স্পোর্টস রিপোর্ট : চূড়ান্ত নন-ক্রিকেটিং আহাজারিকাপটা নিয়েই গেলেন হাতুরাসিংহে কোচ তো আর খেলেন না, হার-জিত আসে খেলোয়াড়দের ব্যাটে-বলে। তবু মাহমুদ উল্লাহ আউট হতেই শ্রীলঙ্কা কোচের চওড়া হাসি জায়ান্ট স্ক্রিনে দেখে কি মন পোড়েনি বাংলাদেশের ড্রেসিংরুমে? কিছু প্রশ্ন সরাসরি করতে নেই, করেও সঠিক উত্তর মেলে না। সেসব প্রশ্ন নিজেকেই করতে হয়, ত্রিদেশীয় সিরিজের ফাইনালে কাল বাংলাদেশ ৭৯ রানে শ্রীলঙ্কার কাছেই শুধু হারল নাকি হাতুরাসিংহের কাছেও?
নিছকই আবেগ কি? না, হার-জিতে কোচেরও ভূমিকা থাকে। হাতুরাসিংহের কোচিং মডেলে স্কোয়াড থেকে একাদশ এবং রণ পরিকল্পনায় প্রবল কর্তৃত্ব থাকে তার। থাকে বলেই মাত্রই তিনটা প্রথম শ্রেণির ম্যাচ খেলা শেহান মাদুশাঙ্কার মতো আনকোরা তরুণকে স্কোয়াডে নেন, অভিষেক করিয়ে দেন অগ্নিগর্ভ ফাইনালে। ২২ বছর বয়সী এই তরুণ মোটেও ম্যাচের মহানায়ক নন, তবে অভিষেকে হ্যাটট্রিক তো করেছেন।
ফাইনালে হাতুরাসিংহের প্রভাব এখানেই শেষ নয়। বাংলাদেশ ব্যাটিংয়ের ট্রাম্পকার্ড তামিম ইকবালকে শুরুতে ফেরানোর উপায় অফস্টাম্পের একটু ওপরে ওপরে বল করে যাও। মাহমুদ উল্লাহসহ অন্যদের পরীক্ষা নাও গতিময় বাউন্সারে। মুশফিকুর রহিমের সুইপ শট খেলা খুব পছন্দের। তবে মিরপুরের উইকেটে বল মাঝেমধ্যেই থেমে-টেমে আসে। তো, তাকে সুইপ শট বেশি বেশি খেলতে প্ররোচিত করো। একটা মিস টাইমিংই তো চাই, নাকি? ওটা হয়েছেও। সাবেক কোচের সব ফাঁদ কেটে একজন মাহমুদউল্লাহ একা লড়ে গেলেও টপাটপ সাজঘরে ফিরেছেন অন্যরা।
প্রশ্ন উঠতেই পারে, কোচ হাতুরাসিংহের জারিজুরি টুর্নামেন্ট শুরুর প্রথম দুই ম্যাচে কোথায় ছিল? উত্তরটা ক্রিকেটারদের কাছেই, কোচের পরিকল্পনা বাস্তবায়ন সেসব ম্যাচে করতে পারেননি দীনেশ চান্দিমালরা। শেষ দু’টায় করে এক লহমায় চ্যাম্পিয়ন শ্রীলঙ্কা। আর আরেকটি টুর্নামেন্টের ফাইনালে বিজিত বাংলাদেশ।
ক্রিকেট খেলাটাই এমন যে শেষ হয়েও হয় না শেষ ‘কি হলে কি হতো’র হিসাব মেলানো চলতেই থাকে। আচ্ছা, সাকিব আল হাসান যদি ফিল্ডিংয়ের সময় ওরকম চোট না পেতেন, তাহলে। কোনো সন্দেহ নেই তিন নম্বরে এই অলরাউন্ডারের ব্যাটিংটা ভীষণ মিস করেছে বাংলাদেশ। তবে সাকিবকে ছাড়া নিজেদের চেনা মাঠে ২২২ রান করতে না পারাটাও দেশীয় ক্রিকেটের জন্য আশাবাদের ঘটনা নয়। পুরো টুর্নামেন্টে সেই একই দৃশ্য। চোট নামতেই দেয়নি সাকিবকে। আর শুরুতে তামিম আউট হতেই মিডল অর্ডার ‘এক্সপোজড’ ফের অপবাদ ঘুচিয়ে মিডল অর্ডারে ভর করেই বৈতরণী পার করার একটা পরিস্থিতি কিন্তু তৈরি হয়েছিল গত রাতে। ২২ রানে ৩ উইকেট হারিয়েছে বাংলাদেশ, সাকিবেরটিসহ ক্ষয়ক্ষতি আসলে ৪ উইকেটের। তবে এমন পরিস্থিতিতেও তো ম্যাচ জেতার রোমাঞ্চকর অভিজ্ঞতা আছে বাংলাদেশের। সবশেষ আইসিসি চ্যাম্পিয়নস ট্রফিতেই না নিউজিল্যান্ডের বিপক্ষে কাউন্টার অ্যাটাকে জিতিয়েছিলেন মাহমুদ? সাকিব নেই তো কি, মুশফিকের ব্যাটে এমন কত ঝঞ্ঝা বিক্ষুব্ধ সমুদ্র পাড়ি দিয়েছে বাংলাদেশ।
তারা টলমল জাহাজটাকে ঠিকই জয়ের দিশা দেখাচ্ছিলেন। এদিন আর পাল্টা আক্রমণে যাননি মাহমুদ কিংবা মুশফিক। রান তো নাগালের মধ্যেই। তাই রয়েসয়ে খেলে জুটিটা পঞ্চাশ পেরোতে ম্যাচের ভারসাম্য অদলবদল হলো বলে। কিন্তু শ্রীলঙ্কার অফস্পিনার আকিলা ধনঞ্জয়কে সুইপ করতে গিয়ে ব্যাটে-বলে ঠিকভাবে করতে পারেননি মুশফিক। তার ব্যাটের ওপরের কানায় লেগে বেলুনের মতো আকাশে ওঠা ক্যাচ নিতে সামান্যতম বেগও পেতে হয়নি উপুল থারাঙ্গার। যথারীতি উদ্বাহু উল্লাস লঙ্কানদের, ম্যাচ তো কার্যত শেষ ওখানেই।
প্রয়োজনে সংগত দেওয়া ব্যাটিং তখনো মজুদ বাংলাদেশের ড্রেসিংরুমে। কিন্তু ফাইনালের ¯œায়ুক্ষয়ী ম্যাচে প্রতিপক্ষের তেজোদীপ্ত শরীরী ভাষার সামনে মাহমুদের সঙ্গে যাদের সাইড রোল নেওয়ার কথা, তারা সবাই একযোগে ফ্লপ করে গেলেন। একার লড়াইয়ে ম্যাচের সর্বোচ্চ স্কোরার মাহমুদ হলেন হ্যাটট্রিকের শিকার, যে ‘দুর্নাম’টুকু তার মোটেও পাওনা নয়। বাঁ-হাতি স্লিং বেঁধে ড্রেসিংরুমে বসে সাকিব ঠিক কী ভাবছিলেন বলা মুশকিল। তবে নাগাল থেকে আরেকটি ট্রফি দৃষ্টিসীমার বাইরে চলে যাওয়া দেখে বিলক্ষণ তার ভালো লাগেনি। ভালো লাগেনি দর্শকদেরও, পুরস্কার বিতরণীর বেশ আগেই তাই শোকের নীরব মিছিল করে গ্যালারি ছেড়েছে তারা।
অথচ ফাইনালের প্রথম পর্ব বাংলাদেশের প্রত্যাবর্তনের গল্প। টস জিতে ব্যাটিংয়ে নেমে কোচের প্রেসক্রিপশন মেনে ঝড় তুলেছিল শ্রীলঙ্কার টপঅর্ডার। দুই ব্যাটসম্যানই বাঁ-হাতি, তাই ফাইনালে সুযোগ পাওয়া মেহেদী হাসান মিরাজের অফস্পিন দিয়েই বোলিং শুরু করিয়েছেন মাশরাফি বিন মর্তুজা। তৃতীয় ওভারে সুফল মিললেও মেহেদী মিরাজের তৃতীয় ওভারে ২৪ রান তুলেই যেন দিন শেষের বার্তাটা দিয়ে রেখেছিলেন কুশল মেন্ডিস। ৯ বলে ২৮ রান করা এই বাঁ-হাতিকে মাশরাফি বেশি বাড়তে দেননি ঠিকই, তবে প্রতিপক্ষকে শুরুর ঝটকাটা তো দেওয়া হয়ে গেছে লঙ্কানদের
সাকিবকে ঘিরে হাতুরাসিংহের ভাবনার রেশেই কি না এক-দুই করে শ্রীলঙ্কার প্রথম চার ব্যাটসম্যানই বাঁ-হাতি তাই বোলিংয়ে আর আসেন না সাকিব। এলেন ২৫তম ওভারে, যদিও তখনো ব্যাটিংয়ে বাঁ-হাতি থারাঙ্গা। যুগ যুগ ধরে বাংলাদেশের বিপক্ষে আর এখানকার ঘরোয়া ক্রিকেটে খেলে যাওয়া শ্রীলঙ্কার এই ওপেনারই দলের পক্ষে একমাত্র ফিফটিটি করেছেন। তবে কুশল মেন্ডিসের মতো মারমুখী হতে পারেননি তিনি কিংবা উইকেটে দীর্ঘস্থায়িত্ব পাওয়া চান্দিমাল। এর পুরো কৃতিত্ব বাংলাদেশি বোলারদের। ৪ উইকেট নিয়ে নিঃসন্দেহে সফলতম রুবেল হোসেন, যাকে এলোপাতাড়ি পিটিয়ে ২০০৯ সালে কাপ নিয়ে গিয়েছিলেন মুত্তিয়া মুরালিধরন। তবে ট্রফি হাতছাড়া হওয়ার দিনে বাংলাদেশের জন্য সবচেয়ে ইতিবাচক নৈপুণ্য মুস্তাফিজুর রহমানের বোলিং। ২ উইকেট নিয়ে এ দিন ওয়ানডেতে ৫০ শিকারের ল্যান্ডমার্ক ছুঁয়েছেন এই বাঁ-হাতি পেসার, যা বাংলাদেশি বোলারকুলে দ্রুততমও। তার চেয়েও প্রীতিকর সেই শুরুর মুস্তাফিজের প্রত্যাবর্তন, যার বলের নাগাল ব্যাট চালিয়েও পেতে হিমশিম খেতেন ব্যাটসম্যানরা। যেমনটা শিরোপা নাগালের বাইরেই থাকে মাশরাফিদের
শ্রীলঙ্কা : ৫০ ওভারে ২১১, বাংলাদেশ : ৪১১ ওভারে ১৪১ ফল : শ্রীলঙ্কা ৭৯ রানে জয়ী