন্তু সব চুপ, কেউ সাড়া দিল না। শুধু ছোট একটি হাত উঠল। সেটি ছিল ফজলে হাসান আবেদের হাত। পৃথিবীর সকল দেশ যখন মুখ ফিরিয়ে নিল, তখন তার সেই শক্ত হাত ধরে ব্র্যাক আফগানিস্তানের সকল কমিউনিটি হেলথ সেন্টারের দায়িত্ব নিয়ে নিল। কেউ জানল না এত বড় একটি কাজ নীরবে করে গেলেন।’ আবেদ ভাই তার বক্তব্যে অত্যন্ত বিনয়ের সঙ্গে শুধু বললেন, ‘এর সব কৃতিত্ব আমার সহকর্মীদের, যারা জীবনের ঝুঁকি নিয়ে আফগানিস্তানের প্রত্যন্ত অঞ্চলে কাজ করে যাচ্ছেন। আমি তাদের পক্ষ থেকে এই সম্মাননা গ্রহণ করলাম।’ আমরা মন্ত্রমুগ্ধের মতো শুনলাম। গর্বে বুক ভরে উঠল। দেখলাম, ওদের কোনো অফিশিয়াল ভিডিওগ্রাফার নেই, শুধু আমিই ভিডিও করলাম পুরো অনুষ্ঠান। দুই বছর পর ঢাকায় তাকে আমার মহামূল্যবান ভিডিওর কপিটি দিলাম কিন্তু তিনি একটু হেসে টেবিলের নিচে রেখে দিলেন। পরে শুনলাম, এই অসামান্য ভিডিওটি ব্র্যাকের কেউ কোনো দিন দেখেনি। তবে কেন জানি আমার কোনো কষ্ট হয়নি বরং একটি সুন্দর অনুভূতি আচ্ছন্ন করেছিল।

যখনই কিছু আলাপ করতাম, তিনি মনোযোগ দিয়ে শুনতেন এবং আমার পাগলামিগুলো বোঝার চেষ্টা করতেন। আমার মনে হলো কোনো অঞ্চলের উন্নতি করতে হলে প্রবাস থেকে ওই অঞ্চলের লোকদের একত্রিত করতে হবে। দুবার নিউইয়র্কে জালালাবাদ সমিতির ছায়াতলে সিলেট সম্মেলন করলাম। প্রথমটি ২০ বছর আগে আর শেষটি ২০১৭ সালে। দুবারই আবেদ ভাইকে প্রধান অতিথি করলাম। আর কাউকে এই সম্মান করতে পারিনি। নিজ খরচেই তিনি এলেন দুবার। চাইলেন সিলেটের উন্নতির জন্য প্রবাসীদের এই আবেগ এবং উৎসাহ যেন কাজে লাগে। তবে দ্বিতীয়বারের পর বিশ্ব সিলেট সম্মেলন বেশ গতিশীল হলো এবং চলমান একটি প্রক্রিয়াও তৈরি হলো।
সিলেটে কিডনি ফাউন্ডেশন হাসপাতাল তৈরি করব বলে ঠিক করলাম। আবেদ ভাই বললেন, ‘আমি আছি তোমার সাথে।’ তিনি ডা. জাফরুল্লাহকে ৮ কোটি টাকা দিয়েছেন আর ড. ইউনূসের কাছ থেকে ৮ কোটি নিয়ে দিয়েছেন। আমি ভাবলাম, আমরাও নিশ্চয় একই পরিমাণ অর্থ পাব। আবেদ ভাই বললেন, সবাইকে ফ্রি ডায়ালাইসিস দিয়ো। বললাম, দিতে তো চাই কিন্তু এত টাকা কোথায় পাব? আবেদ ভাই একটু হেসে বললেন, ভালো মানুষ ভালো কাজ করলে পয়সার অভাব হয় না। কিন্তু আবেদ ভাই হঠাৎ করে চলে গেলেন। ধাক্কা খেলাম কিন্তু মনে হলো এটি একটি ইশারা। বড় অনুদান নিয়ে কাজ করা থেকে বিরত হয়ে সাধারণ মানুষকে সম্পৃক্ত করে তাদের মানবিক চেতনাকে অনুপ্রাণিত করে যদি কাজ করা যায়, তাহলে রোগীদের ডায়ালাইসিসের খরচ সহজে জোগাড় করা সম্ভব। অনেকে মিলে ছোট ছোট অনুদান দিলে আমরা মারা গেলেও সেটি অব্যাহত থাকবে। লন্ডনে এই উৎসাহ দেখা দিয়েছে, অনেকেই দুঃখী মানুষের জন্য কিছু করতে চায়। যেহেতু কিডনি ফাউন্ডেশন সম্পূর্ণ অলাভজনক প্রতিষ্ঠান এবং ট্রাস্টি বোর্ড চালাবে, তাই এটি মানুষের আস্থা অর্জন করতে পারবে। একে অনুসরণ করে বাংলাদেশে আরো সংগঠন হয়তো তৈরি হবে আর বিপন্ন মানুষকে বিনা পয়সায় চিকিৎসা দেওয়ার আবেদ ভাইয়ের স্বপ্ন কিছুটা হলেও বাস্তবায়িত হবে।
আবেদ ভাই ১৯৭২ সালে ব্র্যাক প্রতিষ্ঠা করার সময় প্রতিজ্ঞা করেছিলেন, নিজের জন্য কোনো সম্পত্তি করবেন না। কারণ এনজিওতে কাজ করলে মানুষের আস্থা অর্জন করা জরুরি। তাই তিনি নিজস্ব অ্যাওয়ার্ডের টাকাও অফিসে দিয়ে দিতেন। আবেদ ভাই যখন চলে গেলেন, তখনো ওনার নামে কোথাও কোনো ঘর বা সম্পত্তি ছিল না। তার মৃত্যুর প্রাক্কালে এই কথাটা আমার লেখায় উল্লেখ করলে প্রথম আলোর সম্পাদক তা কেটে দিলেন। এত বড় এবং অবিশ্বাস্য খবর নাকি তার মুখ থেকে না এলে তারা তা ছাপতে পারবেন না। সাংবাদিকের কী দোষ, তবে তাকে বোঝানোর মতো ইচ্ছা আমার ছিল না, এখনো নেই। আমি আবেদ ভাইয়ের মেয়ে তামারাকে কল করে জিজ্ঞেস করলাম, শেষ পর্যন্ত কি তার কোনো সম্পত্তি ছিল না? সে বলল, শেষ সময়েও তিনি কোনো সম্পত্তি করে যাননি। আমি অনেকক্ষণ চুপ করে ছিলাম। এত বড় সাহস আর মন ছিল আমাদেরই একজনের কিন্তু তিনি বেঁচে থাকতে কেউ জানতেই পারল না। হঠাৎ করে অসুস্থ হলে তিনি যখন
জানলেন তার ব্রেন টিউমারটি অপারেশন করলেও মাত্র ১০ শতাংশ বাঁচার সম্ভাবনা আছে, তখন তিনি বললেন, আমি অপারেশন করব না। আমরা আমেরিকা আর ইউরোপের ডাক্তারদের সঙ্গে তাকে কথা বলিয়ে দিলাম। কিন্তু তিনি অনড়। বললেন, আমি শেষ দিনগুলো শান্তিতে থাকতে চাই। আবেদ ভাইয়ের এই সাহস দেখে অনেকেই হতবাক। বিনম্র কণ্ঠে বললেন, আমি সৃষ্টিকর্তার কাছে কৃতজ্ঞ, কারণ আমি আমার জীবনটা সম্পূর্ণ বৃথা যেতে দিইনি। কী সুন্দর অভিব্যক্তি! তাই সময় পেলেই তার কথা আলোচনা করি। তার গভীরতার বিস্ময় অনুধাবন করার চেষ্টা করি। যদি এই বিশাল মহতী মানুষটির স্মৃতি হাতড়ে নিজের জন্য কিছু আহরণ করতে পারি।
লেখক : বীর মুক্তিযোদ্ধা, বিশেষজ্ঞ চিকিৎসক, গবেষক ও কলামিস্ট, ফিলাডেলফিয়া