মফিজুল হুসেন নিজাম :
বাংলাদেশে আগামী ১০ ডিসেম্বরের আলোচনা ১১০ ডিগ্রিতে পৌঁছেছে। আড্ডায়, টিভির পর্দায়, ফেসবুকে, ইউটিউবে এমনকি রাষ্ট্রের সর্বোচ্চ পর্যায়ে এ নিয়ে আলোচনা চলছে। সেদিন কী কী ঘটতে পারে, তার একটি বিশ্লেষণ করা যাক। সম্ভবত সেদিনের খেলোয়াড় হবে তিন পক্ষ : ১. সরকার বা আওয়ামী লীগ, ২. বিএনপি ও ৩. পুলিশ।
১. সরকার বা আওয়ামী লীগ : বর্তমানে আওয়ামী লীগ সরকার আন্তর্জাতিক, অর্থনৈতিক ও রাজনৈতিকভাবে খুব দৈন্যের মধ্য দিয়ে যাচ্ছে। তাদের সবচেয়ে খুব কাছের মিত্র ভারতসহ সকল পশ্চিমা দেশ প্রচণ্ড চাপে রেখেছে, যাতে আগামী নির্বাচন নিরপেক্ষ হয়। কিন্তু একটি নিরপেক্ষ নির্বাচন হওয়া মানে আওয়ামী লীগের কবর রচনা করা, যা বর্তমান প্রধানমন্ত্রী হতে দিতে পারেন না। তিনি চাইবেন ২০১৪ ও ’১৮ সালের মতো যে করেই হোক ক্ষমতা ধরে রাখতে।
২০১৩ সালে তত্ত্বাবধায়ক সরকার রহিতকরণ আইন পাস করার পর বর্তমান প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা কেবল ঐতিহ্যবাহী আওয়ামী লীগের প্রধানমন্ত্রী রইলেন না; তিনি হয়ে উঠলেন সকল জবাবদিহির ঊর্ধ্বে আমলা, পুলিশ এবং কিছু অনুগত সামরিক অফিসার নির্ভরপুষ্ট কর্তৃত্ববাদী প্রধানমন্ত্রী। তার দফতর হয়ে গেল অর্থ ও পরিকল্পনা মন্ত্রণালয়ের বিকল্প। দেশের আয়-ব্যয় বা অর্থনীতির মাইক্রো ও ম্যাক্রো ম্যানেজমেন্ট উপেক্ষা করে বিদেশি ঋণ নিয়ে কোনো কোনো ক্ষেত্রে বাজারদরের চেয়ে দু-তিন গুণ বেশি খরচে বিশাল বিশাল প্রকল্প নিয়ে দেশের অর্থনীতি ধ্বংসের দ্বারপ্রান্তে নিয়ে এখন দুর্ভিক্ষের আওয়াজ দিচ্ছেন। আওয়ামী লীগের অতি কাছের একজন অর্থনীতিবিদ আবুল বারাকাত, যাকে প্রধানমন্ত্রী জনতা ব্যাংকের চেয়ারম্যান বানিয়েছিলেন, সম্প্রতি এক সেমিনারে বলেছেন, ‘আগামী দু-তিন বছরের মধ্যে যখন আমাদের ঋণ পরিশোধ করা শুরু হবে, তখন আমরা টাকা ছাপিয়ে ঋণ শোধ করতে পারব না। তখন আমরা শুধু বলতে পারব আমরা ভুল করেছিলাম।’ আর এই ভুলের সঙ্গে যোগ হয়েছে দেশ থেকে কয়েক লক্ষ কোটি টাকা পাচার এবং বিদ্যুৎসহ মোটামুটি সব খাতে সীমাহীন দুর্নীতি।
রাজনৈতিকভাবেও আওয়ামী লীগ মোটামুটি একা বললেই চলে। ওয়ানম্যান-সর্বস্ব হাসানুল হক ইনু ছাড়া তাদের পাশে কেউ নেই। তাদের মিত্র, দেশের তৃতীয় বৃহত্তম জাতীয় পার্টির চেয়ারম্যান জি এম কাদের বিএনপির চেয়ে তীব্র ভাষায় সরকারকে আক্রমণ করার পর সরকারের অদৃশ্য হাত ২০১৪ সালে এরশাদের মতো রওশন কার্ড ব্যবহার করে জি এম কাদেরকে আওয়ামী খাঁচায় ধরে রাখতে চাইছে। সুতরাং মিত্রহীন, ভঙ্গুর অর্থনীতি এবং আন্তর্জাতিকভাবে চাপে থাকা আওয়ামী লীগ অন্তত ১০ ডিসেম্বর কোনো সংঘাতে যেতে চাইবে না।
২. বিএনপি : রুগ্্ণদশা থেকে হঠাৎ করে সুস্থ হয়ে অভাবনীয়ভাবে ঘুরে দাঁড়িয়েছে বিএনপি। কার্টুনিস্টরা যথার্থই কৌতুক করে বলেন, আমেরিকায় তৈরি স্যাংশনের (নিষেধাজ্ঞা) ক্যাপসুল খেল আওয়ামী লীগ আর সুস্থ হয়ে গেল বিএনপি। সত্যিকার অর্থেই আমেরিকার এলিট ফোর্স র্যাব ও পুলিশ কর্মকর্তাদের বিরুদ্ধে নিষেধাজ্ঞা আসার পর পরই আওয়ামী লীগ ব্যাকফুটে চলে যায় আর বিএনপি লাখ লাখ হামলা-মামলা উপেক্ষা করে আত্মবিশ্বাসী হয়ে উঠে ভাবছে, আর যা-ই হোক গুম আর খুন করতে পারবে না। তা ছাড়া তাদের আট-নয়টি বিভাগীয় মহাসমাবেশে সরকারের শত বাধাবিপত্তি উপেক্ষা করে লাখো জনতার উপস্থিতি তাদেরকে আরো আগ্রাসী করে তুলেছে। এখন ১০ ডিসেম্বরের সমাবেশে কী ঘটতে পারে, তা নিয়ে নেতৃত্বের মধ্যে নানা আশঙ্কা বিরাজ করছে। দলটির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান ও মহাসচিব আপাতত সহিংসতায় যাওয়ার পক্ষে নন। তারা সরকারকে তার মেয়াদ পর্যন্ত অর্থাৎ আরো এক বছর সময় দিতে চান, যাতে সরকার একটা শান্তিপূর্ণ সমাধানে আসে। সম্প্রতি জার্মানির খালেদ মহিউদ্দিনের সঙ্গে এক সাক্ষাৎকারে বিএনপির মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর সেদিকেই ইঙ্গিত দিয়েছেন। কিন্তু সমস্যা হলো ভুক্তভোগী ও অত্যাচারিত নেতাকর্মীরা সরকারকে আর এক মুহূর্তও সময় দিতে রাজি নন। তারা যেকোনো ত্যাগ স্বীকারে প্রস্তুত। এ ছাড়া বিএনপির কর্মী এবং জনগণকে দেশের বাইরে থেকে সরকারবিরোধী ইউটিউবাররা উসকানি দিচ্ছেÑযা করার ১০ ডিসেম্বরই করতে হবে অর্থাৎ এই স্বৈরাচারী সরকারকে আর সময় দেওয়া যায় না। সন্দেহ নেই, এখন বিএনপি নেতৃত্ব উভয়সংকটে আছেÑসরকারি দালাল আখ্যা পাওয়া অথবা সরকার পতন আন্দোলনের ডাক দেওয়া। এদিকে ভেন্যু নিয়ে সরকারের সঙ্গে বিএনপির একটা সমঝোতা হওয়ার সম্ভাবনা রয়েছে। সবকিছু মিলিয়ে এটুকু বলা যায়, যেহেতু তারেক রহমান আপাতত সহিংসতার বিপক্ষে, সেহেতু পল্টন কিংবা সোহরাওয়ার্দী উদ্যান নয়; তৃতীয় কোনো স্থানে বিএনপির মহাসমাবেশ শান্তিপূর্ণভাবেই শেষ হবে।
৩. পুলিশ : পুলিশ বিভাগ এ মুহূর্তে রয়েছে অত্যন্ত বিপদে। তারা বর্তমান রাজনৈতিক পরিস্থিতি সম্পর্কে যেমন সচেতন, আবার সরকারি আদেশ অমান্য করাও তাদের পক্ষে খুব কঠিন। বর্তমানে পুলিশের বাড়াবাড়ি নিয়ে আরেকটি আন্তর্জাতিক নিষেধাজ্ঞার আলোচনা খুব জোরেশোরেই উচ্চারিত হচ্ছে। নিরপেক্ষ পুলিশ অফিসাররা হয়তো সরকারবিরোধী আন্দোলনে ‘ধরি মাছ না ছুঁই পানি’র ভূমিকায় থাকবেন কিন্তু সমস্যা হলো ছাত্রলীগ করা কিছু কট্টর পুলিশ সদস্যকে নিয়ে, যাদেরকে বলা হয় ‘পুলিশ লীগ’। তারা যদি বিরোধীদের ওপর মারমুখী ভূমিকায় অবতীর্ণ হন, তাহলে পরিস্থিতি দ্রুত পাল্টে যেতে পারে। সে ক্ষেত্রে হতাহতের ঘটনাও উড়িয়ে দেওয়া যায় না। পরিস্থিতির অবনতি ঘটলে তা সামাল দেওয়া সরকারের জন্য বেশ কষ্টসাধ্য হবে।
দেশের শান্তিকামী মানুষ আশা করে, ১০ ডিসেম্বর বিএনপি ও আওয়ামী লীগ উভয়েই সংযত আচরণ প্রদর্শন করবে। বিশেষ করে, প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা যেভাবে ২০১৩ সালে হেফাজতকে কঠোরভাবে দমন করেছিলেন, বিএনপির ক্ষেত্রে সে ধরনের কোনো সিদ্ধান্তে যাবেন না। আর বর্তমানে খালেদা জিয়া ও তারেক রহমানকে প্রধানমন্ত্রী যেভাবে আক্রমণ করছেন, তা থেকে বিরত থাকবেন।