হুমকিতে বিশ্ব ঐতিহ্য সুন্দরবন

গ্রামবাংলা ডেস্ক : ভারত আন্তর্জাতিক আইন অমান্য করে গায়ের জোরে উজান থেকে অভিন্ন নদ-নদীর পানি না দেওয়ায় মারাত্মক ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে বিশ্ব ঐতিহ্য সুন্দরবন। বঙ্গোপসাগরের কূল ঘেঁষে প্রাকৃতিকভাবে গড়ে ওঠা সুন্দরবন পৃথিবীর অনন্য সম্পদ। মাকড়াসার জালের মতো ছোট-বড় অসংখ্য নদ-নদীতে বেষ্টিত সুন্দরবন। ৪৫০টির বেশি ছোট-বড় নদী রয়েছে এই বনকে ঘিরে।

সমুদ্রের জোয়ার-ভাটার ওপর নির্ভর সুন্দরবনের জীববৈচিত্র্য। উজানে পানি প্রবাহ কমে যাওয়া ও পলি বৃদ্ধি, গভীরতা হ্রাসে তিন দশকের ব্যবধানে সুন্দরবনের অধিকাংশ নদ-নদী জৌলুস হারিয়েছে। বঙ্গোপসাগরের সাথে যুক্ত সুন্দরবনের নদ-নদীর পানির প্রবল নেই বললেই চলে। স্রোতহীন নদ-নদীর কারণে সমুদ্র হয়ে উঠছে উত্তপ্ত। সংশ্লিষ্ট বিশেষজ্ঞ ও বিজ্ঞানীদের তথ্যে এসব জানা গেছে।

সূত্রমতে, সুন্দরবনের বনভূমি এখন বিপদের সন্মুখীন। উদ্ভিদ জীববৈচিত্র্য, পরিবেশ ও উপকূলীয় অঞ্চল চরম হুমকিতে পড়েছে। আর এসব নদ-নদীতে রয়েছে হরেক রকম মাছের সমাহার। মৎস্যসম্পদের অফুরন্ত ভাণ্ডার সুন্দরবনের নদ-নদী। নদী ও পরিবেশ বিশেষজ্ঞ এবং সংশ্লিষ্ট মহল থেকে উদ্বেগ প্রকাশ করে বলা হয়েছে, ভারত আন্তর্জাতিক আইন লংঘন করে অভিন্ন নদীর পানি প্রত্যাহার সুন্দরবনের মূল ছয়টি নদী শিবসা, পশুর, খোলপেটুয়া, কালিন্দি, বলেশ্বর, মালঞ্চ দিয়ে নদ-নদীর পানি বঙ্গোপসাগরে পড়ার স্বাভাবিক ধারা হয়েছে অস্বাভাবিক।

রায়মঙ্গল ও আড়পাঙ্গাসিয়া নদীসহ ছোট-বড় অসংখ্য খাল ও নালা রয়েছে সুন্দরবনে। স্রোতহীন নদ-নদীর পানি এক রকম চুইয়ে পড়ার মতো অবস্থার কারণে লবণাক্ততা গ্রাস করছে নতুন নতুন এলাকা। ভূমি গঠনেরও পরিবর্তন ঘটছে। সুন্দরবনে বনজ ও জলজ প্রাণী এবং নানা প্রজাতির পাখির কলতান দিনে দিনে কমছে। সুন্দরী, গেওয়া, শাল, কেওড়া, বাইন, কাকড়া, পশুর, ধন্দুল ও গোলপাতাসহ উপকুলীয় সবুজ বেষ্টনী গ্রিন বেল্টও হচ্ছে ক্ষতিগ্রস্ত। সমানতালে পলি পড়ে ভরাট হয়ে যাচ্ছে বন ও লোকালয় সংলগ্ন শাখা-প্রশাখার অধিকাংশ নদ ও খাল। এতে এক দিকে যেমন নদী মাছ শূন্য হয়ে যাচ্ছে, অন্য দিকে জীবন-জীবিকা হারিয়ে বেকার। অন্তত ৩০ হাজার জেলে এখন বেকার।

এক গবেষণাপত্রে বলা হয়েছে, “হিমালয়ের প্রাকৃতিক পরিবেশের অবনতি বা ‘গ্রিন হাউস’ এর কারণে সমুদ্রের উচ্চতা বৃদ্ধি পাচ্ছে। উপকূল বরাবর সুন্দরবনের গঠন প্রকৃতি বহুমাত্রিক উপাদানে প্রভাবিত। যাদের মধ্যে রয়েছে, স্রোতের গতি, ব্যষ্টিক ও সমষ্টিকস্রোত চক্র এবং সমুদ্র উপকূলবর্তী দীর্ঘ সমুদ্রতটের স্রোত। মিষ্টি পানির প্রবাহ হ্রাস, বনের অভ্যন্তরে নদ-নদীতে পলির আধিক্য, পুষ্টি সরবরাহ হ্রাস, লবণাক্ততা বৃদ্ধি, স্বাভাবিক জোয়ার-ভাটা বাধাগ্রস্ত এবং জলাবদ্ধতা, জলোচ্ছ্বাসসহ নানাবিধ প্রাকৃতিক দুর্যোগের কারণে এ রোগ ছড়িয়ে পড়ছে।

গবেষণা সূত্রে জানা গেছে, ভারতের ফারাক্কা বাঁধের কারণে মিঠা পানি প্রবাহ একেবারেই কমে গেছে। একইসাথে সমুদ্রের লোনা পানির উচ্চতা বৃদ্ধি পেয়েছে, যা সুন্দরবনের অনেক ভেতরে ঢুকে গেছে। ফলে এ অঞ্চলে মিষ্টি পানির প্রবাহ সংকট চরমে। এ কারণে সুন্দরী, পশুরসহ অন্যান্য গাছে আগামরা রোগ ছড়িয়ে পড়েছে। এ রোগের কারণে বনের প্রায় ৫০ শতাংশ সুন্দরী গাছ হ্রাস পেয়েছে। এখন পশুর গাছও ব্যাপকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে। পরিবেশ বিশেষজ্ঞরা বলেন, লোনা ও মিঠা পানির প্রবাহের মাত্রার হেরফের ঘটলে ম্যানগ্রোভ বনের ক্ষতি হয়।

বাংলাদেশের দক্ষিণ-পশ্চিমে বঙ্গোপসাগরের কোলে অবস্থিত সুন্দরবন। ভারতের ২৪ পরগনার দক্ষিণ ভাগও সুন্দরবন। পশ্চিমে ভাগীরথি নদীর মোহনা থেকে পূর্বে মেঘনার মোহনা পর্যন্ত সুন্দরবন বিস্তৃত। সংশ্লিষ্ট সুত্রমতে, ৬ হাজার ১৭ বর্গকিলোমিটার বিস্তৃত সুন্দরবনের ৪ হাজার ১৪৩ বর্গকিলোমিটার ভূ-ভাগ আর ১ হাজার ৮৭৪ বর্গকিলোমিটার জলভাগ। সমুদ্রের পানির উচ্চতাবৃদ্ধির ফলে সমুদ্র উপকূলীয় অঞ্চল ক্রমাগতভাবে ডুবে যাচ্ছে। জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাবে সুন্দরবনের রয়েল বেঙ্গল টাইগার, হরিণ, সাপ, শুকর, বানর, কাঠবিড়ালি, বাজপাখি ও শকুনসহ বিভিন্ন পশু-পাখির বিলুপ্তির পথে। পানি উন্নয়ন বোর্ডসহ সংশ্লিষ্ট বিভাগ ও নদী বিশেষজ্ঞদের মতে, সুন্দরবনের অভ্যন্তরে এবং তার চারপাশে ছড়িয়ে থাকা নদী ও খালগুলো ক্রমাগতভাবে মরে যাচ্ছে।

সূত্র জানায়, সুন্দরবনের নদ-নদীতে এখন আর আগের মতো জোয়ার-ভাটার খরস্রোত নেই। সুন্দরবনের উল্লেখযোগ্য নদী ও খাল হচ্ছে- গঙ্গাসাগর, বেতমুড়ি, সুপতি, ছাপড়াখালি, কাপা, বড়শেওলা, চান্দেশ্বর, হরিণটানা, হড্ডা, নীলকমল, হরিখালি, পুষ্পকাঠি, তেরোকাঠি, ইলিশমারি, চালতাবাড়ি, ভায়েনা, আমবাড়ি, দক্ষিণচরা, ধুখালি, আন্ধারমানিক, আশাশুনি, তালপাঠি, মুকুলে, রাগাখালি, বকশিখালি, মাতলা, পারশেমারী, মাথাভাঙ্গা, মালাবগা, লক্ষী, কাঠেশ্বর, খেজুরদানা, হংসরাগ, চুনকুড়ি, সাপখালি, মানকি, বাইলো, বন্দো, থাসিবুনে, ভেটুইপাড়ি, শাকবাড়িয়া, লবণখোলা, পালকি, বাইনতলা, বগিম, মরা পশুর। সুন্দরবনের নদী আড়পাঙ্গাসিয়া, মাদার, মালঞ্চ ও চূনার মধ্যখানেও জেগে উঠছে বড় বড় চর। এর নিকটস্থ যমুনা নদী মৃতপ্রায়। কাকশিয়ালী নদীরও নাব্যতা হারিয়ে যাচ্ছে দিন দিন। অন্যতম বেতনা নদীও তার নাব্যতা হারিয়ে পুরোপুরি একটি মৃত খালে রূপ নিয়েছে।