হানি আই অ্যাম হোম

রুনু হক

এবারের শীতকালটা যেতে যেতেও যাচ্ছে না । বিভিন্ন স্টেটে বরফ ঝড় আর শীতের হাড় কাঁপানো প্রচণ্ড ঠান্ডার আয়ন বায়ু মানুষের স্বাভাবিক জীবনযাত্রাকে এলোমেলো করে দিয়ে যাচ্ছে। যখন যে স্টেটের উপর দিয়ে বায়ুপ্রবাহ বয়ে যাচ্ছে, তখন সে স্টেটের গাছপালা ঘরবাড়ি গাড়ি সব সাদা বরফে এমনভাবে আচ্ছাদিত হয়ে যাচ্ছে যে একটু দূরে দৃষ্টি প্রসারিত করলে দেখা যাচ্ছে শুধু হিম শীতল বায়ুকণা। এক একটা শহর এমনভাবে আচ্ছাদিত হচ্ছে যে মনে হবে এখানে কোনোদিনই মানুষের বসতি ছিল না।
আমেরিকার বোস্টনবাসী আরেফ মাত্র কয়েক মাস আগে গ্রীষ্মের ছুটিতে দেশে গিয়ে বিয়ে করে নিয়ে এসেছে তার ছোটবেলার বান্ধবী রত্নাকে। দু’জনেই প্রায় সমবয়সী। রত্না ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে এম এ পাস করেছে। আর আরেফ ঢাকা মেডিকেল কলেজ থেকে পাস করে হাভার্ড বিশ্ববিদ্যালয়ে স্কলারশিপ পেয়ে এসেছে এ দেশে হায়ার ডিগ্রি নিতে। হয়েছে এসোসিয়েট প্রফেসার। রত্নাও ভালো ছাত্রী। ঢাকায় সেও চাকরি করেছে আর অপেক্ষা করেছে আরেফের জন্য।
মা-বাবা আত্মীয়স্বজনের কাছ থেকে এর জন্য তাকে বহু কথা শুনতে হয়েছে। অনেকে বলেছে আরেফ আমেরিকায় সোনালি চুলের কোন সুন্দরীকে নিয়ে ঘুরছে বুঝেছিস। ছোট ভাই বলেছে আমারই বিয়ের বয়স হয়ে গেল। আর তুমি এখনোও অবিবাহিতা। আমি যদি নিরালোকে বিয়ে করে ফেলি মানুষ হাসবে না।
আমার ভারী বয়েই গেছে মানুষের কথায়। আমার জীবনে একমাত্র পুরুষ আরেফ। আমি আরেফের জন্য সারাজীবন অপেক্ষা করে থাকব। তুই তোর মতো বিয়ে করে ফেল না।
-যাহ কি যে বলো আপা। তোমার বিয়ে হোক তারপর আমার বিয়ে।
মা মুখ ভার করে থাকেন সবসময়। আর তাকে বলেন, সবকিছুর একটা সময় আছে। সে সময় হারালে জীবনে আর ফিরে আসে না। রতœার বাবা-মুখে কিছু না বললেও তার চোখে মুখে একটা বিষাদের ছায়া লেগেই থাকে। অফিসে কলিগরা বলে- আচ্ছা রত্না তুমি বিয়ে না করে আছো কি করে। রাত্রে তোমার ঘুম আসে। মাধবী বলে আমি তোমার বয়সী। অথচ এখন দু’সন্তানের মা। আরেফের সঙ্গে প্রায় ফোনালাপ হয়। তাই সে কারও কথা গায়ে মাখে না। ধুলো ঝাড়ার মতো করে উড়িয়ে দেয়। বেশ তো কয়েকটা বছর কেটে গেল। আরেফ বলেছে তার লেখাপড়া ইন্টার্নশিপ তারপর পিএইচডি সবই শেষ করে সে এসোসিয়েট প্রফেসার। ভীষণ ব্যস্ততা তার জীবনে। তবুও বলেছে- রত্না তুমি চিন্তা করো না। আমি যত শিগগির পারি সময় বের করে চলে আসব দেশে। তোমাকে পাশে না পেলে আমার জীবন যে শূন্য।
-সত্যি বলছো।
-হ্যাঁ। সত্যি তুমি আমার উপর অগাধ বিশ্বাস রাখতে পারো।
রত্না বিশ্বাস করে আরেফকে। সে জানে ‘বিশ্বাসে মিলায় বস্তু, তর্কে বহু দূর।’
আরেফ তার কথা রেখেছে। বিয়ে করে নিয়ে এসেছে রত্নাকে। বোস্টনে সুন্দর ছোট আর ছিমছাম একটা বাড়ি কিনেছে আরেফ। খুব পছন্দ হয়েছে রত্নার। আরেফকে বলেছে- সত্যি তোমার পছন্দের তারিফ না করে পারা যায় না। চমৎকার বাড়ি। সুন্দর ফুলের গাছ। আরেফ বলেছে বাসার পেছনেও জায়গা আছে। ইচ্ছে করলেই তুমি সব্জি বা ফলের গাছ লাগাতে পারবে। অনেক দিন আগে একটা হিন্দি মুভিতে শুনেছিলাম একটা গান আজ মনে পড়ছে খুবই আরেফ বলে রতœাকে। কি গান গাও তো।
আরেফ গেয়ে শোনায় মৃদু কণ্ঠে ‘মাইনে তো দেখা হ্যায় এক স্বপ্না , ফুলকে গন্ধ হারমে ঘর আপনা।’ রত্না স্বামীর বুকে মুখ রেখে হেসে কুটি কুটি হয়ে পড়ে।
বেশ তো চলছিল তাদের দু’জনের সংসার। রত্নার একটু দেরিতে বিয়ে হলেও বাসার লোকজন, বন্ধু-বান্ধব আত্মীয়স্বজন সবাই বেশ স্বস্তি আর খুশি হয়েছে। রতœা আমেরিকায় এসে প্রথমেই গাড়ি চালানটা শিখে নেয়। এখন ভালোই চালায় সে।
বারবার খবরে বলছে বোস্টনে এবার শীত বরফ ঝড় হওয়ার আশঙ্কা খুব বেশি। ভয়ে রত্নার বুক কেঁপে উঠে। আমেরিকার তুষার ঝড়ের সঙ্গে সে একেবারেই পরিচিত নয়। এই প্রথম দেখবে সে। এদিকে আরেফ ঠিক এ সময়েই গেছে পাশের একটা দেশে ভিজিটিং প্রফেসার হয়ে। রত্না গ্রোসারীতে গিয়ে কিছু প্রয়োজনীয় গ্রোসারী কিনে নিয়ে আসে। আশ্চর্য হয়ে দেখে মানুষের মন প্রায় একই রকম। এ দেশেও বিরূপ আবহাওয়ার খবর পেয়ে সবাই গাড়ি নিয়ে ছুটছে গ্রোসারীতে। আমাদের দেশেও দেখেছে বন্যা দুর্যোগ আসার আগে মানুষ পাগলের মতো খাবার জিনিস কিনে সংগ্রহ করে। এ দেশেও তাই বহু রুটির শেলফ শূন্য। দুধ অরেঞ্জ জুস প্রায় সবই ক্রেতারা নিয়ে গেছে। তবু রত্না একটা দুধের ক্যান ও একটা রুটির প্যাকেট পেল। তার ভাবনা আজ তো ফিরে আসার দিন আরেফের। শহর অন্ধকার করে বাইরে প্রচণ্ড বেগে বাতাস বইছে। আস্তে আস্তে মানুষ চলাচল গাড়ির শব্দ কমে আসছে। রাত বাড়ছে। রত্না রান্না করে রেখেছে আরেফের প্রিয় খাবার মোরগ পোলাউ রায়তা আর শামী কাবাব। জানালার পর্দা সরিয়ে বাইরে দৃষ্টি ছড়িয়ে দেয়। একি এখনই বরফে রাস্তা ফুলের বাগান সব ধবধবে সাদা হয়ে রয়েছে। রত্নার বুক কেঁপে উঠে। আরেফ কিভাবে এই বরফের আস্তরণের উপর দিয়ে গাড়ি চালাবে। সে শুনেছে এ দেশে স্নো জমে গিয়ে ভীষণ স্লিট হয়ে যায়। তার মধ্যে গাড়ি পড়লে অ্যাক্সিডেন্ট হবেই। নানা রকম দুশ্চিন্তায় তার গায়ের রক্ত হিম হয়ে আসে। রত্না ফোন করতে চেষ্টা করে আরেফকে। ফোন সংযোগ বহু কষ্টে পায়। আরেফ বলে এই শহরে তুষার ঝড় নেই। তবে বোস্টন এয়ারপোর্ট থেকে বিশেষ সাড়া না পেলে আজ হয়তো ঘরে ফেরা সম্ভব হবে না। আরেফের কথা শুনে চোখে অন্ধকার দেখে রত্না। তাহলে কি আরেফকে এয়ারপোর্টেই রাত কাটাতে হবে। আর বোস্টন এয়ারপোর্ট যে খুব তাড়াতাড়ি বিষন্ন মেদুর আবহাওয়া থেকে মুক্তি পাবে তারই বা নিশ্চয়তা কোথায়।
রত্না এ ঘর সে ঘর করে ছটফট করে বেড়ায়। সে নিজেও রাতের খাওয়া খেতে পারে না। আরেফের দুশ্চিন্তায় তার ক্ষুধা তৃষ্ণা সব যেন হারিয়ে গেছে। দু’চোখ বেয়ে অশ্রুর বন্যা নামে। কতক্ষণ এভাবে সে কেঁদেছে তার হিসাব নেই। অশ্রু ভেজা টিস্যু পেপারে বাস্কেট ভরে উঠেছে। পরম যত্ন রান্না করা খাবারগুলো টেবিলে রাখা। সবই ঠান্ডা হয়ে গেছে। কত রাত কে জানে, তার ঘড়ি দেখতেও ইচ্ছে করে না। টিভি বন্ধ করে দিয়েছে সে। কেবলই স্থানীয় নিউজে বলছে বোস্টন এয়ারপোর্টের অবস্থা ভালো নয়। বহু প্লেনের উঠানামা বন্ধ করে দেয়া হয়েছে। এয়ারপোর্ট যাত্রীদের দুর্দশা সীমাহীন। আর শুনতে চায় না রত্না। টিভি বন্ধ। নিশ্চুপ ঘরবাড়ি। শ্রান্ত ক্লান্ত রত্নার চোখে ঘুম নেমে আসে। নিরাশার বালুচরে তছনছ হয়ে যায় রত্নার সুখ স্বপ্ন। মনে মনে ভাবে আর বোধ হয় আরেফের সঙ্গে কোনদিনই দেখা হবে না। হঠাৎ তার সেলফোন বেজে উঠে। হাসনা ভাবীর ফোন। হ্যালো বলতে গিয়ে বুক কেঁপে উঠে তার। এ দেশে আসার পর যে ভদ্রমহিলা তাকে অপরিচিত দেশের জীবনযাত্রা সম্পর্কে বহু জ্ঞান দিয়েছে সে আরেফের এখানকার কলীগ কায়সারের স্ত্রী হাসনা ভাবী। বড় ভালো এই ভদ্রমহিলা। যেন আপন বোনের বন্ধনে আবদ্ধ করেছে রত্নাকে।
রতœা ফোন ধরতেই তিনি বলেন- রত্না জানো বোস্টন এয়ারপোর্টে নাকি কয়েকটা প্লেন নামতে পেরেছে। তবে আরেফ সাহেব যেটায় আসছেন সঠিক সেটা নেমেছে কি না বুঝতে পারছি না। ভাঙা কণ্ঠে রত্না বলে ওহ তাই। হাসনা আপা আর ভাবতে পারছি না কিছু।
প্লিজ তুমি ভেঙে পড়ো না। শক্ত করো মনকে।
চেষ্টা করছি ভাবী কান্না জড়িত কন্টে ফোন রেখে দেয় রত্না।
রাত গভীর থেকে গভীর তর হতে চলেছে। বাইরে তুষার ঝড় বইছে। হিটারের উষ্ণতায় বাইরের অবস্থা বোঝা সম্ভব নয়। আরেফ এ সময় পাশে নেই। নিরাশার অন্ধকারে হাবুডুবু খাচ্ছে রত্নার শরীর মন। ঠিক এমনই সময় গ্যারেজের দরজা খোলার শব্দ শুনতে পেল রত্না। ভীত সন্ত্রস্ত তার মন। কে গ্যারেজের দরজা খুলছে। এখানে তো বহু সময়ই বহু রকমের ভয়ঙ্কর ঘটনা ঘটে। তাই সে খুব ভীত। তার ৫ মিনিটের মধ্যেই যে কণ্ঠস্বর শুনতে পেল তাতে রোমাঞ্চিত হলো তার মনপ্রাণ।
আরেফের কণ্ঠস্বর- ‘হানি আই অ্যাম হোম।’
নর্থ ক্যারোলিনা।