রেভারেন্ড ফাদার স্ট্যানলী গমেজ :
আন্তর্জাতিক ভাষা দিবস মহান একুশে ফেব্রুয়ারি উপলক্ষে সকল বাংলাভাষীকে জানাই প্রীতি নমস্কার ও অভিনন্দন, এমন একটি চমৎকার, ঐতিহ্যময় ও অভিনব ভাষা আমাদের মাতৃভাষা হিসেবে পাওয়ার জন্য। বাংলা ভাষাপ্রেমিক, সৈনিক ও বিপ্লবী, যারা এই ভাষাকে রক্ষা করার জন্য জীবন দিয়েছেন, অত্যাচারিত হয়েছেন, প্রত্যক্ষ কিংবা পরোক্ষভাবে ভাষা আন্দোলনের সঙ্গে যুক্ত ছিলেন, তাদের সবার প্রতি সম্মান, শ্রদ্ধা ও কৃতজ্ঞতার ডালি। তাদের স্মৃতি, ত্যাগ স্বীকার এবং সুকর্ম বর্তমান ও ভবিষ্যৎ প্রজন্মকে অনুপ্রাণিত করুক।
প্রবাসজীবনে বহু ভাষা ও সংস্কৃতির মাঝে জীবিকা নির্বাহ এবং বসবাস করেও নিজ মাতৃভাষা বাংলায় সাহিত্য, সংবাদ, বিজ্ঞাপন পড়ার ও অবগত হওয়ার মাধ্যম হিসেবে ‘ঠিকানা’ পত্রিকা পাওয়া আমাদের জন্য পরম সৌভাগ্য। দেখতে দেখতে নিউইয়র্ক পৌর এলাকার বাংলাভাষীদের প্রিয় বাংলা সাপ্তাহিকী ‘ঠিকানা’ ৩৪তম বর্ষে পদার্পণ করেছে। বিগত বছরগুলোতে এই পত্রিকা প্রবাসীদের পাশে এসে দাঁড়িয়েছে লেখনীর মাধ্যমে অনুপ্রেরণা ও উৎসাহ দিয়ে, প্রয়োজনীয় তথ্য সরবরাহ করে, একে অন্যের সঙ্গে যোগাযোগের ব্যবস্থা করে দিয়ে। তাই এই পত্রিকার গুরুত্ব আমাদের কাছে অপরিসীম। ‘ঠিকানা’র প্রতিষ্ঠাতা, প্রকাশক, সম্পাদকমণ্ডলী, লেখক-লেখিকা, পাঠক-পাঠিকা, বিজ্ঞাপনদাতা ও সকল সহায়তাকারীকে প্রতিষ্ঠাবার্ষিকীতে সাদর সম্ভাষণ ও অভিনন্দন এতগুলো বছর বাংলা ভাষা ও এর সঙ্গে যারা ওতপ্রোতভাবে সম্পৃক্ত, তাদের সেবায় ব্রতী থাকার জন্য।
মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে ফেব্রুয়ারি মাসটি পালিত হয় ‘কৃষ্ণাঙ্গ ইতিহাস মাস’ হিসেবে। পঞ্চদশ শতাব্দী থেকেই পর্তুগিজ, ওলন্দাজ ব্যবসায়ীরা সমুদ্রপথে পশ্চিম আফ্রিকা থেকে কৃষ্ণাঙ্গ পুরুষ, নারী ও শিশুদের প্রথমে দক্ষিণ আমেরিকা ও পরে ইংরেজদের মাধ্যমে উত্তর আমেরিকায় ইংরেজ উপনিবেশে ক্রীতদাস হিসেবে আনতে থাকে। দক্ষিণ অঙ্গরাজ্যগুলোতে তামাক ও তুলা ক্ষেতে কাজের জন্য এই কৃতদাসদের অমানবিকভাবে ব্যবহার করা হতো। খামারের জীবজন্তুর মতোই এদের কেনাবেচা হতো। ফলে এদের পারিবারিক জীবন যেমন বিধ্বস্ত হয়েছে, তেমনি মনস্তাত্ত্বিকভাবেও কৃষ্ণাঙ্গদের জীবন ব্যাহত হয়েছে বিভিন্ন প্রজন্মে। দাসত্ব প্রথা বহু প্রচেষ্টা, এমনকি উত্তর ও দক্ষিণের রাজ্যগুলোর মাঝে গৃহযুদ্ধের পর দূর হলেও বর্ণভেদ এখনো উঠে যায়নি।
শ্বেতাঙ্গ ও কৃষ্ণাঙ্গদের মাঝে ভেদাভেদ এখনো পুরোপুরি কাটেনি। অভিবাসী হিসেবে আমরা বাঙালিরাও অনেক সময় বর্ণভেদের শিকার হই, আবার আমরাও কখনো আমাদের চাইতে গাঢ় বর্ণের মানুষদের নিচু ভাবি, যা অনুচিত ও অনৈতিক। তবে এই ইতিহাস থেকে বিভিন্ন শিক্ষার পাশাপাশি আমরা সমব্যথী হতে পারি এই ভেবে যে মার্কিন-কৃষ্ণাঙ্গরা ওদের পূর্বপুরুষদের দেশ ও ভাষা এবং পারিবারিক জীবনবন্ধন হারাতে বাধ্য হয়েছে; কিন্তু আমাদের সৌভাগ্য যে আমরা আমাদের ভাষা ও পারিবারিক বন্ধন অটুট রাখতে সুযোগ পাচ্ছি। তাই সমব্যথী বাঙালি হৃদয় বাংলা ভাষাকে সুব্যবহার করে ব্যথিতকে সান্ত্বনা জানায়, বাংলা সুরধ্বনিতে অন্যকে মুগ্ধ করে এবং বাংলা পদ্যের তালে হৃদয়-মনকে উষ্ণ করে। সে জন্যই আমাদের হৃদয়ের ঠিকানা এই প্রিয় বাংলা ॥
লেখক : কলামিস্ট।