হুন্ডির বাংলা দখল বিশ্বব্যাংকের ওয়ার্নিং

সরকারের সদরে চোখ রাঙানি, অন্দরে সায়

বিশেষ প্রতিনিধি : হুন্ডিকে বৈধ-অবৈধ বলার বাস্তবতা শেষ। এ নিয়ে বিতর্কই অবান্তর। ডলারের খোলাবাজার আর ব্যাংক রেটের তফাত হুন্ডিকে কেবল সহায়ক নয়, সামাজিক-অর্থনৈতিক যাবতীয় বৈধতাও এনে দিয়েছে। দেশের রাজনৈতিক নেতা, এমপি, মন্ত্রী, আমলারা কোনো না কোনোভাবে এখন হুন্ডিতে সম্পৃক্ত। কেবল পাচার নয়; উচ্চশিক্ষায় বিদেশগামী শিক্ষার্থী, চিকিৎসায় বিদেশগামী, শপিং ও ভ্রমণে যাওয়া, এমনকি হজযাত্রীরা পর্যন্ত হুন্ডি-নির্ভর। অনৈতিক মনে করা ব্যক্তিরাও বাংলাদেশ ব্যাংক ও বাণিজ্যিক ব্যাংকের বাধায় পড়ে দরকারে হুন্ডি করে। প্রবাসী শ্রমিক, বিদেশে স্থায়ীভাবে বসবাসরত অনাবাসী বাংলাদেশিরাও ব্যাংকিং চ্যানেলের ঝক্কি-ঝামেলা এড়াতে ভরসা করছেন হুন্ডিতে।
এ নিয়ে তারা বা সরকারি মহলও আর কোনো আলোচনা বা প্রশ্নে যেতে চায় না। তাদের সবারই জানা-হুন্ডি ছোট সমস্যা, বড় সমস্যা হচ্ছে পাচার। পাচারের একটা বড় অংশই ঘুষ-দুর্নীতি, চাঁদাবাজির অবৈধ টাকা। এর বাইরের অঙ্কটি আমদানি মূল্য বেশি দেখিয়ে ব্যবসায়ীদের বৈদেশিক মুদ্রা পাচার। এটি মোট পাচারের একটা বড় অংশ। হুন্ডি তাদের সবারই চয়েস। ব্যাংকে ঘুষ- হয়রানি, ব্যাংক ফি, অগ্রিম আয়কর, ব্যাংকের নিম্ন মুদ্রা বিনিময় হার এবং বিভিন্ন পেপার ওয়ার্কের বহুবিদ ঝামেলা, আর্থিক লোকসান ইত্যাদি এড়াতে টাকা আনতে-নিতে হুন্ডিই তাদের কাছে কাক্সিক্ষত।
সরকার কাঁচামাল আমদানিতে শুল্ক ছাড় দিয়ে রপ্তানি আয় দেশে ফেরামাত্রই অগ্রিম আয়কর বা এআইটি কেটে রাখে। ফলে রপ্তানি আয়ের একটা অংশ বিদেশে রাখতে কিংবা পরবর্তী আমদানির জন্য রপ্তানিকারক ডলার বা বৈদেশিক মুদ্রা না ভাঙানোর ঝোঁক দেখান ব্যবসায়ীরা। এআইটি থেকে বাঁচতে তারা বিদেশি বায়ারের যোগসাজশে রপ্তানির এলসি মূল্যমান কম দেখিয়ে বাকিটা হুন্ডিতে মেটান। দেশি ব্যাংক, বিদেশি ব্যাংক, কার্ব মার্কেটসহ দেশে বৈদেশিক মুদ্রার নানান রেট হুন্ডিকেও বাজারের মর্যাদায় নিয়ে এসেছে। এই ভিন্নতা থাকায় প্রবাসীরা নির্ধারিত রেটে ডলার কেনাবেচা কোনোটাই করতে পারেন না। ব্যাংকে এলসি নিষ্পত্তির ডলার হারও বাড়তি। বিদেশ থেকে ব্যাংকে বৈদেশিক মুদ্রা পাঠালে বা ভাঙালে নির্ঘাত ঠকতে হয়। তার ওপর নানা যন্ত্রণা। তাই হুন্ডি তাদের কাছে কেবল ঝামেলামুক্ত নয়, লাভজনকও।
বিদেশগামী ছাত্র, ব্যবসায়ী, রোগী কিংবা পর্যটক সরকারি-বেসরকারি যেকোনো ব্যাংকে গেলে রীতিমতো আসামির কাঠগড়ায় দাঁড়ানোর অবস্থায় পড়েন। কিনতে গেলে, বেচতে গেলে প্রশ্নের পর প্রশ্ন। নানা কাগজপত্র ডিমান্ডসহ হয়রানি। এর বিপরীতে হুন্ডি এজেন্টরা ফোন দিলে বাসায় টাকা ও বৈদেশিক মুদ্রা নিয়ে হাজির হয়ে যায়। এমন হোম সার্ভিস বিদেশগামী ছাত্র, ব্যবসায়ী, রোগী, পর্যটক, পাচারকারী সবার জন্যই স্বস্তির। যার অনিবার্য জেরে দেশে বৈদেশিক মুদ্রার দৃশ্যত আমদানি ক্রমশ আঁতকে ওঠার দশায়। বাংলাদেশ ব্যাংকের হিসাব অনুযায়ী, গত ছয় অর্থবছরের মধ্যে প্রথম ২০২১-২২ অর্থবছরে ১৫ শতাংশ প্রবাসী আয় কমেছে। বাংলাদেশের মোট দেশজ উৎপাদন- জিডিপির ৬ শতাংশের বেশি আসে প্রবাসী আয় থেকে। গার্মেন্টস পণ্য রপ্তানির পর এ রেমিট্যান্সই বাংলাদেশের বৈদেশিক মুদ্রা আয়ের বড় উৎস। এ-সংক্রান্ত হিসাব এখন বিশ্বব্যাংকসহ আরো কেউ কেউ রাখে। বিশ্বব্যাংক বলছে, ২০২২ সালে বিশ্বব্যাপী রেমিট্যান্স-প্রবাহ বেড়ে ৬৩০ বিলিয়ন ডলার পৌঁছাবে। আর চলতি বছরে ব্যাংকিং চ্যানেলের মাধ্যমে বাংলাদেশে রেমিট্যান্স-প্রবাহ বাড়বে মাত্র ২ শতাংশ। এ রকম অবস্থায় গত দুই বছর ধরে রেমিট্যান্সের পড়তির মাঝেও প্রায় নিয়মিত সরকারের তরফে রেমিট্যান্স বিষয়ে উচ্চাশার খবর দেওয়া হয়। রেমিট্যান্সে ৩০ বছর ধরে বাংলাদেশের একটানা পজিটিভ গ্রোথের মাঝে আগের অর্থবছরে এসেছিল ২৪.৭৭ বিলিয়ন ডলার। এক বছরে তা কমে এসেছে ৩.৭৪ বিলিয়ন ডলারে।
করোনা, বিশ্বমন্দা, রুশ-ইউক্রেন যুদ্ধসহ নানান যুক্তি দিলেও রেমিট্যান্সের এই উল্টো রথে ১৫.১২ শতাংশ ঋণাত্মক প্রবৃদ্ধি অবশ্যই চিন্তার বিষয়। এর পূর্বাপরে আরো বহু কাহিনি, বিশেষ করে হুন্ডির বিস্তার এক উপাখ্যানের মতো। তবে রেমিট্যান্সের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট বাংলাদেশ ব্যাংক, রামরু, বিবিএস, বিএমইটিসহ কারো হিসাব ভিন্ন। তাদের হিসাবে প্রবাসী বাংলাদেশির সংখ্যা ১ কোটি ২০ লাখ। আর দেশের আমদানি-রপ্তানির আকার বিবেচনায় দেশের বার্ষিক রেমিট্যান্স ৪০ বিলিয়ন ডলারের কম নয়। হুন্ডিকে ব্যবসা হিসেবে নেওয়া ব্যক্তি ও সিন্ডিকেট দেশে-বিদেশে তৎপর। ক্ষেত্রবিশেষে অত্যন্ত ডেসপারেট। তাদের সিস্টেমের কাছে সরকার অসহায়। কখনো কখনো জড়িতও। হুন্ডিওয়ালারা ব্যাংকের ঘোষিত রেট থেকেও কমপক্ষে ৬ টাকা বেশি দিয়ে প্রবাসীদের প্রলুব্ধ করে। তার ওপর প্রবাসে অবৈধ হয়ে পড়া কর্মীদের ভরসা করতে হয় হুন্ডিতেই। সাকল্য এ পরিস্থিতিতে প্রতিবছর প্রবাসীদের পাঠানো অর্থের সঠিক হিসাব নির্ণয়ের কোনো উপায় থাকছে না। সরকার জানাতে পারছে কেবল ব্যাংকের মাধ্যমে আসা অঙ্কটি। এ থেকে আর বেরোনোর পথ নেই। মাঝেমধ্যে সরকার হুন্ডির দিকে চোখ রাঙানি দিলেও চোখের ইশারায় হুন্ডিতেই সায় দিতে হচ্ছে।