হানাদাররা লাত্থাইয়া লাত্থাইয়া দেখে মরছে কিনা : বেলী রানী দাস

বাসন্তী রানী দাস বেলী রানী দাস নামেই সবার কাছে পরিচিত। একাত্তরের ২৭ মার্চ রাতে রমনা কালী মন্দিরে পাকিস্তানি সেনাদের গুলিতে শহীদ হন তার স্বামী সরযু দাস। হাইকোর্টের মালী ছিলেন তিনি। একাত্তরের ২৬ মার্চ বেলা চারটার মধ্যে রমনা কালী মন্দিরের অনেক মানুষই অন্যত্র সরে যায়। বেলী রানী দাসের স্বামীও স্ত্রী মেয়েকে নিয়ে অন্যত্র সরে যাওয়ার সিদ্ধান্ত নেন। কিন্তু বাঁধ সাধলেন রমনা কালী মন্দিরের স্বামীজী পরমানন্দ গিরি। উনি তাদের বললেন, ‘তোমরা যদি মহল্লা ছাইড়া যাও, পরে কাউকে এইখানে ঢুকতে দেয়া হবে না। ঢুকতে দিব না।’
এ প্রসঙ্গে বেলী রানী দাস বলেন, আমরা মনে করলাম, ঠিকই তো, জামাই, শ্বশুর, দেবর, ননাষ, ননদ এদেরকে নিয়া কার বাড়িতে উঠুম। এই ভাইব্যা আমরা নিজের ঘরেই রইয়া গেলাম। রাত তিনটার দিকে রমনা কালী মন্দির থাইক্যা দেখতে পাই রেসকোর্স ময়দানে আনন্দময়ী আশ্রমের দিলীপের বাবা রঘুনাথ তাঁতী অর্থাৎ আমার মামাশ্বশুররে মিলিটারিরা ধইরা আনছে। মিলিটারিরা রমনা কালী মন্দিরের প্রধান ফটকের সামনে সবার সঙ্গে দেড় বছরের মেয়ে কোলে আমাকেও বসাইয়া দেয়। এ সময় আমার স্বামী সেখানে ছিলেন না।
সেদিন পাকিস্তানি সেনাদের হাত থেকে অকল্পনীয়ভাবেই বেঁচে গিয়েছিলেন বেলী রানী দাস। পাকিস্তানি সেনাদের সেই লোমহর্ষক ঘটনার কথা বলতে গিয়ে বেলী রানী দাস বলেন, আমার স্বামীরে মিলিটারিরা আগেই ধইর‌্যা নিয়া গেছে। আমারেও ওরা ধইর‌্যা ফেলে। আমার কোলে দেড় বছরের মেয়ে। মিলিটারিরা মেয়েসহ আমারে ধইর‌্যা কালী মন্দিরের ফটকের সামনে আইন্যা বসায়। পুরুষদের আলাদা লাইন, মেয়েদের সাইড কইর‌্যা আলাদা লাইন। আমারে বসানোর সাথে সাথে পাশের জনকে বলি, দিদি চলেন উইঠ্যা দৌড় দিই। এই কথা বইল্যা আর দেরি করি না। মেয়েরে কোলে নিয়া দৌড় দিছি। গর্ত করা ঘের দেয়া বাথরুমে মেয়েসহ পইড়্যা যাই। মেয়েরে উঁচু কইর‌্যা রাখি। আমার সঙ্গে যে দিদি দৌড় দিছে তিনি দেয়ালের কিনারে দাঁড়াইয়া রইছেন। আমি তারে দেইখ্যা বলি দিদি আমারে উঠান। আমি তো পইর‌্যা গেছি পায়খানায়। দিদি আমার মেয়েরে নেন। এরপর আমারে গর্ত থিক্যা টাইন্যা উঠায়। আমার সারা কাপড়ে ময়লা। আমি তাকে বলি, রেসকোর্সের মাঠ দিয়া ঐপাড়ে যাওয়া যাবে কিনা দেখতে। কারণ মিলিটারিরা মাঠের চারদিকে ট্যাঙ্ক বসাইয়া রাখছে। আনন্দময়ী আশ্রমের আগুন তখনও জ্বলতাছে। রমনা কালী মন্দিরেও আগুন ধরাইয়া দিছে। রমনা কালী মন্দিরও জ্বলতাছে। এরই মধ্যে মাঠ দিয়া দৌড়াইয়া গিয়া হাইকোর্টের নতুন ভবনে উঠি। এক ড্রাইভার আমারে দেইখ্যা কয় এই অবস্থা কেন? তিনি আমারে একটা বিছানার চাদর দেন আর বলেন, ‘বিপদে সবারই মা-বোন আছে। আপনে এই চাদরটা পরেন।’ কাপড় পাল্টাইয়া চাদর পরলাম। কাপড় ধুইয়া শুকাইতে দিলাম। ভোর পাঁচটা বাজে। মিলিটারিরা যাগো ধরছিল তাগো রমনা কালী মন্দিরের গেটের ভিতরে আনে। তারপরে তাগো ওপর গুলি চালায়। লাথ্যাইয়া লাথ্যাইয়া দেখে মরছে কিনা? কালী মন্দিরে যে পরিবারগুলো থাকত তাদের ঘরে আগুন ধরাইয়া দেয়। আগুন ধরা বেড়াগুলা টাইন্যা আইন্যা মৃত দেহগুলার ওপর ছড়াইয়া দেয়। বেলা হইলে আমার ভাগনি কয়, মামারে মাইর‌্যা ফালাইছে। আমার ভাইরে গুলি করছে। বাবাও নাই। আমার স্বামী সরযু দাস, ননাষের জামাই বাবুলাল, ভাগনা রামবিলাসকে মিলিটারিরা গুলি করে। রামবিলাস ছাত্র ছিল। গুলি লাগলেও রামবিলাস তখনও বাঁচা ছিল। ওরে ঢাকা মেডিকেল হাসপাতালে ভর্তি করা হয়। রক্ত দিতে না পারায় ক’দিন পর মারা যায়। ননাষের জামাই আর আমার স্বামী ঘটনাস্থলেই শহীদ হন। নন্দু পাশীর ছেলে হীরা শহীদ হয়। আরও অনেক লোক সেদিন শহীদ হন। মন্দিরের বাইরের অনেক লোকও সেদিন শহীদ হন। সাধুর শরীরে গুলি লাগে, আগুনও লেগে যায়। কিন্তু ভাগ্যক্রমে তিনি বেঁচে যান। কাইন্দা, কুইন্দা ননাষ, ননাষের দুই মেয়ে, নিজের মেয়েকে নিয়ে প্রাণভয়ে সকলের সাথে হাঁটতে হাঁটতে জিঞ্জিরা চইল্যা যাই। আমার ননাষ শহীদ বাবুলাল দাসের স্ত্রী গর্ভবতী ছিলেন। এরই মধ্যে হাইট্যা জিঞ্জিরা যান। কিন্তু এই মিলিটারিরাই সকালে যখন রমনা কালী মন্দিরে আসে, তারা বলেছিল তুম লোককো নেহি মারেঙ্গে। অথচ রাতের অন্ধকারে ওরা আমাদের ওপর আক্রমণ চালায়।
সেদিন মেয়ে কোলে নিয়ে সদ্য বিধবা বেলী রানী দাস পাড়া প্রতিবেশী, আত্মীয়-স্বজনের সঙ্গে দৌড়াতে দৌড়াতে জিঞ্জিরা থেকে কলাকুপাবান্দুরা চলে যান। সেখানে প্রায় দেড় মাস অবস্থান করেন। অবস্থা একটু শিথিল হলে ঢাকায় ফিরে আসেন। তার ননদের জামাই জেলখানার সিপাই ছিলেন। তাদের ছেলেমেয়ে নাই। শ্বশুর, ননাষ, ননাষের মেয়ে, নিজের মেয়েসহ সেই ননদের জেলখানার কোয়ার্টারে ওঠেন। বেলী রানীর বয়স সবে মাত্র আঠার হবে। এই বয়সেই বিধবা হয়েছেন তিনি। আত্মীয়-স্বজনরা ঠিক করলেন এই মেয়েকে এভাবে রাখা ঠিক হবে না। পাত্রও পেয়ে গেলেন। কিছুদিন হয়েছে পাত্রের বউ মারা গেছে। মুক্তিযুদ্ধের মধ্যেই টঙ্গীতে বেলী রানীর বিয়ে হয়ে গেল। বিয়ের পর বেলী রানী মেয়েসহ ঢাকায় সেগুনবাগিচায় শ্বশুরবাড়ি চলে আসেন। তার সঙ্গে তার ভাই, কাকাতো ভাইও ঢাকায় আসেন। কিন্তু আশপাশের মানুষ শত্রুতা করে পাকিস্তানি সেনাদের খবর দেয়। ওই বাড়িতে মুক্তিবাহিনী আছে। পাকিস্তানি সেনারা মুক্তিবাহিনী ভেবে তার দুই ভাইকে রমনা থানায় নিয়ে যায়। তার শ্বশুর পাকিস্তানি সেনাদের বলেন, ‘আমার পোলারে বিয়া করাইছি, বৌয়ের ভাই।’
বিয়ের পরই বাচ্চা নিয়ে ননদ, ননদের জামাই ও তার দ্বিতীয় স্বামীর মধ্যে মনকষাকষি শুরু হয়ে যায়।
এ প্রসঙ্গে বেলী রানী দাস বলেন, প্রথম স্বামী শহীদ হয়েছেন। তাই আমার আগের স্বামীর বোন ভাইয়ের মেয়েকে কাছ ছাড়া করবেন না। আমিও মেয়েকে ছাড়া থাকব কিভাবে? এই স্বামীও মেয়েকে তাদের দিবেন না। মেয়েকে নিয়ে টানাটানি শুরু হলো। এরই মধ্যে মেয়ের বসন্ত ওঠে। মেয়েকে বাঁচাতে পারলাম না। ননদও মারা গেলেন।