হজের মহিমায় উদ্ভাসিত হোক জীবন

মারুফ খান

হজের প্রসঙ্গ এলেই আমাদের মানসপটে ভেসে ওঠে ইবরাহিম (আ.) এর ত্যাগের কথা, তাঁর একত্ববাদী বিশ্বাসের কথা। বিজন মরু প্রান্তরে হাজেরা (আ.) এর ক্ষুৎপিপাসায় কাতর অবস্থায় কেবল আল্লাহর ওপর ভরসা করে অবিচল থাকার কথা যেন আমাদের স্মৃতিতে জ্বলজ্বল করে ওঠে। হজের রীতিনীতিগুলো আমাদের ইসমাইল (আ.) এর স্মৃতিসহ আরো অনেক কিছুই মনে করিয়ে দেয়।

হজ ইসলামের পঞ্চম স্তম্ভ। কাজেই এর ব্যাপক তাৎপর্য রয়েছে। এই মহান ইবাদত সমাধা করার পেছনে উদ্দেশ্য যেমন রয়েছে, তেমনি বান্দার কল্যাণও নিহিত রয়েছে। আল্লাহর সন্তুষ্টি অর্জন হজ পালনের মূল উদ্দেশ্য। জীবনে অন্তত একবার হজ পালন করা সব মুসলিমের (সামর্থ্যবান) জন্য ফরজ বা অত্যাবশ্যক, সুবহান আল্লাহ! আমরা যদি হজ নিয়ে গভীরভাবে চিন্তাভাবনা করি, তাহলে বৃহৎ পরিসরে চিন্তার খোরাক খুঁজে পাব। সমস্ত আনুষ্ঠানিকতার দিকে দৃষ্টিপাত করলে হজের মাহাত্ম্য, নিগূঢ় অর্থ সম্বন্ধে ধারণা পাওয়া যায়।

হজের মাধ্যমে দুটি বিষয়ের প্রতিফলন ঘটে। এক. আল্লাহর মাহাত্ম্যের প্রতিফলন। তাঁর শ্রেষ্ঠত্ব ও মহিমা প্রতিষ্ঠা। দুই. নিজস্ব জীবনে এর প্রভাব। আল্লাহ সুবহানাহু তায়ালা আমাদের জন্য হজের যে রীতিনীতি দিয়েছেন, তাতে সুস্পষ্টভাবে আল্লাহর সার্বভৌমত্ব, তাঁর সর্বশক্তিমান সত্তার পরিচয় পাওয়া যায়। বিশ্বের আনাচ-কানাচে ছড়িয়ে থাকা সকল মুসলমান একত্রিত হয় কেবল একটি উদ্দেশ্যে, বুকে একটিই আকাক্সক্ষা লালন করে। এখানে মহান আল্লাহ রাব্বুল আলামিনের মানুষকে সৃষ্টি করার একটি চমৎকার উদ্দেশ্যের বাস্তবায়ন ঘটে। এ বিষয়ে আল্লাহ কোরআনে বলেন, ‘হে মানবজাতি! আমি তোমাদেরকে এক পুরুষ ও এক নারী থেকে সৃষ্টি করেছি এবং তোমাদেরকে বিভিন্ন জাতি ও গোত্রে বিভক্ত করেছি, যাতে তোমরা পরস্পর পরিচিত হও।’ (সুরা আল হুজরাত, আয়াত-১৩)

আমরা প্রত্যেকেই সমান! আমাদের আদি পিতা, আদি মাতা একই! আপনি হজের দিকে খেয়াল করলে দেখতে পাবেন, মানুষে মানুষে সম্প্রীতির বন্ধনের এত বিশাল সম্মেলন আর কোথাও খুঁজে পাওয়া যাবে না। বিশ্বের নানা দিক হতে আসা অসংখ্য গোত্র, জাতি একত্রিত হয়। এর মাধ্যমে আল্লাহ আমাদেরকে সৃষ্টি করার একটি অন্যতম উদ্দেশ্যের কথা স্মরণ করিয়ে দেন। তা হচ্ছে আমরা যেন একে অপরের সঙ্গে পরিচিত হতে পারি। তিনি আমাদের এ জন্য সৃষ্টি করেননি, যাতে আমরা পরস্পর পরস্পরকে ঘৃণা করি! নিজেদের মাঝে জাতিগত বিদ্বেষ তৈরি করে লড়াইয়ে মেতে ওঠার জন্য আমাদের সৃষ্টি করা হয়নি। বরং নিজেদের মাঝে ভ্রাতৃত্বের বন্ধন সৃষ্টি করে সৌহার্দ্যরে সঙ্গে জীবনযাপন করতে বলা হয়েছে! আল্লাহ সুবহানাহু তায়ালা আমাদের মাঝে সবচেয়ে উত্তম ব্যক্তি হিসেবে অভিহিত করেছেন উত্তম চরিত্রের অধিকারীকে! আল্লাহ কিন্তু এই ঘোষণায় কোনো দেশ কিংবা জাতির নাম উল্লেখ করেননি। অর্থাৎ আল্লাহর দৃষ্টিতে সর্বোত্তম হতে হলে দেশ, জাতীয়তা, বর্ণ, সম্পদ নির্বিশেষে আপনাকে বিচার করা হবে। আল্লাহ কেবল আপনার উত্তম চরিত্র দ্বারাই আপনাকে বিবেচনা করবেন।

যখন আমরা দেখি বিশ্বের বিভিন্ন দিক থেকে ভিন্ন ভিন্ন জাতীয়তার, ভিন্ন গোষ্ঠীর সকল মানুষ একত্রিত হচ্ছে মহান রবের সন্তুষ্টির জন্য, তখন হজ আমাদেরকে মহান আল্লাহ রাব্বুল আলামিনের শ্রেষ্ঠত্বের পরিচয় দেয়। হজ আমাদের সবাইকে এক কাতারে দাঁড় করিয়ে দেয়। যখন আপনি ইহরাম পরিধান করে তাওয়াফ করছেন, মিনায় অবস্থান করছেনÑপ্রত্যেকে সমান! আপনি কোন প্যাকেজে হজ করতে গিয়েছেন বা কোন দেশ থেকে হজে গিয়েছেন, তা কিন্তু বিবেচ্য বিষয় নয়! মিনা, আরাফা, মুজদালিফায় আপনি শুধুই সাম্যের দেখা পাবেন। সামাজিক মর্যাদা অনুযায়ী সেখানে আপনাকে বিচার করা হবে না। আল্লাহর ঘরে তাওয়াফ করতে যাওয়া প্রতিটি মানুষের কেবল একটিই পরিচয়Ñতারা আল্লাহর বান্দা। এই বিশাল সম্মেলন থেকে আপনি কখনোই একজন যুবরাজ, একজন রাষ্ট্রদূতকে আলাদা করতে পারবেন না। কেননা যখনই আপনি ইহরাম পরিধান করবেন, আপনারা সকলেই সমান! ইহরাম আমাদের জন্য একটি গুরুত্বপূর্ণ রিমাইন্ডার। এটি আমাদের স্মরণ করিয়ে দেয়, এ দুনিয়ায় আমরা সকলেই সমান। যদিও মহিলারা পর্দার বিধান মেনে চলার জন্য ইহরাম হিসেবে নিত্য অভ্যাসের কাপড় পরিধান করে থাকেন। তবু তারাও অনাড়ম্বর পোশাক পরিধান করেন।

কেবল পোশাকেই সীমাবদ্ধ নয়, বরং হজ আমাদের কণ্ঠের একাত্মতাও নিশ্চিত করে। প্রত্যেকে একই তালবিয়া পাঠ করে প্রভুর কাছে নিজের উপস্থিতির কথা জানান দেয়। ‘লাব্বাইক আল্লাহুম্মা লাব্বাইক। লাব্বাইকা লা-শারিকা লাকা লাব্বাইক। ইন্নাল হামদা ওয়ান নি’মাতা লাকা ওয়াল মুলক, লা-শারিকা লা।’ অর্থ : ‘আমি হাজির, হে আল্লাহ! আমি হাজির! তোমার কোনো শরিক নেই, আমি উপস্থিত! নিশ্চয় যাবতীয় নিয়ামত ও প্রশংসা তোমার এবং রাজত্বও, তোমার কোনো শরিক নেই।’ হজে উপস্থিত সব মানুষের শুধু একটি উদ্দেশ্য থাকে, তা হলো আল্লাহর ইবাদতের মাধ্যমে তাঁর সন্তুষ্টি অর্জন। সুবহানাল্লাহ! আল্লাহর কাছে তাঁর বান্দার মর্যাদা কখনোই প্রতিপত্তি, সামাজিক অবস্থান দিয়ে প্রভাবিত নয়। বরং আত্মসমর্পণকারী বান্দাই মর্যাদাবান। কার ইবাদত আল্লাহ কবুল করবেন, তা আমরা কেউই জানি না।
কাবাঘর তৈরি করার পর আল্লাহ ইবরাহিম (আ.) কে মানুষের কাছে কাবার তাওয়াফ করার আহ্বান জানাতে নির্দেশ দিলেন। ইবরাহিম (আ.) উত্তরে বলেছিলেন, এখানে তো কোনো মানুষ নেই, আর তিনি একা কীভাবে মানবজাতিকে এই আহ্বান করবেন! আল্লাহ তখন আয়াত নাজিল করেন, ‘আর আপনি মানুষের নিকট হজের ঘোষণা করে দিন, তারা আপনার কাছে আসবে পায়ে হেঁটে এবং কৃশকায় উটে চড়ে দূরের পথ পাড়ি দিয়ে।’ (সুরা হজ, আয়াত ২৭) বাস্তবেও তা-ই হয়েছে, যে ধারা আমরা এখনো দেখতে পাই। পৃথিবীর নানা প্রান্ত হতে, ভিন্ন ভিন্ন যানবাহনে করে আল্লাহর সকল বান্দা একত্রিত হন! সুবহানাল্লাহ! হজ আমাদের স্পষ্টরূপে মহান আল্লাহর মহিমা উপলব্ধি করায়।

হজ আমাদের নিজস্ব জীবনেও শিক্ষণীয় প্রভাব ফেলে। হজ আদায়ের জন্য আমাদের স্বীয় সম্পদ, সময় ত্যাগ করতে হয়। হজ আমাদের ধৈর্যশীল হওয়ার শিক্ষা দেয়। প্রতিটি রীতিনীতি, আনুষ্ঠানিকতা নিষ্ঠার সঙ্গে পালন করা আমাদের ধৈর্য বৃদ্ধি করে। এই শিক্ষাগুলো আমাদের আচরণে পরিবর্তন আনতে ভূমিকা রাখে। আল্লাহর বিধান পালনে নিজের কোনো কিছু ত্যাগ করার গুরুত্ব, ইমানের স্বরূপ কেমন হয়, আল্লাহর নিকটবর্তী বান্দা কীভাবে হওয়া যায়Ñতা আমরা হজের মাধ্যমে উপলব্ধি করতে পারি।

আমরা যারা হজে অংশ নিয়েছি অথবা ভবিষ্যতে নেব, তাদের জন্য এই শিক্ষাগুলো স্মরণ করিয়ে দেয়, আমাদের মানসিকতা কীরূপ হওয়া উচিত। কারণ যন্ত্রচালিত মেশিনের মতো হজ আদায় করলে তা প্রকৃত হজ নয়। আপনি হজ করলেন, কিন্তু তা আপনার হজ-পরবর্তী জীবনে কোনো প্রভাবই ফেলল না। আল্লাহর সঙ্গে মজবুত সম্পর্ক গঠনে সহায়ক হলো না! তাহলে এ কেমন হজ! আপনাকে হজের প্রতিটি রীতির গুরুত্ব অনুধাবন করতে হবে। কেবল তখনই এই হজ থেকে ব্যক্তিগতভাবে আপনি লাভবান হতে পারবেন।

আমাদের জন্য দ্বিতীয় যে শিক্ষাটি গুরুত্বপূর্ণ, তা হচ্ছে একতা, সম্প্রীতি। আগেই আলোচনা করেছি, হজ জাতীয়তা, বর্ণ, গোষ্ঠী নির্বিশেষে আমাদের এক সারিতে দাঁড় করিয়ে দেয়। আমরা এমনকি আমাদের উম্মাহর মাঝেও দেখতে পাই, বিভিন্ন মতের মানুষ বিদ্যমান। ভিন্ন ভিন্ন মানহাজ রয়েছে। কিন্তু যখন তারা কাবার চারপাশে তাওয়াফ করে, প্রত্যেকের একটিই গন্তব্য! কেউ ভিন্ন পথ অবলম্বন করে না। আরাফার দিনে আপনি কোনো হাজিকে আরাফার ময়দান ব্যতীত অন্য কোথাও পাবেন না। মুজদালিফায় সবাই একত্রেই অবস্থান করবে। কোনো ভেদাভেদ থাকে না তাদের মাঝে। নিশ্চয় বুদ্ধিমান ব্যক্তির জন্য হজের মাঝেই রয়েছে উত্তম নিদর্শন।

প্রকৃতপক্ষে আমাদের মাঝে মতের ভিন্নতা বা অনৈক্য হওয়ার যে দিকগুলো রয়েছে, তার থেকেও অনেক বেশি দিক রয়েছে, যা আমাদের ঐক্যের নিদর্শনস্বরূপ! আমাদের উচিত সেই বিষয়গুলোতে বেশি ফোকাস করে পুরো উম্মাহকে কেবল ইসলামের পতাকাতলে নিয়ে আসা! কারণ আমরা যত বেশি এই মতের ভিন্নতার দিকে নজর দেব, আমাদের মাঝে তত বেশি বিভক্তি সৃষ্টি হবে। আমরা পরস্পর থেকে দূরে সরে যাব। আল্লাহ চান আমরা যেন একে অপরের সঙ্গে পরিচিত হই। তা করতে হলে আমাদের পারস্পরিক সম্পর্ক মজবুত করতে হবে। যা কিছু ভিন্নতা রয়েছে, তার সমাধান করতে হবে কাছাকাছি অবস্থানের মাধ্যমে। রুক্ষতা দিয়ে নয়, বরং কোমলতা ও উত্তম নসিহতের মাধ্যমে।

সর্বশেষ রিমাইন্ডার! ইহরামের দুই টুকরো সাদা কাপড় আমাদের স্মরণ করিয়ে দেয় মৃত্যুর কথা। আমাদের সকলকে একদিন এই দুই টুকরো সাদা কাফন গায়ে জড়িয়েই কবরে শায়িত হতে হবে। আমাদের সব সময় স্মরণে রাখতে হবে, আমরা আল্লাহর পক্ষ থেকেই এসেছি এবং একদিন তাঁরই কাছে আমাদের ফিরে যেতে হবে। আল্লাহর কাছে আমরা চুক্তিবদ্ধ হয়ে সাক্ষ্য দিয়েছিলাম। তাঁকে নিজেদের একমাত্র রব হিসেবে মেনে নিয়েছিলাম। আবার একদিন এই আরাফার ময়দানেই শেষ বিচারের দিন মানবজাতি একত্রিত হবে, সাদা কাফন গায়ে!

আমাদের দুনিয়ার এই জীবন কতই-না সংক্ষিপ্ত! এই স্বল্প সময়ের মাঝেই আল্লাহ তায়ালাকে সন্তুষ্ট করে নিজেদের আখিরাতের পাথেয় সংগ্রহ করার জন্য আমাদের সচেষ্ট হতে হবে। আপনাদের প্রতি আমার অনুরোধ থাকবেÑহজ আমাদের যেসব শিক্ষা প্রদান করে, তা অনুধাবন করে নিজ জীবনে অনুশীলন করবেন। যারা এখনো হজ আদায় করতে পারেননি, আল্লাহ তাদের হজ পালনের তওফিক দান করুন। যারা ইতিমধ্যে হজ পালন করেছেন, তাদের হজ আল্লাহ কবুল করে নিন। আল্লাহ আমাদেরকে ইবরাহিম (আ.) এর জীবনী থেকে শিক্ষা অর্জন করে বাস্তব জীবনে তা প্রতিফলনের তওফিক দান করুন, আমিন।

লেখক : তালিবে ইলম, প্রাবন্ধিক