স্যালুট গণতন্ত্র : আমেরিকার কাছে এখনো শিক্ষণীয় আছে

এম এম শাহীন : সব সংশয়-সন্দেহের অবসান ঘটিয়ে অবশেষে বিশ্বের প্রতিষ্ঠিত গণতান্ত্রিক দেশ মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের ৪৬তম প্রেসিডেন্ট হিসেবে ডেমোক্র্যাটিক দলীয় জো বাইডেন এবং ভাইস প্রেসিডেন্ট হিসেবে ভারতীয় বংশোদ্ভূত কমলা হ্যারিস ২০২১ সালের ২০ জানুয়ারি দায়িত্বগ্রহণ করতে যাচ্ছেন। এই নির্বাচনে যুক্তরাষ্ট্রের জনগণ একজন রাজনৈতিক অভিজ্ঞ, মানবিক গুণসম্পন্ন মানুষকে নতুন প্রেসিডেন্ট নির্বাচিত করেছে।
সারাবিশ্ব যখন করোনাভাইরাস মহামারিতে পর্যুদস্ত, বিশেষ করে যুক্তরাষ্ট্র, ঠিক এ রকম এক ঐতিহাসিক পরিস্থিতিতে ২০২০ সালের নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়েছে। এ কারণেই এই নির্বাচন ব্যাপকভাবে বিশ্ববাসীর দৃষ্টি আকর্ষণ করেছে। এই নির্বাচনে অনেক রেকর্ড তৈরি হয়েছে। যেমন- যুক্তরাষ্ট্রের ইতিহাসে রেকর্ড পরিমাণ ভোট পড়েছে; নবনির্বাচিত প্রেসিডেন্ট জো বাইডেন রেকর্ড পরিমাণ ভোট পেয়ে জিতেছেন, যা এর আগে কোনো প্রেসিডেন্ট পাননি; যুক্তরাষ্ট্রের ইতিহাসে সর্বপ্রথম একজন নারী ভাইস প্রেসিডেন্ট হিসেবে নির্বাচিত হয়েছেন, যিনি আবার বর্ণে সাদা ননÑআধা ভারতীয় ও আধা ক্যারিবিক; হাড্ডাহাড্ডি লড়াই হয়েছে অধিকাংশ অঙ্গরাজ্যে; রেকর্ড পরিমাণ মানুষ ডাকযোগে ভোট দিয়েছে, যা এর আগে কখনোই ঘটেনি; পরাজিত প্রার্থী ডোনাল্ড ট্রাম্পও রেকর্ড পরিমাণ ভোট পেয়েছেন, যে পরিমাণ ভোট অতীতে কোনো জয়ী প্রার্থীও পাননি এবং ভোট গণনায় এত দীর্ঘসময় নিকট অতীতে প্রয়োজন হয়নি।
মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট নির্বাচন বিশ্বব্যাপী, বিপুল উৎসাহের সঙ্গে অনুসরণ করা হয়ে থাকে। সাধারণভাবে যুক্তরাষ্ট্রে নির্বাচনের দিন ভোটগ্রহণ শেষ হওয়ার পর থেকেই অঙ্গরাজ্য অনুযায়ী ফলাফল ঘোষণা হতে থাকে। বিভিন্ন টাইম জোনের কারণে ভোটকেন্দ্র বিভিন্ন সময়ে বন্ধ হলেও নির্বাচনের দিন শেষ রাতেই কোন প্রার্থী বিজয়ী হবেন, সে সম্পর্কে মোটামুটি ধারণা পাওয়া যায় এবং ভোটের প্রবণতার ভিত্তিতে যে প্রার্থী ২৭০ বা এর বেশি ইলেকটোরাল কলেজ ভোট পাবেন, তা নিশ্চিত করে সংবাদমাধ্যমগুলো সম্ভাব্য বিজয়ী প্রার্থীর নাম ঘোষণা করে থাকে। সাধারণভাবে এ ধরনের ঘোষণার পর বিজিত প্রার্থী বিজয়ী প্রার্থীকে অভিনন্দন জানান এবং ক্ষমতার পালাবদলের কাজ শুরু হয়।
কিন্তু এবারের নির্বাচনে তার কিছুই ঘটেনি। প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প নির্বাচনের আগেই আভাস দিয়েছিলেন, তিনি পরাজয় মেনে নেবেন না। সে অনুযায়ী পরাজয় আঁচ করতে পেরেই তিনি ভোট কারচুপির অভিযোগে ফলাফল বাতিল, পুনর্গণনা, ঘোষণা বাতিল ইত্যাদি দাবি নিয়ে আদালতের দ্বারস্থ হন। সেসব দাবির পক্ষে প্রমাণ ও ভিত্তি না থাকায় আদালত একের পর এক মামলা নাকচ করে দেন। আদালতের সিদ্ধান্তের পরিপ্রেক্ষিতে সংবাদ সংস্থাগুলো নির্বাচনের চারদিন পর, ৭ নভেম্বও, ডেমোক্র্যাটিক পার্টির প্রার্থী জো বাইডেনকে ‘সম্ভাব্য বিজয়ী’ বলে সংবাদ প্রকাশ করে। তা সত্ত্বেও প্রেসিডেন্ট ট্রাম্প নিজেকে ‘বিজয়ী’ বলে দাবি করে মামলা চালিয়ে যেতে থাকেন। ফলে ক্ষমতার পালাবদলে একটি অচলাবস্থা সৃষ্টি হয়। প্রেসিডেন্ট ট্রাম্প নির্বাচনকে প্রশ্নবিদ্ধ করে একবার পরাজয় মেনে নিচ্ছেন তো পরক্ষণেই আবার তা অস্বীকার করছেন। নির্বাচনে গণরায়কে অস্বীকার করে ট্রাম্প চরম ভুল করেছেন বলে অনেকেরই অভিমত। কিন্তু ট্রাম্প যা-ই করুন না কেন, তাকে হোয়াইট হাউস ছাড়তেই হচ্ছেÑএর কোনো বিকল্প নেই।
এবারের মার্কিন নির্বাচন নিয়ে জল বেশ ঘোলা হলেও আমি মনে করি, এই নির্বাচন থেকেও আমেরিকার কাছে বাকি বিশ্বের অনেক কিছু শেখার আছে। বিশ্বের যেসব দেশে স্বৈরতন্ত্র, একনায়কতন্ত্র কিংবা রাজতন্ত্র প্রচলিত আছে, সেসব দেশের কথা ভিন্ন। কিন্তু গণতান্ত্রিক দেশগুলো, বিশেষ করে দুর্বল গণতান্ত্রিক দেশ কিংবা গণতন্ত্রের লেবাসে যেসব দেশে স্বৈরতন্ত্র বা একনায়কতন্ত্র চলছে, সেসব দেশের জন্য মার্কিন নির্বাচন অবশ্যই অনুকরণযোগ্য। ব্যক্তির চেয়ে দল বড়, দলের চেয়ে দেশ- এই আপ্ত বাক্যটি এবারের নির্বাচনে অক্ষরে অক্ষরে রক্ষা করেছেন মার্কিন জনগণ। দলমত-নির্বিশেষে মার্কিন ভোটাররা নিজ দেশের স্বার্থকেই বেছে নিয়েছেন। নির্বাচনের পর ট্রাম্প যখন পরাজয় মেনে নিতে নানা টালবাহানা, প্রমাণহীন নানা অভিযোগ এনে একের পর এক মামলা দায়ের, সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে একের পর এক মিথ্যাচার, বিরোধী পক্ষকে কটাক্ষ, ফলাফল পাল্টে দিতে নিজ দলের নির্বাচনী কর্মকর্তাদের অনৈতিক প্রস্তাব ও হুমকি-ধমকি আর মিডিয়ার প্রতি বিষোদ্গার করে চলছিলেন; তখন তার কিছু কট্টর সমর্থক ছাড়া কাউকে পাশে পাননি তিনি। মিডিয়াসহ ট্রাম্পের দল রিপাবলিকান পার্টির অনেক নেতা, ট্রাম্পেরই নিয়োগ করা অনেক নির্বাচনী কর্মকর্তা, তারই নিয়োগকৃত অনেক বিচারক, এমন কি তার পরিবারের অনেক সদস্যও তার অনৈতিক কর্মকাণ্ডকে সমর্থন না করে উল্টো বিরোধিতা করেছেন। বিশ্বের অনেক দুর্বল গণতান্ত্রিক দেশে দলের প্রধান কিংবা সরকারপ্রধান যা বলেন, তার অনুসারীরা কোনো ধরনের ন্যায়-অন্যায়ের বাছবিচার না করেই তার কথা বা কর্মকাণ্ডকে প্রতিষ্ঠিত করতে সর্বশক্তি নিয়োগ করেন। দলীয় প্রধানের বিরাগভাজন হওয়ার ভয়ে দলের লোকজন প্রয়োজনে বিরোধী পক্ষের ওপর পেশিশক্তি, অস্ত্রশক্তির ব্যবহার করেন। তাতে ব্যর্থ হলে প্রশাসনযন্ত্রকে কাজে লাগিয়ে বিরোধী পক্ষকে দমন করেন। বেশির ভাগ ক্ষেত্রে তারা দেশ ও দলের ইমেজকে ক্ষুণ্ন করে হলেও ব্যক্তিমতকে প্রাধান্য দেন। আর যদি দু-একজন এর বিরোধিতা করেন, তাহলে তার ওপর নেমে আসে শাস্তির খড়্গ। কিন্তু মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের এবারের নির্বাচনে আমরা লক্ষ করলাম, মহাপরাক্রমশালী ট্রাম্পের অন্যায় ও অযৌক্তিক দাবির কাছে তার দলীয় ও কাছের লোকজনও মাথানত করেননি। তারা ব্যক্তি ট্রাম্পের পক্ষে না দাঁড়িয়ে গণতন্ত্রের পক্ষে, দেশের পক্ষে দাঁড়িয়েছেন। এটাই মার্কিন গণতন্ত্রের সৌন্দর্য। এক ট্রাম্পের অযাচিত কর্মকাণ্ডে এই গণতন্ত্র কিছুটা কলুষিত হলেও মার্কিন জনগণ একে ভেঙে পড়তে দেননি। অর্থাৎ রাজনৈতিক সততার অনন্য উদাহরণ এবার আমরা যুক্তরাষ্ট্রের নির্বাচনে দেখেছি। এখান থেকে বাকি বিশ্ব দীক্ষা নিতে পারে।
নির্বাচনের পরপর আমরা দেখতে পাই, একই দলের সিনেটর এবং রাজ্যের গভর্নর হয়েও নির্বাচনের নিরপেক্ষতা বজায় রাখার জন্য তারা ট্রাম্পের অনাকাক্সিক্ষত আবদারের পক্ষে কথা বলেননি। নির্বাচনে দলীয় প্রার্থী ট্রাম্প হারলেও গণতন্ত্রকে পরাজিত হতে তারা দেননি। দলীয় সমর্থক বলে পরিচিত সংবাদমাধ্যমগুলোকেও কিন্তু ট্রাম্পের পাশে দাঁড়াতে দেখা যায়নি। তারাও কিন্তু ‘দলকানা’ সমর্থক হিসেবে অবস্থান না নিয়ে গণতন্ত্রের পাশে দাঁড়িয়েছে। ট্রাম্পের সমর্থক হিসেবে পরিচিত ফক্স নিউজের এক উপস্থাপককে বলতে শোনা গেছে, ‘যুক্তরাষ্ট্রের পরবর্তী প্রেসিডেন্ট জো বাইডেন। এর বাইরে যদি কেউ কিছু বলে, তাহলে তিনি মিথ্যাবাদী।’
বরাবরের মতো এবারের নির্বাচনেও মার্কিন প্রশাসন, সামরিক বাহিনী, আদালত ও সংবাদপত্র ছিল নিরপেক্ষ। নির্বাচনের আগেই মার্কিন প্রতিরক্ষা বাহিনীর পক্ষে ঘোষণা দেয়া হয়, নির্বাচনের ফলাফল কার্যকর করার ক্ষেত্রে তারা কোনো ভূমিকা রাখবে না। ট্রাম্প ক্ষমতায় বহাল থাকার চেষ্টার অংশ হিসেবে সামরিক বাহিনীকেও কাজে লাগাতে পারেন, এমন চিন্তার কথা প্রকাশ পাওয়ার পর যুক্তরাষ্ট্রের সামরিক বাহিনীর জয়েন্ট চিফ অব স্টাফের ২০তম চেয়ারম্যান জেনারেল মার্ক এ মেলি সময়োপযোগী এক বক্তব্য দেন। তিনি একটি সামরিক জাদুঘরের অনুষ্ঠানে বক্তব্য দিতে গিয়ে বলেন, ‘আমি যখন বিভিন্ন সামরিক স্থাপনা সফরে যাই, তখন সাধারণ সৈনিকদের চোখে ও কণ্ঠে দেশের নিরাপত্তা ও সংবিধান সংরক্ষণের তীব্র আকাক্সক্ষার ছায়া দেখি ও শুনতে পাই। আমরা সৈনিক হিসেবে কোনো রাজা বা রানির সেবার জন্য শপথ গ্রহণ করিনি, আমরা কোনো স্বৈরাচারকে রক্ষা করার জন্য শপথ গ্রহণ করিনি, আমরা কোনো ব্যক্তিবিশেষের স্বার্থরক্ষায় শপথ গ্রহণ করিনি, আমরা কোনো ট্রাইব বা ধর্মকে রক্ষা করার জন্য শপথ নিইনি, আমরা সংবিধানকে সমুন্নত রাখার শপথ নিয়েছি।’
কেবল সামরিক ও বেসামরিক প্রশাসন নয়, বিচার বিভাগও চূড়ান্ত নিরপেক্ষতার পরিচয় দেয়। ভাবা হচ্ছিল, যেহেতু সুপ্রিম কোর্টে রক্ষণশীল বিচারকদের সংখ্যাগরিষ্ঠতা আছে, তারা ট্রাম্পকে জিতিয়ে দেওয়ার জন্য রায় দিতে পারেন! নির্বাচনের দিন সুপ্রিম কোর্টের একজন বিচারক কেবল কিছু ভোট আলাদা করার নির্দেশ দেন, যা নির্বাচনের ফলাফলে প্রভাব ফেলেনি। সবচেয়ে উল্লেখযোগ্য বিষয় ছিলÑ অঙ্গরাজ্যগুলোতে প্রশাসনিক ও বিচারিক ক্ষমতার বিকেন্দ্রীকরণ ও সেখানকার প্রশাসন ও বিচার বিভাগের নিরপেক্ষতা। পেনসিলভানিয়ার বিচারক একসময় রিপাবলিকান পার্টির কর্মকর্তা ছিলেন, তিনি প্রমাণের অভাবে ভোট কারচুপির অভিযোগ কেবল নাকচ করেননি, বরং এ জন্য কৌঁসুলিদের তিরস্কারও করেন। বিভিন্ন অঙ্গরাজ্যে, যেমন জর্জিয়া ও নেভাদায় রিপাবলিকান গভর্নর এবং অন্য কর্মকর্তারা প্রেসিডেন্ট ট্রাম্প ও দলীয় নেতাকর্মীদের সমালোচনা সত্ত্বেও নির্বাচনে কারচুপির অজুহাত নাকচ করে ডেমোক্র্যাটিক পার্টির প্রার্থীর বিজয়ের ঘোষণা দিয়েছেন। এমন কি রিপাবলিকান পার্টি নিয়োজিত ক্যানভাসাররাও প্রেসিডেন্ট ও দলের চাপ সত্ত্বেও দলীয় সংকীর্ণতার ঊর্ধ্বে উঠে মিশিগানে ডেমোক্র্যাটিক পার্টির প্রার্থীর বিজয়ের ঘোষণা দিয়েছেন। ট্রাম্প পরাজয় স্বীকার না করলেও যুক্তরাষ্ট্রের বড় বড় ব্যবসায়িক প্রতিষ্ঠান ও সংগঠন বাইডেনের দিকে ঝুঁকতে শুরু করেছে। তাদের অনুসরণ করে অন্যান্য গুরুত্বপূর্ণ প্রতিষ্ঠান ও সংগঠন বাইডেন সরকারকে সহযোগিতার কথা ব্যক্ত করেছে।
সংবাদপত্রগুলোর ভূমিকাও ছিল প্রশংসনীয়। মূলধারার সংবাদমাধ্যমগুলোকে প্রেসিডেন্ট ট্রাম্প ‘ভুয়া’ বলে আখ্যায়িত করলেও তারা তাদের করণীয় বিষয়ে অবিচল থাকে। ফক্স নিউজ, যা ট্রাম্পের সমর্থক বলে পরিচিত, তারাও অ্যারিজোনায় ডেমোক্র্যাটিক পার্টির প্রার্থীকে সম্ভাব্য বিজয়ী ঘোষণা দিয়ে প্রেসিডেন্ট ট্রাম্প ও রিপাবলিকান পার্টির সমর্থকদের তীব্র সমালোচনার সম্মুখীন হয়। অন্যান্য সংবাদমাধ্যমের মতো তারাও ৭ নভেম্বর জো বাইডেনকে প্রেসিডেন্ট নির্বাচনে সম্ভাব্য বিজয়ী বলে ঘোষণা করে। মিথ্যা বক্তব্য দেওয়ার কারণে সিএনএন ও এএফপি ট্রাম্পের ভাষণ সরাসরি সম্প্রচার বন্ধ করে দেয়, যা নজিরবিহীন ঘটনা। বিভ্রান্তিকর তথ্য দিচ্ছেন এমন অভিযোগে ট্রাম্পের অফিশিয়াল টুইট পেজের একটি পোস্ট মুছে ফেলা হয়। ট্রাম্প টুইট বার্তায় অভিযোগ করেন, ‘গেল রাতে আমিই এগিয়ে ছিলাম। যদিও ডেমোক্র্যাটরা সব জায়গা নিয়ন্ত্রণ করছে। একটার পর একটা ব্যালট বিস্ময়করভাবে খুঁজে পাওয়া যাচ্ছে না। খুবই আশ্চর্যজনক।’ এই পোস্টটি মুছে দেয় টুইটার।
মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে এর আগে কোনো প্রেসিডেন্টকে মূলধারার মিডিয়ার এমন চরম বিরোধিতার মুখে পড়তে হয়নি। মিডিয়ার সমর্থন নিয়েই তারা তাদের প্রেসিডেন্ট থাকার সময়কাল শেষ করেছেন। মিডিয়া তাদের একটা উজ্জ্বল ইমেজ দেশে এবং বহির্বিশ্বে তুলে ধরেছে। ফলে অন্তত জাতীয়ভাবে মূলধারার জনগোষ্ঠীর কাছে মার্কিন প্রেসিডেন্টরা একটা ইতিবাচক ইমেজ নিয়েই ক্ষমতা থেকে বিদায় নিয়েছেন। ট্রাম্প হচ্ছেন মার্কিন ইতিহাসে একমাত্র প্রেসিডেন্ট, মিডিয়া যার পুরো নেতিবাচক ইমেজ তৈরি করেছে। কিন্তু ট্রাম্প গত চার বছর ধরে বলে আসছেন, তার নিজের দেশের মিডিয়া ফেইক বা ভুয়া নিউজ তৈরি করে নিজেদের সুবিধামতো। এ কারণে তিনি তার নিজের দেশের মিডিয়ার বিরাগভাজন হন।
সংবাদপত্র হলো একটি রাষ্ট্রের চতুর্থ স্তম্ভ। মার্কিন মিডিয়া শত বাধার মুখেও তার কক্ষপথ থেকে বিচ্যুত হয়নি। কারো প্রতি পক্ষপাতদুষ্ট আচরণ না করে এই নির্বাচনে তারা কথা বলেছে দেশ, মানুষ ও গণতন্ত্রের পক্ষে। এমন কি ট্রাম্পের একান্ত অনুগত মিডিয়াগুলোও দেশ ও গণতন্ত্রের মর্যাদা ক্ষুণ্ন হয়, এমন কর্মকাণ্ডে আপস করেনি। বাংলাদেশসহ সারা বিশ্বের মিডিয়াকর্মীরাও এ থেকে শিক্ষা নিয়ে ব্যক্তিস্বার্থ নয়, দেশ ও জনগণের স্বার্থে সত্য কথা বলার মতো সাহস অর্জন করতে পারেন।
এত কিছুর পরও যদি ট্রাম্পের শুভবুদ্ধির উদয় না ঘটে, তাহলে সামনে তাকে কঠিন পরীক্ষার সম্মুখীন হতে হবে। তার হাতে সময়ও বেশি নেই। মাত্র ১ সপ্তাহ পরই আগামী ১৪ ডিসেম্বর ইলেকটোরাল মিটিংয়ের দিনেই ট্রাম্পের ভাগ্য নির্ধারিত হয়ে যাবে। তিনি পরাজয় স্বীকার করুন বা না করুন, ক্ষমতা তাকে ছাড়তেই হবে এবং তারপর তার বিরুদ্ধে রুজু করা মামলার মুখোমুখি হতে হবে। এসব মামলার যেকোনোটিতে যদি জেল হয়ে যায়, তাহলে তার জনসমর্থনের পারদও তখন নিজ থেকেই নিম্নগামী হতে শুরু করবে, তাতে সন্দেহ নেই। তখন হয়তো রাজনীতির পথই তাকে ছেড়ে দিতে হতে পারে।
এদিকে নির্বাচনে জয় নিশ্চিত হওয়ার পরপরই জো বাইডেন ঘোষণা দিয়েছেন, তিনি ‘সব আমেরিকানদের প্রেসিডেন্ট’। অর্থাৎ বিভাজন নয়, ঐক্য। নির্বাচনের ফলাফলের পর প্রতিপক্ষ বলে কিছু নেই। শ্বেতাঙ্গ-কৃষ্ণাঙ্গ-বাদামি সবাই আমেরিকান। সবার সমান অধিকার রাষ্ট্রের চোখে, বিচারালয়ের পক্ষে। তিনি বিরোধী পক্ষকে একই বিবেচনায় রাখবেন। ঘোষণাটি অনেকের জন্য স্বস্তির কারণ হলেও ট্রাম্প শিবির এবং রিপাবলিকানদের দিক থেকে এখনো বরফ গলার তেমন কোনো লক্ষণ স্পষ্ট হয়ে উঠছে না।
এটা ঠিক, নবনির্বাচিত প্রেসিডেন্ট জোসেফ রবিনেট বাইডেন আমলাতন্ত্রের বেড়াজাল এবং গত চার বছরের জঞ্জাল পরিষ্কার করে রাতারাতি কোনো পরিবর্তন সাধন হয়তো করতে পারবেন না। তবে আমার বিশ্বাস, নিঃসন্দেহে তিনি চেষ্টা করবেন জনকল্যাণে কাজ করতে। বিশ্ব রাজনীতিরও রাতারাতি কোনো পরিবর্তন হবে নাÑএটাও নিশ্চিত। কিন্তু যে ক্ষতিকর অবস্থার মধ্যে তা এগিয়ে যাচ্ছিল, সেটাতে তিনি নিশ্চিতভাবেই লাগাম টানবেন। তার অতীত কার্যকলাপ তাই-ই বলে। এই মহতী নেতার কাছে আমরা আশা করব, তিনি শুধু আমেরিকান ব্লক নন, সব ব্লককে সমান চোখে দেখে বিশ্ব শান্তিকে এগিয়ে নেবেন। ইহুদি, মুসলমান, বৌদ্ধ, খ্রিষ্টান বা হিন্দু বিবেচনায় নয়, ধর্মনিরপেক্ষতার ভিত্তিতে যুক্তরাষ্ট্রসহ বিশ্ব শান্তিকে এগিয়ে নিতে অগ্রণী ভূমিকা রাখবেন। পাশাপাশি যুক্তরাষ্ট্রে যে ৭ কোটি ৪০ লাখ ভোটার ডোনাল্ড ট্রাম্পকে ভোট দিয়ে তার প্রতি সমর্থন দিয়েছেন, তাদেরও সমান গুরুত্ব দিয়ে আস্থায় নিতে সক্ষম হবেন।
সবশেষে বলব, সদ্য শেষ হওয়া নির্বাচনে যুক্তরাষ্ট্রের বেসামরিক ও সামরিক প্রশাসন, আদালত ও সংবাদমাধ্যম গণতন্ত্র সুরক্ষায় যে অবদান রেখেছে, তা অনুকরণীয়। বিশেষ করে, দল থেকে নির্বাচিত গভর্নর ও অন্য কর্মকর্তারা যেভাবে সংবিধান ও আইনকে দলীয় স্বার্থের ঊর্ধ্বে রেখেছেন, তা সত্যিই বিস্ময়কর। স্যালুট মার্কিন গণতন্ত্র!
লেখক : সাবেক এমপি ও সম্পাদকমণ্ডলীর সভাপতি, ঠিকানা।