লুৎফর রহমান রিটন
আমার চিরকালের অভ্যেস প্রকৃতি আর মানুষ দেখা। যেখানেই যাই গভীর মনোযোগে আমি মানুষ দেখি। কতো রকমের মানুষ যে আমাদের চারপাশে! একেকটা মানুষের সঙ্গে ঘুরে বেড়ায় বিচিত্র সব চরিত্র। একেকটা মানুষ আমার কাছে একেকটা গল্প বা উপন্যাসের মতো। কোনো কোনো মানুষ আবার একটি গল্প নয়, অনেকগুলো গল্পের সংকলন রীতিমতো। মানুষ নামের গ্রন্থ আমি পাঠ করি গভীর অভিনিবেশযোগে।
রাস্তা, লঞ্চ-স্টিমার-ট্রেন-বাস-জাহাজ কিংবা উড়োজাহাজ, খেয়াঘাট কিংবা স্টেশন, এয়ারপোর্ট, সৈকত কিংবা পার্কে আমার গল্পেরা ঘুরে বেড়ায়। হেঁটে বেড়ায়।
কানাডায় এসেছি আমি ২০০২ সালে। তখন, সহায় সম্বলহীন বন্ধুহীন, আত্মীয়-স্বজনহীন আমার নিস্তরঙ্গ প্রবাস জীবনে আমাকে সঙ্গ দিতো অজস্র বৃক্ষশোভিত অটোয়ার সবুজ পার্ক আর অটোয়া রিভার নামে খ্যাত নদীটা। আমি আমার কষ্টের কথা, বেদনার কথা, কান্নার কথাগুলো তখন ম্যাপল-ওক-বার্চ কিংবা পাইন ট্রির কাছে বলতাম। বলতাম অটোয়া রিভারের কাছে। আমার গল্পগুলো ওদের কাছে বলবার সময়েও আমি চোখের সামনে ঘুরে বেড়ানো মানুষের গল্পগুলোর সঙ্গে পরিচিত হতাম। বইয়ের পাতায় গল্প থাকে, তাকে পড়ে নিতে হয় আর মানুষ নামের বইয়ের গল্পটা দেখে নিতে হয়।
গত কুড়ি বছরের প্রবাস জীবনে কতো গল্পই না দেখলাম!
প্রতি সামারে পার্কে একটা কমন গল্পের কয়েকটা কমন চরিত্রের সঙ্গে আমার দেখা হয়। সিকোয়েন্সটা এরকম- বয়েসে তরুণ একটা কাপল হাঁটছে। ওদের পেছন পেছন হাঁটছেন দুজন প্রবীণ প্রবীণা। এই প্রবীণ প্রবীণার পরনের পোশাক প্যান্ট-শার্ট আর শাড়ি কিংবা সালোয়ার কামিজ। প্রবীণ প্রবীণার গায়ের রঙ পোশাক আর হাঁটার ভঙ্গি দেখলেই বোঝা যায় ওঁরা এসেছেন মূলত ভারত-পাকিস্তান-শ্রীলংকা কিংবা বাংলাদেশ থেকে।
প্রবীনের পরনের ঢিলেঢালা শার্ট আর ঢিলেঢালা প্যান্টের সঙ্গে জুতো কিংবা স্যান্ডেলের জায়গায় বেঢপ মাপের বেমানান একজোড়া কেডস বা স্নিকার। এরকম প্যান্টের সঙ্গে এরকম স্নিকার একদম যায় না। প্রবীনার পরনে শাড়ি কিংবা সালোয়ার কামিজের সঙ্গেও উদ্ভট আকারের একজোড়া কেডস বা স্নিকার। এইরকম বেকায়দা জুতো পায়ে প্রবীণ প্রবীণা প্রাণপণে হেঁটে চলেন পুত্র-পুত্রবধু কিংবা কন্যা আর জামাতার পিছু পিছু। প্রাণপণে বলছি এই জন্যে যে অধিকাংশ সময়েই তরুণ যুগলের হাঁটার স্পিডের সঙ্গে প্রবীনরা পেরে ওঠেন না। হাঁটার সময় ধীরে ধীরে ওদের দূরত্বটা তাই বেড়েই চলে।
এই দৃশ্যের সঙ্গে প্রায়ই যুক্ত থাকে একটা স্ট্রলার। এবং স্ট্রলারটা ঠেলে সামনে নেয়ার দায়িত্বটা বেশির ভাগ সময়ই পালন করেন প্রবীণ প্রবীণা। যে স্ট্রলারে বসে বা শুয়ে থেকে প্রবীণ প্রবীণার উৎফুল্ল খুদে নাতি বা নাতনিটা পিটপিট করে তাকিয়ে বৈকালিক আউটডোর সৌন্দর্যটা অবলোকন করে স্বর্গীয় হাসিতে উদ্ভাসিত হতে হতে।
সন্তানদের পেছনে ওরকম স্নিকার পরা প্রবীণ প্রবীণা হাঁটতে হাঁটতে নিজেদের মধ্যে কী কথা কয় সেটা কোনোদিন জানতে পারিনি আমি। কিন্তু যতোবার আমি তাকাই ওদের দিকে, ওদের বডি ল্যাংগুয়েজ আমাকে বলে দেয় কবি আসাদ চৌধুরীর একটা কবিতার বইয়ের নাম- ‘দুখিরা গল্প করে’।
আহারে! শেষ জীবনে কী রকম কঠিন এক অকুল দরিয়ায় নিক্ষিপ্ত হলেন তাঁরা! দ্বিধায় কাতর তাঁদের ভাঁজপরা চামড়ার অমসৃন মুখ আর সংকোচে বিহ্বল ওঁদের ক্লান্ত চোখ জোড়া যেনো বলে- এ কোথায় এসে পড়লাম! ডুবে যাচ্ছি ডুবে যাচ্ছি! আর তো সাঁতরানো যায় না! নিঃশ্বাস তো বন্ধ হয়ে যাচ্ছে রে বাবা…!
০২
আমার কন্যা নদী তখন অটোয়া বেলস্ কর্নার স্কুলে পড়ে। সপ্তাহে ছুটির দিনে পার্ট টাইম কাজও করে। কাজ থেকে ফিরে এসে একদিন খুব মন খারাপ করা একটা গল্প বললো আমাকে। ডাউন টাউন থেকে কাজ থেকে ফিরছিল নদী। লিংকনফিল্ডস বাস স্টপে এসে পরবর্তী কানেকটিং বাসের জন্যে অপেক্ষা করছিলো সে। বেঞ্চে ওর পাশে অপেক্ষারত এক অভিজাত সুন্দরী ভদ্রমহিলা। ভারতীয়। খুব পরিপাটি পোশাকে আশাকে। লাল একটা টিপ পরা সেই ভদ্রমহিলার সঙ্গে কয়েক মিনিটের আলাপের একপর্যায়ে তিনি তাঁর কন্যাসম নদীকে অতি অনায়াসে বলে ফেললেন তাঁর জীবনের গল্পটা। একটা পার্ট টাইম জব করেন তিনিও। কানাডায় এসেছেন মেয়ের সংসারে- মেয়ে, মেয়ে জামাই আর নাতির সঙ্গে বাকি জীবনটা হেসে খেলে মহানন্দে কাটাবেন বলে। কোলকাতায় একটা বুটিক শপ ছিলো তাঁর। স্বামী বেঁচে নেই। একটিমাত্র মেয়েকে মানুষ করেছেন একা একা লড়াই করে। সেই মেয়েটা বিদেশে চলে এসেছে উন্নততর বিলাসী জীবন আর কেরিয়ারের প্রয়োজনে। সেই মেয়ের সংসারে নতুন অতিথি এসেছে কয়েক বছর হলো। মাকে তাই কোলকাতা থেকে উড়িয়ে নিয়ে এসেছে মেয়ে আর মেয়েজামাই। এখানে আসার আগে ভদ্রমহিলা মারাত্মক একটা ভুল করে এসেছেন। মেয়ে আর মেয়ে জামাইয়ের মধুর প্ররোচনায় বিগলিত হয়ে বেঁচে থাকার একমাত্র অবলম্বন বুটিক শপটা বিক্রি করে দিয়েছেন। লেখাপড়া জানা অভিজাত ভদ্রমহিলা ঘুণাক্ষরেও টের পাননি কতো বড় ফাঁদে তিনি পা দিয়েছেন। এখানে এসে কয়েক মাসের মধ্যেই ভদ্রমহিলা বুঝে গেছেন মেয়ে আর জামাতাবাবাজী তাঁকে কানাডায় এনেছেন ওদের নিজেদের স্বার্থ হাসিলের উদ্দেশ্যেই। ওরা দুজনেই ভালো জব করে। ওদের খুদে সন্তানের দেখাশোনা, ওকে স্কুলে আনা নেয়া, বাড়িঘর ঝকঝকে পরিচ্ছন্ন রাখা আর রান্নাবান্নার সমস্ত দায়িত্ব ওরা চাপিয়ে দিয়েছে ভদ্রমহিলার কাঁধে। একপর্যায়ে তাঁর মনে হয়েছে ওরা ওদের মা কিংবা শাশুড়িকে এইদেশে আনেনি, এনেছে একজন বেবিসিটারকে। একজন কাজের বুয়াকে।
শুনে নদী বলেছিলো–তুমি চলে যাচ্ছো না কেনো কোলকাতায়? কেনো পড়ে আছো এখানে!
অশ্রুসজল চোখে ভদ্রমহিলা বলেছেন- চলে যেতেই তো চেয়েছি কিন্তু আমার পাসপোর্ট ওরা আটকে রেখেছে। আমি জানি পুলিশকে জানালে সঙ্গে সঙ্গেই পাসপোর্টটা আমি পেয়ে যাবো কিন্তু তার আগে আমি আমার ফেরার টিকিটের টাকাটা প্লেন ফেয়ারটা নিজেই উপার্জন করে নিচ্ছি। আমি ফিরে যাবো আমার নিজের টাকায় কেনা এয়ার টিকিটে। মেয়ে বা মেয়ের জামাইয়ের কাছ থেকে নেবো না। বুটিক শপটা বিক্রি করে দিয়ে বিপদেই পড়েছি। এখন, দেশে ফিরে গিয়ে শুন্য থেকেই ফের শুরু করতে হবে জীবনসংগ্রাম। করবো। কিন্তু এখানে এই গ্লানির জীবন আমি আর বহন করবো না।
নদীর কাছে গল্পটা শুনে পর পর কয়েকটা দিন আমি সেই বাসস্টপে গিয়ে সেই মায়ের খোঁজে বসে থেকেছি। কিন্তু আর দেখা পাইনি তাঁর। কে জানে শিক্ষিত অভিজাত সে ভদ্রমহিলার জীবনের শেষ লড়াইয়ের পরিণতিটা কেমন ছিলো!
না দেখা সেই ভদ্রমহিলার কথা ভেবে এবং আমার দেখা আমেরিকা-ইংল্যাণ্ড-কানাডাসহ পৃথিবীর নানা দেশের প্রবাসী বাবা মায়েদের বেকায়দা পরিণতির কথা ভেবে আমি তখন, মা দিবস উপলক্ষে একটা কবিতা লিখেছিলাম। কবিতার নাম ‘প্রবাসী এক দুখিনী মায়ের প্রার্থনা’। রচনাকাল ১২ মে ২০০৭। পরদিনই কবিতাটা ছাপা হয়েছিল দৈনিক জনকণ্ঠ পত্রিকায়।
কবিতাটা ছাপা হওয়ার পর সেবছর ২০ মে সাংস্কৃতিক ব্যক্তিত্ব রামেন্দু মজুমদারের একটা ইচিঠি পেয়েছিলাম। তিনি লিখেছিলেন–
Dear Riton
I liked your poem in Janokantha on the Mother’s Day and read it out to Ferdausi.
She was so excited that she took it to her school Sunbeams and it was a hotcake among the teachers. It’s really a wonderful piece full of emotions.
How are you?
Warm regards to you from both of us.
Ramenduda
20.05.2007
রামেন্দু দার কাছেই(?) জেনেছিলাম, ভাবী ফেরদৌসী মজুমদার আমার কবিতাটা তাঁর কর্মস্থল সানবীমস্ স্কুলের টিচার্স রুমের দেয়ালে উৎকীর্ণ করে দিয়েছিলেন। তাঁর মতো মহাবিখ্যাত একজন অভিনয় শিল্পীকে এতোটাই আলোড়িত করেছিল সেই কবিতাটা।
০৩
২০০৯-১০ সালে একুশের বইমেলা শেষে বাংলাদেশ থেকে কানাডায় ফেরার পথে কয়েকটা দিন লণ্ডনে স্টপওভার নিয়েছিলাম বন্ধুদের সঙ্গে স্রেফ আড্ডা মারবো বলে। অবস্থান করছিলাম বন্ধু সৈয়দ বেলাল আহমেদের বাসভবনে। একদিন আরেক প্রীতিভাজন বেলালদের আত্মীয় সাংবাদিক সৈয়দ আনাস পাশা বললো, রিটন ভাই এখানকার ‘বাংলা টিভি’তে একটু সময় দেন। আপনার একটা সাক্ষাৎকার নিতে আগ্রহী বাংলা টিভি। আমি কিছুটা অনাগ্রহ দেখালে আনাস বলেছিল- যিনি আপনার ইন্টারভিউ নেবেন তাঁর নামটা শুনলে আপনি না করতে পারবেন না জানি।
-কে নেবেন আমার ইন্টারভিউ?
-লায়লা বানু। বিটিভির এনাউন্সার ছিলেন। নিউজকাস্টার ছিলেন।
লায়লা বানুর নাম শুনে খুশি হয়ে উঠেছিলাম আমি- তাই নাকি? লায়লা ভাবী লণ্ডনে থাকেন! আমি নিশ্চয়ই যাব।
দিন তারিখ সময় নির্ধারিত হলো। নির্ধারিত দিনে আনাস আমাকে ড্রাইভ করে নিয়ে গেলো বাংলা টিভি কার্যালয়ে।
অনেক বছর পর দেখা হলো আমাদের। লায়লা ভাবী মহা উচ্ছ্বসিত আমাকে দেখে। আমিও। আমার জন্যে পরম মমতায় সুস্বাদু মুখরোচক কিছু পিঠা বানিয়ে এনেছিলেন ভাবী- রিটন অনুষ্ঠান রেকর্ডিং-এর আগে পিঠাগুলোর যে কয়টা পারো খাও। আমি নিজের হাতে বানিয়েছি তোমাকে খাওয়াবো বলে।
খুব মজাদার পিঠার কয়েকটা সাবাড় করে আমরা গেলাম স্টুডিওতে। ওখানে ক্যামেরাপার্সন হিসেবে দায়িত্বরত মিলুও আমার পূর্ব পরিচিত দেখলাম। তিনিও আমাকে পেয়ে যারপর নাই খুশি। আমাকে আগে থেকেই জানানো হয়েছিল ইন্টারভিউর শেষ দিকে উপস্থাপক আমার কণ্ঠে একটা ছড়া শুনতে চাইবেন। আমি যেনো তৈরি থাকি। আমি তাই সঙ্গে নিয়ে গিয়েছিলাম সদ্য প্রকাশিত (২০০৮ এর ফেব্রুয়ারিতে)- ‘আসেন কাকা এইবার একটা শান্তিচুক্তি করি’ নামের বড়দের উপযোগী ছড়ার বইটা।
কানাডায় প্রবাস জীবন বেছে নেয়ার আগেই ঢাকার এটিএন বাংলায় লায়লা বানুর আমন্ত্রণে বা আহ্বানে তাঁরই উপস্থাপিত দুটি অনুষ্ঠানে আমি অংশ নিয়েছিলাম। সুতরাং আমাদের টিউনিংটা করাই ছিল। টিভি স্টুডিও, ঝলমলে সেট, তীব্র উজ্জ্বল আলোর নিচে বসা, আমাদের সামনে একটা ছোট টেবিল, টেবিলের ওপর দুটো চা অথবা কফি কাপ, তার ভেতরে স্বচ্ছ জল এবং রোল ক্যামেরা ফাইভ ফোর থ্রি টু ওয়ান জিরো একশন কিংবা ক্যামেরার লাল বাতি জ্বলে ওঠা বিষয়গুলোয় এক জীবনের অভিজ্ঞতায় আমরা দুজনেই অভ্যস্ত বলে উইদাউট ফাম্বলিং-এ আনকাট একটা ইন্টারভিউ সম্পন্ন হলো। শেষে লায়লা বানু আমাকে একটা ছড়া এই অনুষ্ঠানের দর্শকদের উদ্দেশ্যে পাঠ বা আবৃত্তি করে শোনানোর অনুরোধের পর দর্শকদের কাছ থেকে বিদায় নিয়ে বললেন- লুৎফর রহমান রিটনের ছড়ার মাধ্যমেই শেষ হবে আমাদের আজকের অনুষ্ঠান।
টেবিলের ওপর রাখা আমার বইটা তুলে নিয়ে আমি বললাম- গেলো বছর মা দিবস উপলক্ষ্যে লিখেছিলাম এই ছড়াটা। শিরোনাম- ‘প্রবাসী এক দুখিনী মায়ের প্রার্থনা’।
পড়া শুরু করলাম। ক্যামেরা টু শট থেকে স্লো মোশনে জুম ইন করতে করতে ক্লোজ শটে আমার ওপর এসে স্থির হয়েছে। ঠিক ঠাক ভালোভাবেই চলছিল সবকিছু। ছড়াটা শেষ হতে আর পাঁচ ছয় লাইন বাকি। এমন সময় হঠাৎ চিৎকার করে উঠলেন লায়লা বানু- এটা হতে পারে না… এই ছড়া যাবে না। ইম্পসিবল। এটা হতে পারে না…।
হতভম্ব আমি ছড়াপাঠ থামিয়ে লায়লা বানুকে বললাম- এখানে কি ভেটিং-এ পড়ার মতো কিছু আছে? যা অন এয়ারে যেতে সমস্যা হবে? খুব কঠিন করে বলেছি? আরও মাইল্ড হওয়া উচিত?
ইতোমধ্যে মিলু ভাই রেকর্ডিং থামিয়ে দিয়েছেন। ক্যামেরার লাল বাতি নিভিয়ে ফেলেছেন তিনি। পুরো স্টুডিও জুড়ে অদ্ভুত থমথমে একটা পরিবেশ।
লায়লা বানু বললেন, সরি আমি এটা নিতে পারছি না ভাই! রিটন ভাই আমি তোমার ছড়ার ভেতরে এমনভাবেই ঢুকে পড়েছিলাম যে হঠাৎ আমার মনে হয়েছে- আমার ছেলেও কি তাহলে আমার সঙ্গে এমনটাই করবে!! আর এটা মনে হওয়াতেই কী যে হলো আমার! অজান্তেই আমি ওরকম চিৎকার করে ফেলেছি। আমার উচিৎ হয়নি এমনটা করা। আমি খুব দুঃখিত রিটন ভাই তোমার কাছে। তুমি প্লিজ আরেকবার পড়ো। পুরোটাই পড়বে। এই ছড়াটা অন এয়ারে যেতেই হবে। (লায়লা বানুর চোখে চিকচিক করছে অশ্রু কণা।)
অতঃপর এডিটিং পয়েন্ট পরিকল্পনা করে ফের নতুনভাবে ছড়াটার পাঠ শুরু হলো। আমি বললাম, আমার ছড়ার শিরোনাম- ‘প্রবাসী এক দুখিনী মায়ের প্রার্থনা’।
ফেসবুক পাঠকদের জন্যে ছড়াটা এখানে উদ্ধৃত করছি-
[প্রবাসী এক দুখিনী মায়ের প্রার্থনা
লুৎফর রহমান রিটন
পুত্রের সূত্রেই আগমন বিদেশে
মা বলিতে অজ্ঞান বড় সাদাসিধে সে।
ভালো ছেলে গুডবয় ছোট তার পরিবার
জন্মদাত্রী মা-কে কিছু সেবা করিবার–
মানসেই নিয়ে এলো ভিনদেশে মাকে সে,
(পারে না সময় দিতে খুব বিজি থাকে সে।)
বাড়ি গাড়ি সবই আছে নেই শুধু শান্তি,
জীবন এমন হবে খোকা তুই জানতি?
আমার পুত্রটার আজ খুবই বাজে হাল
বউ তাকে প্রতিদিনই করে কী যে নাজেহাল!
আছি আমি মহাসুখে নেই কোনো ঝামলাই
গোটা এই সংসার আমি একা সামলাই।
আছে দুটি ফুটফুটে নাতি আর নাতিনী
ওদের সঙ্গে কভু আনন্দে মাতি নি।
গ্র্যাণ্ডমম হাই বাই- এর বেশি কথা নেই
আদরের শাসনের নেই স্বাধীনতা নেই।
আমার সময় কাটে দিনরাত রান্নায়
কলজেটা পুড়ে যায় বুকফাটা কান্নায়…
দেখেও দেখে না ছেলে, বউটার শাসানি
পুত্রবধুটা ভারি নির্দয়, পাষাণী।
আমাকে একলা রেখে ওরা যায় বেড়াতে
কতো যে কায়দা করে বুড়িটাকে ফেরাতে…
ঘরদোর ঝকঝকে তকতকে রাখা চাই,
বাড়িতে অতিথি এলে ফিটফাট থাকা চাই,
অতিথিরা বিগলিত ফিন্নি ও পায়েসে–
‘ভালোই তো হলো ভাই তোর বুড়ো মা এসে!
দুনিয়ার সেরা সব খাওয়াগুলো খাচ্ছিস
তুই কি ভাগ্যবান মাকে কাছে পাচ্ছিস!’
পুত্রবধুটা বলে– ‘মা তো রোজ রাঁধে না।’
সে কথায় সায় দিতে পুত্রেরও বাঁধে না।
ঘুর্ণিতে পড়ে গেছি আমি মরু সাহারায়
ওরা যায় পার্টিতে আমি বাড়ি পাহারায়…
আমার মূল্য নেই সংসারে দু’আনা
কখনো বুঝবে ওরা? মা মানে বুয়া না!
ভুলে যায় সন্তান অতীতের স্মৃতিকে!
ভুলে যায় জন্মের ঋণ-স্নেহ-প্রীতিকে!
দশ মাস দশ দিন তিলে তিলে গর্ভে–
েেবড়ে উঠেছিলো ওরা সূচনার পর্বে!
(পরবাসে বন্দিনী জননীরা কেঁদো না।
বুকের গহীনে রাখো অকথিত বেদনা।
খোদার আরশ কাঁপে যদি কাঁদে মায়েরা,
শেষ বিচারের দিনে ক্ষমা পায় না এরা।)
পুত্র-কন্যা তোরা বড় হতি? মা ছাড়া?
মা দিবসে প্রার্থনা- সুখে থাক বাছারা।
রচনাকাল/ অটোয়া ১২ মে ২০০৭
প্রকাশকাল/ দৈনিক জনকণ্ঠ, ১৩ মে ২০০৭]
রেকর্ডিং শেষে আমরা পা বাড়ালাম পার্ক করা গাড়ির দিকে। আমাদের সঙ্গে এলেন লায়লা ভাবী। আমরা কেউই কোনো কথা বলছি না। আমাদের গাড়ি স্টার্ট নিলো। ভাবীর কাছ থেকে বিদায় নিতে উইন্ডো গলিয়ে মাথা বের করলাম। হাত তুলে তাঁকে বাই জানালাম। তিনিও বাই জানালেন। দেখলাম, পায়ে পায়ে তিনি সদর দরোজায় এসে দাঁড়িয়েছেন। আমাদের গাড়ি চলতে শুরু করেছে। সাইড মিররে ভাবীর পূর্ণ অবয়ব দেখা যাচ্ছে। যতোক্ষণ আমাদের গাড়িটাকে দেখা যায় তিনি দাঁড়িয়েই থাকলেন! দাঁড়িয়েই থাকলেন। আহারে!
০৪
উত্তর আমেরিকার এক জুনিয়র বন্ধুর বাড়িতে প্রায়ই যাওয়া হয় আমার। ওর বাড়িতে আমার যাওয়া উপলক্ষ্যে ওর একঝাঁক বন্ধুর আগমন ঘটে প্রতিবারই। যারা আমারও খুব কাছের। একবার গিয়ে শুনি ওর বাবা মা এসেছেন দেশ থেকে, পাকাপাকিভাবে ওদের সঙ্গে থাকবেন বলে। আমাদের জমাট আড্ডার একপর্যায়ে ওর বাবা এবং মা নতুন জামা কাপড় পরে নেমে এলেন ওপর তলা থেকে। তারপর হাসিহাসি মুখ করে বসে থাকলেন দীর্ঘ সময় ধরে। কিছুক্ষণ আমি ওঁদের সঙ্গে প্রচুর কথা বললাম। খুব খুশি ছিলেন তাঁরা আমার সঙ্গে কথা বলার সময়। কিন্তু লক্ষ্য করলাম পার্টিতে আসা অন্যেরা ব্যস্ত নিজেদের নিয়েই। কেউ কথা বলছেন না সেই প্রবীণ প্রবীণার সঙ্গে। ছেলের বন্ধুরা অতিথিরা ওয়াইন বিয়ার হুইস্কি পান করছে দেদারসে। আর সেই প্রবীণ প্রবীণা হাসি হাসি মুখ করে পার্টিতে বসে আছেন।
(পরে জেনেছি পুত্র এবং পুত্রবধুর প্রতিটা পার্টিতেই মা বাবাকে ওরকম সাজুগুজু করে হাসিমুখে বসে থাকতে হয়। আহারে! এও এক কঠিন যাতনা।)
০৫
লেখার সমাপ্তিতে এসে প্রবাসে বসবাস করা আমাদের সন্তানদের উদ্দেশ্যে কয়েকটা আর্জি পেশ করতে চাই।-
হে আমাদের অপরূপ সুন্দর সন্তানেরা,
তোমরা তোমাদের মা বাবাকে তাঁদের শেকড় থেকে উপড়ে এনে ভিনদেশে ভিন্ন সংস্কৃতিকে মেনে নিতে বাধ্য করো না। তাঁদের পছন্দের বাংলা গান বাংলা নাটক বাংলা চলচ্চিত্র দেখতে দিও তাঁদের। লেডি গাগা কিংবা জাস্টিন বিবারকে নিয়ে থাকো তোমরা। কিন্তু তাঁদের থাকতে দাও আব্বাসউদ্দিন আবদুল আলীম শচীনকত্তা আর বেগম আখতারকে নিয়ে।
তোমরা তোমাদের মা বাবাকে স্বজনহীন বন্ধুহীন সঙ্গীহীন নিঃসঙ্গ একলা জীবন যাপনে বাধ্য হতে জবরদস্তি করো না। ‘তোমাদের বন্ধুরাই তাঁদের বন্ধু’ এই ভয়ংকর থিয়োরি বা ফর্মূলা জারি করো না। তাঁদের জন্যে তাঁদের বয়েসী মানুষদের সান্নিধ্য পাবার ব্যবস্থা রেখো।
তোমরা তোমাদের মা বাবাকে তাঁদের খাদ্য সংস্কৃতি থেকেও উপড়ে ফেলো না।
পিৎজা, বার্গার, বেগেল, লাজানিয়া বা সিরিয়াল খেতে চাপ দিও না। তাঁদের চিরকালের পছন্দের ভাত, ভর্তা, ভাজি, ছোট মাছ, আটার রুটি পরোটা খেতে দিও।
একটা জীবন ধরে রান্না করে করে ক্লান্ত তোমাদের মা বাবা। মাঝে মধ্যে রেস্টুরেন্টে খেতে নিয়ে যেও তাঁদের। আমেরিকান-কানাডিয়ান কিংবা অন্য দেশের অচেনা খাবার তাঁদের পছন্দ কিনা সেটা আগে জেনে নিও। শুসি কিংবা স্টেক পছন্দ কিনা জেনে নিও আগে। কিন্তু খবরদার হাফডান স্টেক অর্ডার করে বসো না যেনো! কাঁচা বিফ যাতে চাপ পড়লেই রক্ত বেরোয়, এমন স্টেক খেতে পছন্দ নাও করতে পারেন তাঁরা। তাঁদের জন্যে ওয়েলডান স্টেকই অর্ডার করো।
আড়াই কলম ইংরেজি জানা তোমরা তাঁদের ইংরেজি উচ্চারণে ত্রুটি আবিষ্কার করে লজ্জিত হয়ো না। তাঁদের ভৎসর্না করার বাহাদুরীও দেখিও না। তাঁরা তোমার নতুন দেশে ইংরেজিতে দিগগজ হতে আসেন নাই। ভুলে যেও না তোমাকে ইংরেজি শিক্ষায় শিক্ষিত করতে তাঁরা তাঁদের সমস্ত সম্পদ সমস্ত শক্তি ব্যয় করেছেন। জীবনের এই পড়ন্ত বেলায় নতুন করে ইংরেজি না শিখলে কোনো ঘোড়ার ডিমের কিছুই আসবে যাবে না।
তোমরা তোমাদের প্রাসাদোপম বাড়িটাকে বন্দিশালা বা কারাগার না বানিয়ে তাঁদের জন্যে একটা কমফোর্ট জোনের নিশ্চিত ব্যবস্থাও রেখো। যেখানে তাঁরা প্রাণ ভরে নিশ্বাস নিতে পারবেন।
ফেসবুক স্ট্যাটাসে বা কমেন্টে তাঁদের বানান ভুল হলে ঝাঁপিয়ে পড়ো না তাঁদের ওপর। তাঁদের জীবনটা তাঁদের মতোন করে যাপন করতে দাও। কয়েকটা বানান ভুল হলে জীবনটা ধ্বংস হয়ে যাবে না। কয়েকটা ভাষায় তুমি পণ্ডিত হও ক্ষতি নেই। কিন্তু তাই বলে তোমাদের বাবা মাকেও পণ্ডিত হতে হবে এমন কোনো কথা নেই।
অনাবশ্যক যাতনা দিও না তাঁদের। তোমাদের ভয়ে যেনো সারাক্ষণ তটস্থ না থাকে এই প্রবীণ প্রবীণারা। পারলে তাঁদের জীবনটাকে আনন্দে ভরপুর টইটম্বুর করে রেখো। কতো অল্পে তাঁরা খুশি হন খেয়াল করেছো?
হে আমাদের অপরূপ সুন্দর সন্তানেরা,
মনে রেখো কিছু ব্যতিক্রম বাদে স্নেহ নিম্নগামী প্রকৃতিগতভাবেই। তোমাদের বাবা মায়েরা এমনিতেই তোমাদের সন্তানকে বুক দিয়ে আগলে রাখবেন। ভালোবাসবেন। তাঁদের দাদা-দাদী নানা-নানী দিদা-দিদু বা গ্র্যাণ্ডমম আর গ্যান্ডপা পরিচয়টাকেই বহাল রেখো। বেবীসিটার বানিয়ে ফেলো না তাঁদের।
একগাদা রান্নার দায় চাপিয়ে মাকে গৃহসহায়তাকারী বানিয়ে ফেলো না।
তোমরা তোমাদের মা বাবাকে গৃহবন্দী না রেখে মাঝেমধ্যে বেড়াতে নিয়ে যেও। এমন জায়গায় নিয়ে যেও যেখানে গেলে তাঁদের আনন্দ হবে। শুধু গ্রোসারিতে সঙ্গে নিয়েই মনে করো না বেড়ানো হয়ে গেছে। পারলে তাঁদের দুজনকে কোনো ক্রুজ কিংবা অন্য কোনো প্যাকেজ ট্যুরে পাঠিয়ে দাও। কয়েকটা দিন নিজের মতো করে মুক্ত আনন্দে কাটিয়ে আসুক তাঁরা। মনে রেখো তাঁদেরও আলাদা স্পেস দরকার হয়, হতে পারে।
কথাবার্তায় সচেতন থেকো। চটাং চটাং নিষ্ঠুর কথা বলে মন ভেঙে দিও না তাঁদের। এমন কিছু বলে ফেলো না তাঁদের যাতে করে জীবনটা ব্যর্থ কিংবা অনাবশ্যক কিংবা বাড়তি বোঝা মনে হয় তাঁদের কাছে।
তোমার বাবা কিংবা মা হয়তো মান্থলি মাত্র দশ বা কুড়ি হাজার টাকা স্যালারি পেতেন। আর তুমি পাঁচ কিংবা দশ হাজার ডলার পাও প্রতি মাসে। এইটা নিয়ে দম্ভ দেখিও না। মনে রেখো তাঁদের ওই দশ বা কুড়ি হাজার টাকাতেই তোমার শারীরিক পুষ্টি আর মগজের উর্বরতা বিন্যস্ত হয়েছে।
তাঁরা যে আয় রোজগারহীন সেটা মাথায় রেখো। তোমাদের কাছে চাইতে হবে কেনো? অনেক সময় খুব দরকার হলেও সন্তানের কাছে টাকা চাইতে সংকোচ হতে পারে তাঁদের। তাঁদের মাসিক হাত খরচের যোগানটা নিশ্চিত রেখো। সম্ভব হলে তাঁদের একটা ব্যাংক একাউন্ট করে দিও। প্রতি মাসে নির্দিষ্ট একটা এমাউন্ট অটো সিস্টেমেই যেনো জমা হয়ে যায় তাঁদের একাউন্টে। টুকটাক কেনাকাটার জন্যে এমন কি চা কফি কিংবা সিগারেটের টাকাটা যেনো হাতে থাকে তাঁদের।
তাঁরা কারও সঙ্গে যোগাযোগ করতে চাইলে বা কথা বলতে চাইলে কিংবা তাঁদের সঙ্গে কেউ যোগাযোগ করতে চাইলে বা কথা বলতে চাইলে ভায়া পুত্র বা পুত্রবধু কিংবা ভায়া কন্যা বা কন্যাজামাতার মাধ্যমে যেনো কথা বলতে না হয়। ফ্যামিলি প্যাকেজ কিংবা খুব অল্প টাকার প্যাকেজে খুব কম দামি হলেও দুটো সেলফোন কিনে দিও তাঁদের।
তাঁদের বিশাল পৃথিবীটা এমনিতেই তোমাদের কারণে সীমাবদ্ধ জল আর সীমিত সবুজে রূপান্তরিত হয়ে গেছে। কোটি টাকার বাড়িতে লক্ষ টাকার বর্ণিল ঝলমলে এক্যুরিয়ামে আটকে ফেলো না তাঁদের। বাবা মায়েরা তোমাদের নির্মিত এক্যুরিয়ামের কাচের দেয়ালে মাথা ঠুকবেন বলে সবকিছু ছেড়েছুঁড়ে ভিনদেশে আসেননি। তাঁরা এসেছিলেন জীবনের শেষ বেলাটা তোমাদের সঙ্গে নাতি নাতনীদের সঙ্গে আনন্দ হুল্লোড়ে কাটিয়ে দেবেন বলে। তোমাদের দাস হতে নয়।
কথায় কথায় তাঁদের তোমরা সেকেলে বলে উড়িয়ে দিও না। তোমরা নিউ জেনারেশন। অতি স্মার্ট অতি আধুনিক। কিন্তু তাঁরাও তাঁদের সময়ে স্মার্ট আর আধুনিকই ছিলেন।
বাবা মায়ের জীবনের স্টিয়ারিংটা সাবধানে হ্যান্ডল করো। তাঁরা বিএমডব্লিউ গাড়ি নয় যে পুরো কন্ট্রোলে রাখতে হবে। তোমরা তাঁদের মুক্ত রেখো। মরণের আগেই যেনো প্রত্যহ বারবার মরে যেতে না হয় তাঁদের।
গ্লানির জীবন নয় হ্যাপিনেস উপহার দাও। একসঙ্গে থাকাটাকে স্বর্গীয় সৌরভে ভরিয়ে তুলো। মনে রেখো শেষ বয়েসে বাবা মায়েরা একেকটা শিশু হয়ে যান।
হে আমাদের অপরূপ সুন্দর সন্তানেরা,
তোমাদের প্রাসাদোপম বাড়িতে অঢেল সুখ সম্পদের আড়ালে যদি প্রবাসী বাবা মায়ের দীর্ঘশ্বাস কিংবা হাহাকার কিংবা সামান্যতম গোপন অশ্রুও লুকিয়ে থাকে তবে সেটা খুব অসুন্দর একটা উদাহরণ হবে।
এমনটা হলে আয়নার সামনে কী করে দাঁড়াবে তুমি বন্ধু?
তোমাদের সঙ্গে বাবা মায়ের শেষ বেলাটা যেনো অপমানের না হয়, অসম্মানের না হয়।
মনে রেখো, তুমিও একদিন বৃদ্ধ হবে…।
লেখক : ছড়াকার ও প্রাবন্ধিক