হোয়াইট হাউজে বাইডেনের দু’বছর

বাহারুল আলম :

গত ২১ জানুয়ারি মার্কিন প্রেসিডেন্ট হিসাবে জো বাইডেনের চার বছর মেয়াদের প্রথম দু’বছর অতিক্রান্ত হয়েছে। ২০২১ সালের ২০ জানুয়ারি তিনি ৪৬তম প্রেসিডেন্ট হিসাবে দায়িত্বগ্রহণ করেন। এ উপলক্ষে হোয়াইট হাউজে আয়োজিত এক অনুষ্ঠানে তিনি বলেন- ‘On January 20th, 2021, I placed my hand on my family Bible and gave my word as a Biden that I would serve you thinking not of power, but of possibilities. Two years later, millions of new jobs, countless investments, I am proud to have kept my word.’

অনুষ্ঠানে উপস্থিত ভাইস প্রেসিডেন্ট কমলা হ্যারিস (যাকে তিনি ভুল কওে কেমালা হ্যারিস বলে উল্লেখ করেন) এবং হোয়াইট হাউজের কর্মকর্তা-কর্মচারিরা করতালি দিয়ে তাকে অভিনন্দিত করেন।

বিগত দু’বছর প্রেসিডেন্ট বাইডেনকে মরণঘাতী কোভিড-১৯ এবং ইউক্রেন যুদ্ধের কারণে বিপর্যস্ত পৃথিবীতে নানা চ্যালেঞ্জ মোকাবেলা করে অনেক হিসাব কষে এগুতে হয়, যেটা যে কোনো রাষ্ট্রনায়কের জন্যই অত্যন্ত কষ্টসাধ্য ও কঠিন ব্যাপার। ইে দুরূহ পরিস্থিতি মোকাবেলায় বাইডেন যেমন বহু ক্ষেত্রে অভাবনীয় সাফল্য দেখাতে সক্ষম হয়েছেন, তেমনি কিছু কিছু ক্ষেত্রে আশানুরূপ সফলতা অর্জনে সমর্থ হননি।

ধারণা করা হচ্ছে, আগামী ৭ ফেব্রুয়ারি নতুন কংগ্রেসে স্টেট অব দ্য ইউনিয়ন (State of the Union) ভাষণের পর বাইডেন ২০২৪ সালে অনুষ্ঠিতব্য প্রেসিডেন্ট নির্বাচনে দ্বিতীয় মেয়াদে নিজের প্রতিদ্বন্দ্বিতার ঘোষণা দেবেন। যদিও এ সম্পর্কিত সিদ্ধান্তটি ছুটির দিনগুলোর (বড়দিন ও নববর্ষ) শেষে জানাবেন বলে পূর্বে বলা হয়েছিল। নানা কারণে সেটা হয়নি। এর মধ্যে মিডটার্ম ইলেকশন হয়েছে। এই নির্বাচনে বহু মহল থেকে তার দলের অত্যন্ত বাজেভাবে পরাজয়ের ইঙ্গিত দেয়া হয়। কিন্তু সবাইকে অবাক করে দিয়ে তার নেতৃত্বে ডেমোক্র্যাটিক পার্টি কংগ্রেসের সিনেটে শুধু সংখ্যাগরিষ্ঠতাই পায়নি, বেশ কয়েকটি গভর্নর পদসহ অন্যান্য পদের নির্বাচনে চমকপ্রদ সাফল্য দেখাতে সক্ষম হয়েছে। ট্রাম্প সমর্থিত বহু প্রার্থীকে ধরাশায়ী করে তার প্রার্থীরা রীতিমতো তাক লাগিয়ে দিয়েছেন। কংগ্রেসের প্রতিটি পরিষদে তার দলের হার হলেও, সেই হারের ব্যবধান খুবই ছোট (Razor Thin)। নির্বাচনে এহেন সাফল্যের পর দলের যেসব নেতা তার নেতৃত্ব সম্পর্কে সন্দিহান ছিলেন, তারা তাদের মত বদলাতে বাধ্য হন।

বিভিন্ন জনমত জরিপে তার গ্রহণযোগ্যতার হার কম থাকা এবং অধিক বয়সের কারণে তাদের অনেকে তাকে দ্বিতীয় মেয়াদে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করা থেকে বিরত থাকার পরামর্শ দেন।

প্রসঙ্গত উল্লেখ করা যেতে পারে, রোনাল্ড রেগান যখন প্রেসিডেন্ট হন, তখন তার বয়স ছিল ৭০ বছর। দ্বিতীয় মেয়াদ শেষে রেগানের বয়স বাইডেনের প্রথম মেয়াদের বয়স থেকে বছর কম ছিল। যে কারণে বাইডেন দ্বিতীয় মেয়াদে নির্বাচিত হলে তিনি হবেন মার্কিন ইতিহাসের সবচাইতে বয়োজ্যেষ্ঠ প্রেসিডেন্ট।

কোভিড এবং ইউক্রেন যুদ্ধের কারণে সৃষ্ট বিশ্ব মন্দাজনিত প্রতিকূল পরিস্থিতি সামাল দিয়ে বাইডেন যেভাবে দেশকে সম্ভাব্য বিপর্যয় থেকে রক্ষার ব্যবস্থা নিয়েছেন, তা বহু মহলের সপ্রশংস দৃষ্টি আকর্ষণে সক্ষম হয়েছে। যে কারণে তার নেতৃত্ব সম্পর্কে সন্দিহান দলীয় বহু নেতা বর্তমানে তার পেছনে ঐক্যবদ্ধভাবে দাঁড়িয়েছেন বলে প্রতীয়মান হয়।

এ কারণে নতুন প্রত্যয়ে উজ্জীবিত বাইডেন ২০২৪ সালে নির্বাচনে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করবেন, তা অনেকটাই নিশ্চিত করে বলা যায়। বাইডেনেরে সম্ভাব্য প্রতিদ্বন্দ্বী হিসাবে যাদের নাম শোনা যাচ্ছে, যেমন, ক্যালিফোর্নিয়ার গভর্নর গেভিন নিউসম, জর্জিয়ার ফায়ার ব্রান্ড ডেমোক্র্যাটিক নেতা স্ট্যাসি আব্রামস্ এবং পরিবহণ মন্ত্রী পিটার বুটিজাজ। তারা নানা কারণে প্রাইমারিতে বাইডেনের সঙ্গে পেরে উঠবেন বলে মনে হয় না।

বাইডেন শাসনে কোভিডে কমবেশি ৬০ লক্ষ মার্কিনীর মৃত্যু হলেও, এই রোগ/ভাইরাস প্রতিরোধে কোটি কোটি ভ্যাকসিন বিতরণে সাফল্যের কারণে বর্তমানে কোভিড পরিস্থিতি অনেকটাই সহনীয় পর্যায়ে চলে এসেছে। যাকে বাইডেনের একটি সাফল্য বলে মনে করা হয়। দেশের দীর্ঘদিনের অবহেলিত ও মেরামতের অপেক্ষায় থাকা অবকাঠামো উন্নয়নে ১.২ ট্রিলিয়ন ডলারের বিনিয়োগ বিল পাসে তিনি চমৎকার দক্ষতা দেখিয়েছেন। এই বিল পাসে তিনি উভয় দলের সমর্থন আদায়ে সক্ষম হয়েছেন। তার দক্ষ দূতিয়ালির ফলশ্রুতিতে এই বিলের পক্ষে সব ডেমোক্র্যাট ও নির্দলীয় সিনেটর ছাড়াও ১৯জন রিপাবলিকান সিনেটর সমর্থন দেন। বাই পার্টিজান ভিত্তিতে এতো বড় অংকের একটি বিলে উভয় দলের এহেন সমর্থন আদায়ের ঘটনা নিঃসন্দেহে বাইডেনের একটি বড় সাফল্য।

সাম্প্রতিককালে অপর একটি ট্রিলিয়ন ডলারের ব্যয় নির্বাহ (Spending Bill) বিল পাসের ক্ষেত্রেও একই কথা প্রযোজ্য। এই বিল স্বাক্ষর-পরবর্তী সময়ে কেন্টাকিতে একটি অবকাঠামো উন্নয়ন প্রকল্প উদ্বোধনের সময় বাইডেনের সঙ্গে একই মঞ্চে রিপবলিকান নেতা মিচ ম্যাককনেলের উপস্থিতি বাইডেনের সাফল্যকে নতুন মাত্রা এনে দেয়। এ ধরনের প্রচেষ্টা অব্যাহত রাখা গেলে ভবিষ্যতে আরো অনেক অগ্রগতি সাধন করা সম্ভব হবে বলে অনেকে মনে করেন।

তাছাড়া বিগত দু’বছর সময়ে কর্মসংস্থানের ক্ষেত্রে ব্যাপক সাফল্য অর্জিত হতে লক্ষ্য করা যায়। এ সময়ে প্রায় ১১ মিলিয়ন নতুন কর্মসংস্থান অর্থনীতিতে যোগ হয় বলে প্রকাশিত তথ্যে জানা যায়। বর্তমানে বেকারত্বের হার ৩.৫ শতাংশ, যা বহুযুগের মধ্যে সর্বনিম্ন। চাকরি বাজারের এহেন শক্তিশালী অবস্থার কারণে সম্ভাব্য মন্দার আশঙ্কা অনেকাংশে হ্রাস পেয়েছে বলা যায়।

গান কন্ট্রোল, জলবায়ু পরিবর্তন তথা কার্বন নির্গমন কমিয়ে আনতে বাইডেনের নানা পদক্ষেপ, সুপ্রিম কোর্টে প্রথম একজন কৃষ্ণাঙ্গ মহিলা বিচারপতি নিয়োগসহ সমাজে সমতা (equity) সৃষ্টির লক্ষ্যে গৃহীত বিভিন্ন পদক্ষেপ, আইসিস নেতা হাজি আবদুল্লাহ ওরফে আবু ইব্রাহিম আল হাশেমি আল কুরাইশি ও আরমান আল জাওয়াহিরি হত্যা বাইডেনের উল্লেখযোগ্য সাফল্যের কয়েকটি উদারহণ। উপর বর্ণিত সাফল্যের বিপরীতে দু-একটি নেতিবাচক অবস্থা ও ঘটনাপ্রবাহ বাইডেনের ভাবমূর্তিকে কিছুটা হলেও ক্ষতিগ্রস্থ করেছে। রেকর্ড মুদ্রাস্ফীতির কারণে দ্রব্যমূল্যের বৃদ্ধি, মেক্সিকো সীমান্ত দিয়ে প্রতিদিন শতশত বিদেশি নাগরিকের অনেকটা অবাধে-অবৈধভাবে যুক্তরাষ্ট্রে প্রবেশের ঘটনা এবং ক্রমবর্ধমান অপরাধ প্রবণতা, মাদকাশক্তি ও হোমলেস ক্রাইসিস মোকাবেলায় বাইডেনের তৎপরতা অনেকের কাছে নিতান্ত অপ্রতুল মনে হয়েছে।

এছাড়া, সম্প্রতি বাইডেনের ডেলাওয়ারের বাড়ি, গ্যারেজ ও আরো দু-একটি স্থানে রাষ্ট্রীয় গোপন ও সংবেদনশীল (Classified sensitive documents) কিছু নথিপত্র পাওয়ার ঘটনা মার্কিন রাজনৈতিক অঙ্গণে ব্যাপক চ্যাঞ্চল্য ও বিরূপ প্রতিক্রিয়ার জন্ম দিয়েছে।

জাতীয় নিরাপত্তার প্রশ্ন জড়িত থাকায় এ ঘটনাকে অনেকে বাইডেনের চরম দায়িত্বহীন অবহেলা (Gross negligence) বলে বর্ণনা করেছেন। গোপনীয় নথিপত্র রক্ষণাবেক্ষণে তার ব্যর্থতা (Mishandling) তাকে মর্যাদার আসন থেকে সরিয়ে দিয়েছে বলেও কেউ কেউ মন্তব্য করেন।
তার মতো মর্যাদাবান একজন ব্যক্তির কাছ থেকে এহেন দায়িত্বহীনতা কেউ আশা করেনি। বর্তমানে বাইডেন এবং ট্রাম্পের নথিপত্র কেলেঙ্কারী নিয়ে দু’জন স্পেশাল কাউন্সেল তদন্ত করছেন। তাছাড়া রিপাবলিকান নিয়ন্ত্রিত প্রতিনিধি পরিষদের ওভারসাইট কমিটি বাইডেনের নথিপত্র নিয়ে তদন্ত শুরুর তোড়জোড় করছেন বলে শোনা যাচ্ছে।

এ ধরনের তদন্তের ঘটনা আগামী দু’বছর মিডিয়াসহ সর্বত্র আলোচনা-সমালোচনার বিষয়বস্তু হবে বিধায়, তা বাইডেনের জন্য বিশেষ বিব্রতকর হবে বলে বিদগ্ধ মহল মনে করেন।

লেখক : কলামিস্ট।