হাতি ঘোড়া গেল তল মশা বলে কত জল

আহবাব চৌধুরী খোকন :

অবশেষে নিউইয়র্কের বৃহত্তম সামাজিক সংগঠন বাংলাদেশ সোসাইটির বিরুদ্ধে জনৈকা নিরু নিরার দায়ের করা মামলা আদালতে বাতিল হয়েছে। এই মামলায় বাদীর আবেদন আদালত সহসা খারিজ করে দিলেও তাতে সোসাইটির আর্থিক ক্ষতি হয়েছে লক্ষাধিক ডলার। বাংলাদেশের পতাকাবাহী কমিউনিটির বৃহত্তম এই সংগঠনের বিরুদ্ধে মামলা এই প্রথম নয়। প্রতিষ্ঠার পর থেকে এ পর্যন্ত বহুবার মামলার মুখোমুখি হয়েছে সংগঠন। যখনই যাদের একটু স্বার্থহানি হয়েছে, তারাই টুকে দিয়েছেন সংগঠনের বিরুদ্ধে মামলা। ফলে প্রতিষ্ঠার ৪০ বছরেও খুব একটা স্বতন্ত্র বৈশিষ্ট্য নিয়ে দাঁড়াতে পারেনি সোসাইটি।

বছর তিনেক আগে নির্বাচনে প্রতিদ্বন্দ্বিতাকারী একটি প্যানেলের দুজন ও একজন স্বতন্ত্র প্রার্থীর করা মামলার পরিপ্রেক্ষিতে সোসাইটির নির্বাচনই শুধু তিন বছর আটকে থাকেনি, সোসাইটির ফান্ড থেকে তখনো অপচয় হয়েছে বিপুল পরিমাণ অর্থ। এই মামলার রেশ কাটতে না কাটতেই সম্প্রতি আবার মামলার গ্যাঁড়াকলে পড়ে আটকে যায় নির্বাচন। সম্পূর্ণভাবে স্থবির হয়ে পড়ে সোসাইটি। সংগঠনের কর্মকাণ্ডে আদৌ সংশ্লিষ্ট নন, এমন ব্যক্তির করা এবারের মামলায় গোটা কমিউনিটি অবাক ও বিস্মিত হয়েছে। ছোটবেলায় শোনা এক রসিক ব্যক্তির কথা এই মুহূর্তে খুব মনে পড়ছে। এক ভদ্রলোক গ্রাম্য মামলাবাজদের উপদ্রবে অতিষ্ঠ হয়ে প্রায়ই দুঃখ করে বলতেন, ‘ঘরে ঘরে সব উকিল-মুক্তার হওয়ায় এখন বুঝি পুরো গ্রামই উজাড়।’ এখন আমাদের নিউইয়র্কের অবস্থাও হয়েছে সে রকম। হঠাৎ করে মামলাবাজদের সংখ্যা বেড়ে যাওয়ায় বিড়ম্বনা বেড়েছে বহুগুণ। আমি একটি বিষয় বুঝি না, সামান্য বিষয় নিয়ে যারা কথায় কথায় আদালতে চলে যান, তাদের আসল উদ্দেশ্য কী? কমিউনিটির উপকার না অপকার করা? যারা একটি বৃহত্তর সংগঠনের বিরুদ্ধে মামলা করে সংগঠনকে আর্থিকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত করতে পারেন, তারা আর যা-ই হোক, সোসাইটি বা কমিউনিটির হিতাকাক্সক্ষী ননÑএটা অবলীলায় বলা যায়।

বাংলাদেশ সোসাইটির বিরুদ্ধে খারিজ হওয়া মামলার বাদী নিরু নিরা আহূত সংবাদ সম্মেলনে প্রদত্ত বক্তব্য আমার দৃষ্টি আকর্ষণ করেছে। এই সংবাদ সম্মেলনে নিরার সাথে উপস্থিত ছিলেন তার ভাই জ্যাকব মিল্টন। জ্যাকব মিল্টন ও নিরা সংবাদ সম্মেলনে যে কথাগুলো বলেছিলেন, তার বেশির ভাগই ছিল বাগাড়ম্বর বক্তৃতাসর্বস্ব এবং নিজেদের জাহির করার একটা প্রয়াস। তবে তাদের বক্তব্যে খুব আপত্তিকর অংশটি ছিল কমিউনিটির সর্বজনশ্রদ্ধেয় ব্যক্তিত্ব বাংলাদেশ সোসাইটির সদ্য প্রয়াত সভাপতি কামাল আহমদকে নিয়ে আশালীন বক্তব্য প্রদান। একজন মৃত মানুষকে নিয়ে কোনো সুস্থ স্বাভাবিক মানুষ এভাবে কথা বলতে পারে না। আমরা যে যে ধর্মই পালন করি না কেন, অন্তত এটা মনেপ্রাণে বিশ্বাস করি, কোনো লোক মারা গেলে তিনি বিতর্কের ঊর্ধ্বে চলে যান। কারণ মৃত ব্যক্তির আত্মপক্ষ সমর্থনের সুযোগ নেই। অথচ জ্যাকব মিল্টন সেটা জেনেও মরহুম কামাল আহমদের বিরুদ্ধে কথা বলেছেন এমন ভাষায়, মনে হয়েছে এই সমাজে তিনি খুব অবজ্ঞাসম ব্যক্তি ছিলেন। অথচ কমিউনিটিতে সচেতন সকল মানুষই জানেন, মরহুম কামাল অসম্ভব ভালো একজন মানুষ ছিলেন। যিনি নিজে বছরে আড়াই লাখ ডলার উপার্জন করে আমৃত্যু ভাড়া করা অ্যাপার্টমেন্টে জীবনযাপন করে গেছেন। যে মানুষটি মৃত্যুর আগমুহূর্ত পর্যন্ত সমাজের কাজ করে গেছেন, তার সমালোচনা করছে সেই ব্যক্তি, যে কিনা জীবনে কখনো ২০টি ডলার খরচ করে বাংলাদেশ সোসাইটির সদস্য হওয়ার প্রয়োজন বোধ করেনি। কামাল আহমদ জীবদ্দশায কারো যদি ক্ষতি করে থাকেন, অভিযোগ করতে পারেন কেবল ক্ষতিগ্রস্ত ব্যক্তি। ক্ষতিগ্রস্ত ব্যক্তি ছাড়া কারো বিরুদ্ধে কাল্পনিক অভিযোগ কতটুকু গ্রহণযোগ্য, সেই প্রশ্ন আসা কি স্বাভাবিক নয়? জনাব কামাল কতটা ভদ্রলোক, পরোপকারী ও মহৎ লোক ছিলেন, এটা সকলেই জানেন। সুতরাং এই মৃত মানুষকে নিয়ে মিথ্যা অভিযোগ খুবই দুঃখজনক।

জ্যাকব মিল্টন বলেছেন, বাংলাদেশ সোসাইটি ফাইভ ওয়ান সি মর্যাদার সংগঠন হওয়ায় বিভিন্ন সময় এই সংগঠনের ফান্ডে জমা হওয়া হাজার হাজার ডলার কমিটির নেতারা ক্যাশ করে আত্মসাৎ করেছেন। কিন্তু তিনি প্রমাণ হিসেবে কোনো কাগজপত্র উপস্থাপন করেননি। সংবাদ সম্মেলনের পুরো বক্তব্য শুনে মনে হয়েছে, উনি প্রমাণ করতে চেয়েছেন নিজে খুব মেধাবী আর বাংলাদেশ সোসাইটির দায়িত্বে যারা রয়েছেন, তারা কিছুই জানেন না ও অসৎ। জনাব জ্যাকব মিল্টন ও নিরু নিরার কথাগুলো যদি সত্য হয়ে থাকে, তাহলে জানতে ইচ্ছা করছে, তারা অনুরূপ আরেকটি সংগঠন সৃষ্টি করে কমিউনিটির জন্য ভালো কিছু করছেন না কেন? এতে মানুষ আপনাদের যেমন বাহবা দেবে, তেমনি কমিউনিটি হবে উপকৃত। জনাব মিল্টন যেখানে আজ পর্যন্ত নিজের পকেটের ২০টি ডলার খরচ করে বাংলাদেশ সোসাইটির সাধারণ সদস্যও হওয়ার প্রয়োজন মনে করেননি, সেখানে নিজে আতেল সেজে জ্ঞান দিচ্ছেন আর কমিউনিটির সম্মানিত ও মৃত ব্যক্তিদের নিয়ে অসত্য বক্তব্য দিচ্ছেন, যা একেবারেই বেমানান।

জ্যাকব মিল্টন ও মিসেস নিরার কর্মকাণ্ড দেখে আমার সেই হাস্যকর গল্পটি এই মুহূর্তে মনে পড়ছে। এক ডোবায় অনেক পানি ছিল। এতটা পানি যে দ্রুতগামী ঘোড়া এমনকি বিশাল একটি হাতির পক্ষেও পার হওয়া সম্ভব হচ্ছিল না। এমন সময় একটি ক্ষুদ্রাকৃতির চতুর মশা ডোবার উপর দিয়ে উড়ে এসে হাতিকে কানে কানে বলল, আর কতটা পানি কমে গেলে হাতির পক্ষে এই ডোবা সহজে অতিক্রম করা সম্ভব হবে? নিরা ও মিল্টনের বক্তব্য শুনে মশা ও হাতির সেই প্রচলিত প্রবাদটি মনে পড়ে গেল, ‘হাতি ঘোড়া গেল তল, মশা বলে কত জল।’ ক্ষুদ্র একটি মশা হয়ে কেবল পাখার ওপর ভর করে কাউকে জ্ঞান দেওয়া খুব সহজ। বাংলাদেশ সোসাইটি প্রতিষ্ঠা এবং এর কর্মকাণ্ডে সম্পৃক্ত হয়ে যারা দেশ ও সমাজের জন্য কাজ করছেন, তাদের সমালোচনা তাদের মুখে শোভা পায় না, যারা কমিউনিটির ক্ষতি ছাড়া কখনো উপকার করেছেন এমন একটি উদাহরণও দেখাতে পারবেন না। সত্যিই যদি নিরা ও মিল্টনের উদ্দেশ্য মহৎ হতো, তাহলে তারা এই সংগঠনের বিরুদ্ধে মামলা না করে এই সংগঠনের কর্মকাণ্ডে সম্পৃক্ত হওয়ার মাধ্যমে সংগঠনের অভ্যন্তরে যেসব ভুলত্রুটি তাদের দৃষ্টিতে রয়েছে, তা সংশোধন করতে পারতন। কিন্তু তা না করে সোসাইটি ও কমিউনিটির ভাবমূর্তি নষ্ট হয়, তাদের এমন অপচেষ্টা সমর্থন করা যায় না।

এ কথা স্বীকৃত সত্য, মামলাবাজরা সকল সময়ে দেশ ও সমাজের ক্ষতি করেছে এবং এখনো করে যাচ্ছে। সুতরাং এদের বিরুদ্ধে সামাজিক প্রতিরোধ গড়ে তোলা ছাড়া বিকল্প নেই।

লেখক : কলামিস্ট এবং সাবেক নির্বাচিত কর্মকর্তা, বাংলাদেশ সোসাইটি