১০ ডিসেম্বরকে ঘিরে রাজনীতিতে উত্তেজনা : ঢাকার সাত স্পট নিয়ন্ত্রণে নেবে বিএনপি

ফাইল ছবি

নূরুল ইসলাম : ২০০৭ সালের ১১ জানুয়ারি থেকে ক্ষমতার আসনে নেই বিএনপি। তিনটি নির্বাচনের মধ্যে দুটিতে অংশগ্রহণ করেছে, একটি বর্জন করেছে। দুটি নির্বাচনেই বিএনপির ভরাডুবি হয়েছে। বিশেষ করে, বড় পরাজয় হয়েছে ২০১৮ সালে খালেদা জিয়াকে কারাগারে রেখে ড. কামাল হোসেনকে নিয়ে মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর শেখ হাসিনার সঙ্গে আলোচনার টেবিলে বসে নির্বাচনে যাওয়ায়। এবার যেকোনো উপায়ে শেখ হাসিনার নিয়ন্ত্রণমুক্ত নির্বাচন বাস্তবায়ন করাই বিএনপির প্রধান উদ্দেশ্য। যেকোনোভাবে যেন তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনে নির্বাচন হয়, সেই আলোকে চলছে বিএনপির বিভাগীয় সমাবেশ। ৯ বিভাগীয় গণসমাবেশ শেষে বিএনপির মূল টার্গেট ঢাকা। এখান থেকে দেশ-বিদেশে সাংগঠনিক শক্তি জানান দেবে। যত বাধাই আসুক, ঢাকায় স্মরণকালের মহাসমাবেশ বাস্তবায়ন করবে দলটি।
বিভাগীয় সমাবেশগুলোতে ব্যাপক জনস্রোতে ভীষণ উজ্জীবিত বিএনপি। পরিবহন ধর্মঘট, নেতাকর্মীদের ওপর হামলা, পথে পথে নানা বাধার পরও ময়মনসিংহ, চট্টগ্রাম, খুলনা ও রংপুরে সফলভাবে সমাবেশ বাস্তবায়ন করেছে। সমাবেশের সীমানা ছাড়িয়ে জনসমুদ্র দৃশ্য দেখা গেছে। দেশ-বিদেশে বড় খবরের শিরোনাম হয়েছে। আগামী ৫ নভেম্বর বরিশালের গণসমাবেশও সফল হবে বলে দলটি আশাবাদী।
এদিকে এক মাস আগে থেকেই ঢাকা বিভাগীয় মহাসমাবেশে ব্যাপক শোডাউনের প্রস্তুতি নিচ্ছে বিএনপি। সমাবেশ বাস্তবায়নে অতি সম্প্রতি ঢাকা বিভাগীয় নেতাদের নিয়ে বিশেষ বৈঠকও সেরেছে দলটি। কীভাবে সমাবেশ বাস্তবায়িত হবে, সে বিষয়ে হাইকমান্ড ও দলটির বুদ্ধিজীবী থেকে এসেছে নির্দেশনা। সমাবেশ বাস্তবায়নে চৌকস ৫০০ নেতাকর্মীর টিম গঠিত হচ্ছে। মাঠে থাকবে তথ্য প্রদানে ৩৫০টি বিশেষ সোর্স টিম। ঢাকার আশপাশ থেকে লোক প্রবেশে অন্তত ৫০টি নিজস্ব পরিবহন রাখা হবে। নজরদারি করতে নিজস্ব ব্যবস্থাপনায় সিসি ক্যামেরা, ড্রোনও ব্যবহার করবে বলে জানা গেছে। ঢাকায় প্রবেশের মূল সাত স্পট যাত্রাবাড়ী, কেরানীগঞ্জ, আব্দুল্লাহপুর, ৩০০ ফুট সড়ক, আমিনবাজার সেতু, গাবতলী ও সদরঘাট নিজেদের নিয়ন্ত্রণে নেওয়ার পূর্ণ চেষ্টা করবে বিএনপি। এসব স্পট থেকে হামলা হলে নেতাকর্মীদের রক্ষা করতে বিশেষ প্রস্তুতিও নেওয়া হচ্ছে। ১০ ডিসেম্বরের সমাবেশ থেকে বিএনপির বড় কর্মসূচির ঘোষণা থাকবে। তত্ত্বাবধায়ক সরকার নিয়ে আল্টিমেটাম দেওয়া হবে। রোডমার্চ, লংমার্চ, ইসি ঘেরাও, বৃহৎ অবস্থানের মতো কর্মসূচিও ধাপে ধাপে আসবে। এর মধ্যে কোনো একটি কর্মসূচি ১০ ডিসেম্বর ঘোষণা হতে পারে। বিএনপির সিনিয়র নেতা, দায়িত্বশীল ব্যক্তি ও বিরোধী রাজনৈতিক দলগুলোর সূত্রে আভাস পাওয়া গেছে, দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে বিজয়ী হতে সক্ষম হলে বিএনপির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমান ঘোষিত ‘সর্বদলীয় জাতীয় সরকার’ গঠনের প্রতিশ্রুতি দেবে দলটি। ‘জাতীয় সরকার’ গঠন করা সম্ভব হলে কী কী করবে বিএনপি, তাও ১০ ডিসেম্বরের সমাবেশে উপস্থাপন করা হবে।
অন্যদিকে ১০ ডিসেম্বর বিএনপির মহাসমাবেশ নিয়ে সতর্ক আওয়ামী লীগ। মহাসমাবেশের নামে বিএনপি যেন ঢাকায় আগুন-সন্ত্রাসের রাজত্ব কায়েম করতে না পারে, সে জন্য কঠোর অবস্থানে থাকবে ক্ষমতাসীনরা। সতর্ক অবস্থান থাকবে ঢাকায় প্রবেশের গুরুত্বপূর্ণ এলাকাগুলো। বিশেষ করে গাবতলী, আব্দুল্লাহপুর, যাত্রাবাড়ীসহ ঢাকার আশপাশের কয়েকটি গুরুত্বপূর্ণ স্থানকে রাখা হবে বাড়তি নজরদারিতে। এ জন্য নগরের প্রতিটি ইউনিট, ওয়ার্ড ও থানার বিভিন্ন পর্যায়ের নেতাকর্মীদের কঠোর নির্দেশনা দেওয়া হচ্ছে। আন্দোলনের জন্য ঢাকার পর গুরুত্বপূর্ণ অঞ্চল নারায়ণগঞ্জ। ওই অঞ্চল থেকে যেন বিএনপি বড় ধরনের শোডাউন বের করতে না পারে, সে জন্য স্থানীয় নেতাদের কেন্দ্র থেকে নির্দেশনা দেওয়া হবে বলে জানা গেছে।
প্রধান রাজনৈতিক দল দুটিই ঢাকায় প্রবেশের স্পটগুলোকে টার্গেট করেছে। এতে পরিস্থিতি ভয়ংকর রূপ নেওয়ার শঙ্কা রয়েছে। রক্তপাত এড়াতে পুলিশেও চলছে নজরদারি ও সংঘাত ঠেকানোর প্রস্তুতি। তাই ১০ ডিসেম্বরকে ঘিরে এক মাস আগেই দেশের রাজনীতিতে চরম উত্তেজনা বিরাজ করছে।
বিএনপির নেতাকর্মীরা জানান, বিএনপি যখনই কোনো বড় কর্মসূচির ডাক দিয়েছে, তখনই সরকার কৌশলে পরিবহন মালিকদের গাড়ি চলাচল বন্ধ করে দিয়েছে। সম্প্রতি ময়মনসিংহ, খুলনা, রংপুরে অনুষ্ঠিত বিএনপির বিভাগীয় সমাবেশগুলোতে এমন চিত্র দেখা গেছে। পথে পথে সরকারি দলের নেতারা লাঠিসোঁঠা নিয়ে হামলা চালিয়েছে। পুলিশ বাধা দিয়েছে। বহু স্থানে ঘটেছে সংঘর্ষও। ঢাকা সমাবেশকে কেন্দ্র করেও এমন দৃশ্যপট হতে পারে। পুলিশের বাধা, আওয়ামী লীগ-যুবলীগের বাধার আশঙ্কা করা হচ্ছে। রাজধানীর আবাসিক হোটেলসহ সর্বত্র কড়াকড়ি হতে পারে। সব ঘটনার আগাম মাথায় রেখেই প্রস্তুতি চলছে বিএনপিতে। ঘোষণা করা হচ্ছে, বাধা এলে এবার আর পিছু হটবে না, জীবনের ঝুঁকি নিয়ে হলেও মাঠে থাকবে। সমাবেশ বাস্তবায়ন করবে।
আওয়ামী লীগের নেতারা বলছেন, দীর্ঘদিন ধরে রাষ্ট্রীয় ক্ষমতার বাইরে বিএনপি। এই সময়ে ভোট, মাঠের রাজনীতি ও আন্দোলনে ব্যর্থ দলটির শীর্ষ নেতারা। তাদের সাংগঠনিক কর্মকাণ্ড নিয়ে সন্তুষ্ট নয় দলের তৃণমূল। নিজেদের পদ-পদবি ও ব্যক্তিগত ইমেজ ধরে রাখতে সরকারের ঘাড়ে দায় চাপাতে চান বিএনপির শীর্ষ পদধারীরা। এ জন্য আন্দোলনের হুংকার দিচ্ছেন। তারা আরও মনে করেন, লাঠিসোঁঠা নিয়ে মাঠে নামতে নেতাকর্মীদের উসকে দিয়ে রাজনৈতিক অস্থিতিশীল পরিবেশ তৈরি করতে চাচ্ছে বিএনপি। তাদের দাবি, বিএনপি যেন কোনোভাবেই চট্টগ্রাম, ময়মনসিংহ, খুলনা ও রংপুরের মতো লাঠিসোঁঠা নিয়ে ঢাকার মহাসমাবেশে প্রবেশ করতে না পারে, এ জন্য প্রবেশপথগুলো কঠোর নজরদারিতে রাখবে আওয়ামী লীগ।
এ পরিস্থিতিতে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর ঘরেও চিন্তা ঢুকেছে। আগামীতে রাজনীতিতে যদি হঠাৎ করে কোনো বিশৃঙ্খলা সৃষ্টি হয়, তাহলে ঢাকার এই সাত স্পট থেকেই সূত্রপাতের আশঙ্কা তাদের। সংশ্লিষ্ট বিষয়ে ঢাকা মহানগর পুলিশের অতিরিক্ত কমিশনার (ক্রাইম অ্যান্ড অপারেশন্স) এ কে এম হাফিজ আক্তার বলেন, ১০ ডিসেম্বর বিএনপির সমাবেশকে কেন্দ্র করে দুই দলই ঢাকার উল্লিখিত সাত স্পটকে টার্গেট করেছে। তবে আইনশৃঙ্খলা রক্ষায় পুলিশ সব সময় প্রস্তুত রয়েছে। ঢাকাকে টার্গেট করে যে বা যারা বিশৃঙ্খলা করবে, তাদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়া হবে। জনগণের নিরাপত্তার স্বার্থে যেকোনো বিশৃঙ্খলা নিয়ন্ত্রণে পুলিশ যা করার দরকার তা-ই করবে।
ঢাকা মহানগর দক্ষিণ আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক হুমায়ুন কবির বলেন, লাঠিসোঁঠার সঙ্গে জাতীয় পতাকা বেঁধে বিএনপির নেতাকর্মীদের সমাবেশে অংশগ্রহণ ভালো লক্ষণ নয়। এই কার্যক্রমের মধ্য দিয়ে বিএনপি আগুন-সন্ত্রাস, ভাঙচুর, লুটপাট ও সহিংসতার রাজনীতিতে ফিরতে চায়। আগামী ১০ ডিসেম্বর মহাসমাবেশের নামে বিএনপির নেতাকর্মীরা যেন ঢাকায় লাঠিসোঁঠা নিয়ে প্রবেশ করতে না পারে, সে জন্য মহানগরের সর্বস্তরের নেতাকর্মীরা ঢাকার প্রবেশপথে কঠোর অবস্থানে থাকবে। তারা মহাসমাবেশের নামে বিশৃঙ্খল পরিবেশ সৃষ্টি করলে নগরের প্রতিটি নেতাকর্মী দাঁতভাঙা জবাব দেবে।
ঢাকা মহানগর উত্তর বিএনপির সদস্যসচিব আমিনুল হক বলেন, মহাসমাবেশ বাস্তবায়ন করতে আমরা প্রস্তুত। যেখানে বাধা আসবে, সেখানে মোকাবিলা করতেও তৈরি আছি। সরকার বিএনপির বিভাগীয় সমাবেশগুলো দেখে ভয় পাচ্ছে। বাধা দিয়েও জনগণের স্রোত আটকাতে পারেনি। ঢাকার মহাসমাবেশেও মানুষের ঢল নামবে। সব বাধা পার হয়ে মানুষ সমাবেশে আসবে। সরকার ঠেকিয়ে রাখতে পারবে না। আগামী ১০ ডিসেম্বর ঢাকা শহর অচল হয়ে যাবে।