নিজস্ব প্রতিনিধি : রাজনীতিতে এখন সবচেয়ে আলোচিত বিষয় ১০ ডিসেম্বর! ওইদিন ঢাকায় মহাসমাবেশের ডাক দিয়েছে বিএনপি। দলটির এই ঘোষণার পর থেকেই দেশের রাজনীতিতে বইছে গরম হাওয়া। দিনটিকে ঘিরে ক্ষমতাসীন দল আওয়ামী লীগও নড়েচড়ে বসেছে, পাল্টা বক্তব্যের পাশাপাশি চলছে পাল্টা কর্মসূচিও। একই দিন পুরো ঢাকাতেই ব্যাপক লোকসমাগমের প্রস্তুতি নিচ্ছে ক্ষমতাসীন দলটি। সরকারবিরোধী অন্যান্য দলও ১০ ডিসেম্বর নিজ নিজ কর্মসূচি পালন করবে। ওইদিন বিএনপি নির্বাচনের রূপরেখা উপস্থাপন, যুগপৎ গণ-আন্দোলন এবং রাষ্ট্র সংস্কারের রূপরেখা ঘোষণা করবে। দিন যত ঘনিয়ে আসছে, রাজনৈতিক অঙ্গনে ততই উত্তেজনা ও অনিশ্চয়তা সৃষ্টি হচ্ছে। কূটনীতিপাড়াও রাখছে সূক্ষ্ম দৃষ্টি। ব্যবসায়ীরা বড় ঝুঁকি নিয়ে ব্যবসা করতে সতর্ক হচ্ছেন। সব মিলিয়ে ১০ ডিসেম্বর কী ঘটতে চলেছে, তা নিয়ে চরম উদ্বেগ-উৎকণ্ঠা-শঙ্কায় দেশবাসী।
সূত্র জানায়, ১০ ডিসেম্বরের জনসভা থেকে বিএনপি নির্বাচনের রূপরেখা উপস্থাপন করবে। সরকারকে পদত্যাগ করতে হবে অথবা সরকারকে পদচ্যুত করা হবে। তারপর একটি তত্ত্বাবধায়ক সরকার দায়িত্ব গ্রহণ করবে। সেই সরকার বর্তমান নির্বাচন কমিশন বাতিল করে নতুন নির্বাচন কমিশন গঠন করবে এবং সেই নির্বাচন কমিশনের অধীনে নির্বাচন অনুষ্ঠিত হবে। এমন দাবি বাস্তবায়নে ওই সমাবেশ থেকে করা হবে যুগপৎ আন্দোলনের রোডম্যাপও। রাজনৈতিক প্রতিপক্ষ আওয়ামী লীগকে দেওয়া হবে চ্যালেঞ্জ। আলোচিত ওই মহাসমাবেশে যুগপৎ গণ-আন্দোলনের ১০ দফা ও রাষ্ট্র সংস্কারের রূপরেখা ঘোষণা করা হবে। একই দিন সমমনা দলগুলো নিজ নিজ দলীয় মঞ্চ থেকে ঐক্যবদ্ধ আন্দোলনের রূপরেখা ঘোষণাও দিতে পারে।
এদিকে ১০ ডিসেম্বর বিএনপির মহাসমাবেশকে ঘিরে রাজধানীতে যাতে কোনো বিশৃঙ্খলা না হয়, সে জন্য সতর্ক অবস্থানে রয়েছে ক্ষমতাসীন দল আওয়ামী লীগ। বাইরে থেকে যাতে কোনো সন্ত্রাসী বা জঙ্গিবাদের সঙ্গে জড়িতরা ঢাকায় ঢুকতে না পারে, সে জন্য সমাবেশের আগেই সারা দেশের সঙ্গে ঢাকাকে বিচ্ছিন্ন করার পরিকল্পনা নিয়েছে দলটি। ইতিমধ্যে ঢাকা মহানগর উত্তর-দক্ষিণ আওয়ামী লীগের থানা, ওয়ার্ড ও ইউনিট পর্যায়ে নেতাকর্মীদের নির্দেশনা দেওয়া হয়েছে, তারা যাতে পাড়া-মহল্লায় অবস্থান নেন। পাশাপাশি ঢাকা জেলা আওয়ামী লীগও রাজধানীর প্রবেশপথে সমাবেশ করার ঘোষণা দিয়েছে ১০ ডিসেম্বর। বিএনপির সমাবেশের দিন যেকোনো উপায়ে রাজধানীকে নিয়ন্ত্রণে রাখতে মরিয়া আওয়ামী লীগ। কোনোভাবেই তারা বিএনপিকে ছাড় দিতে নারাজ।
বিএনপির নেতারা জানান, গণ-আন্দোলনে সরকারবিরোধী দলগুলো ঐকমত্যে পৌঁছেছে। এরই মধ্যে নিজ নিজ ব্যানারে দাবি আদায়ের আন্দোলনের কর্মসূচিও পালন করছে তারা। এখন শুধু যুগপৎ আন্দোলনের আনুষ্ঠানিকতা বাকি। এক সপ্তাহের মধ্যেই সমমনা দলগুলোর সঙ্গে চূড়ান্ত বৈঠকে আলোচনা শেষ করে এ বিষয়ে নির্দেশনা দেওয়া হবে। ইতিমধ্যে যুগপৎ আন্দোলন থেকে দাবিগুলোও তিন দফায় রাজনৈতিক সংলাপের মাধ্যমে ঠিক করা হয়েছে। তত্ত্বাবধায়ক সরকার গঠন; বর্তমান কমিশন বিলুপ্ত করে স্বাধীন ও নিরপেক্ষ নির্বাচন কমিশন গঠন; খালেদা জিয়াসহ সব বিরোধীদলীয় নেতাকর্মী, সাংবাদিক ও আলেমদের সাজা বাতিল এবং মিথ্যা মামলা প্রত্যাহারের পাশাপাশি নতুন মামলায় গ্রেপ্তার বন্ধ ও সভা-সমাবেশে বাধা সৃষ্টি না করা; ডিজিটাল নিরাপত্তা আইন-২০১৮ ও বিশেষ ক্ষমতা আইন-১৯৭৪-সহ মৌলিক মানবাধিকার হরণকারী সব কালাকানুন বাতিল; বিদ্যুৎ, জ্বালানি, গ্যাস, পানিসহ জনসেবার সব খাতে দর বাড়ানোর গণবিরোধী সিদ্ধান্ত বাতিল এবং নিত্যপ্রয়োজনীয় দ্রব্যমূল্য সাধারণ মানুষের ক্রয়ক্ষমতার মধ্যে আনা। এ ছাড়া গত ১৫ বছরে বিদেশে অর্থপাচার, ব্যাংকিং ও আর্থিক খাত, বিদ্যুৎ-জ্বালানি খাত ও শেয়ারবাজারসহ রাষ্ট্রীয় সব ক্ষেত্রে সংঘটিত দুর্নীতি চিহ্নিত করার লক্ষ্যে কমিশন গঠন, গুমের শিকার সব নাগরিককে উদ্ধার, বিচার-বহির্ভূত হত্যা ও রাষ্ট্রীয় নির্যাতনের প্রতিটি ঘটনার দ্রুত বিচারসহ ধর্মীয় সংখ্যালঘুদের বাড়িঘর, উপাসনালয় ভাঙচুর ও সম্পত্তি দখলের বিচার এবং আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী, প্রশাসন ও বিচার বিভাগে সরকারি হস্তক্ষেপ বন্ধ করে স্বাধীনভাবে কাজ করার সুযোগ দেওয়ার কথা রয়েছে।
১০ ডিসেম্বর নিয়ে বিএনপি ও আওয়ামী লীগের শীর্ষস্থানীয় নেতাদের বাগ্্যুদ্ধও শুরু হয়েছে। সম্প্রতি ঢাকা মহানগর উত্তর বিএনপির আহ্বায়ক আমানউল্লাহ আমান বলেন, ‘আগামী ১০ ডিসেম্বরের পরে দেশ চলবে খালেদা জিয়া ও তারেক রহমানের কথায়।’ দলের কেন্দ্রীয় প্রচার সম্পাদক শহীদ উদ্দীন চৌধুরী লক্ষ্মীপুরে দলীয় কর্মসূচিতে বলেন, ‘শিগগিরই তারেক রহমান দেশে আসবেন।’ দলের চেয়ারপারসনের উপদেষ্টা জয়নুল আবদিন ফারুক বলেন, ‘১০ ডিসেম্বর ঢাকায় সমাবেশ হবে আটলান্টিক মহাসাগরের মতো। এই সমাবেশে খালেদা জিয়া যাবেন।’
ঢাকা মহানগর উত্তর আওয়ামী লীগের সভাপতি বজলুর রহমান জানান, ইতিমধ্যে ঢাকার সব থানা ইউনিটে শান্তি সমাবেশ করে লোকসমাগম ঘটিয়ে নেতাকর্মীদের চাঙা রাখছেন তারা। এর ধারাবাহিকতায় ৬ অথবা ৯ ডিসেম্বর বিশাল সমাবেশ করবে মহানগর উত্তর আওয়ামী লীগ। ঢাকা মহানগর দক্ষিণ আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক হুমায়ুন কবির জানান, ১০ ডিসেম্বর সকাল থেকেই মহানগর দক্ষিণের প্রতিটি মহল্লা, ওয়ার্ড ও থানার সব নেতাকর্মী সর্বোচ্চ সতর্ক অবস্থানে থাকবেন। বিএনপি এদিন কোনো নাকশকতা ও নৈরাজ্য সৃষ্টি করলে কোনো প্রকার ছাড় দেওয়া হবে না। আওয়ামী লীগের কেন্দ্রীয় সাংগঠনিক সম্পাদক এস এম কামাল বলেন, ঢাকার সমাবেশে জনগণ সাড়া দেবে না। ১০ ডিসেম্বর বিএনপি কোনো নাশকতা করার চেষ্টা করলে তাদের কবর রচনা হবে।
জানা গেছে, রাজধানীর সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে ১০ ডিসেম্বর বিএনপিকে মহাসমাবেশের অনুমতি দিয়েছে সরকার। তবে মহাসমাবেশের জন্য নয়াপল্টন নিয়েই বিএনপির নেতাদের কঠোর ঘোষণা। কেন্দ্রীয় কার্যালয়ের সামনেই মহাসমাবেশ করার ব্যাপারে অনড় তারা। এ বিষয়ে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান কামাল বলেছেন, শর্ত সাপেক্ষে বিএনপিকে সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে ১০ ডিসেম্বর সমাবেশের অনুমতি দেওয়া হয়েছে। কোনো অপ্রীতিকর ঘটনা ঘটানো যাবে না। প্রতিবন্ধকতা ও জনদুর্ভোগ করা যাবে না। তবে বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য গয়েশ্বর চন্দ্র রায় বলেন, ‘নয়াপল্টনে সমাবেশ করতে অনুমতি চেয়েছি। অনুমতি দিলেও ওখানে সমাবেশ করব, না দিলেও সমাবেশ করব সেখানে।’
১০ ডিসেম্বরের সমাবেশ শান্তিপূর্ণভাবে অনুষ্ঠানের ওপর বহুলাংশেই নির্ভর করবে আগামী দিনের রাজনীতির গতিধারা। ঢাকার জাতিসংঘ প্রতিনিধি, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র, যুক্তরাজ্য, ইউরোপীয় ইউনিয়ন, জাপানসহ বিভিন্ন দেশের কূটনীতিকেরা রাজনৈতিক ঘটনাপ্রবাহ গভীরভাবে পর্যবেক্ষণ করছেন। ঢাকায় কোনো অনাকাক্সিক্ষত, অপ্রীতিকর ঘটনা ঘটলে তার দায় সরকার যেমনি এড়াতে পারে না, বিএনপির পক্ষেও দায়মুক্ত থাকা সম্ভব নয়। নির্বাচনকেন্দ্রিক রাজনীতিতে শান্তিশৃঙ্খলা বজায় রাখার চাপ রয়েছে সরকার ও বিএনপির ওপর। বিএনপির এ পর্যন্ত অনুষ্ঠিত সমাবেশগুলো শান্তিপূর্ণভাবেই হয়েছে। সরকার, তার আইনশঙ্খলা বাহিনীও শান্তিশৃঙ্খলা রক্ষায় তৎপর ছিল। সরাসরি বাধা না দিয়ে বাস, লঞ্চ চলাচল বন্ধ রাখার কৌশলী নীতি নেয় সরকার। প্রতিটি মহানগরের সমাবেশে বিপুল কর্মী-সমর্থক-জনতার সমাবেশ ঘটেছে। কিন্তু ১০ ডিসেম্বর ট্রেন, বাস ও লঞ্চে বাইরে থেকে লোকজন আসতে দেওয়া হবে না। কেউ যাতে কোনো রকম সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ড চালাতে না পারে, সে জন্য বাড়ি বাড়ি, হোটেল, ট্রেন, বাস, লঞ্চে, সড়কে পথিমধ্যে ব্যাপক তল্লাশি চালানো হবে।
রাজধানীর সমাবেশে বিএনপির নেতাদের পক্ষে শীর্ষ নেত্রী বেগম খালেদা জিয়া উপস্থিত থাকতে পারেন মর্মে ঘোষণা দেওয়ার পরিপ্রেক্ষিতে সরকার বেশ কিছু সতর্কতামূলক ব্যবস্থা নিতে যাচ্ছে। গুলশানে ফিরোজা ভিলা ও সংলগ্ন এলাকাসহ গোটা গুলশানে নজিরবিহীন নিরাপত্তাব্যবস্থা রাখা হচ্ছে। রাজধানীর সব থানার পুলিশ, রিজার্ভ পুলিশ ছাড়াও প্রতিটি জেলা, শহর থেকে বিপুলসংখ্যক পুলিশ ১০ ডিসেম্বর ঢাকায় মোতায়েন করা হবে শান্তিশৃঙ্খলা রক্ষার জন্য। ফিরোজা ভিলার আশপাশে শুধু নয়, গোটা গুলশান এলাকায়ই বিএনপির কোনো নেতাকে, সন্দেহভাজন কাউকে চলাফেরা করতে দেওয়া হবে না। প্রধানমন্ত্রীসহ সরকারের একাধিক প্রভাবশালী মন্ত্রী ইতিপূর্বে বলেছেন, বিএনপি বাড়াবাড়ি করলে তাদের নেত্রী খালেদা জিয়াকে আবার জেলখানায় স্থানান্তর করা হবে। বিএনপির তরুণ নেতাদের অপরিণামদর্শী বক্তব্য সরকারকে সে সুযোগই করে দিচ্ছে বলে রাজনৈতিক বিশেষজ্ঞরা মনে করছেন।
১০ ডিসেম্বর বিএনপির সমাবেশ নিয়ে আওয়ামী লীগের প্রেসিডিয়াম সদস্য আব্দুর রহমান বলেন, বিএনপি সব সময়ই সভা-সমাবেশ-মিছিলের নামে জনগণের জান-মালের ক্ষতি করে, নৈরাজ্য সৃষ্টি করে। ঢাকায় লাখ লাখ লোকের সমাবেশ করতে চায় বিএনপি। এত জনপ্রিয়তা, তাহলে নির্বাচনে আসতে ভয় কী তাদের? মূলত তারা সহিংসতার মাধ্যমে দেশটাকে ভিন্ন খাতে প্রবাহিত করে তৃতীয় শক্তিকে উসকানি দিয়ে অসাংবিধানিক উপায়ে ক্ষমতায় আসতে ব্যস্ত। তারা ২০০৬ সালের মতো একটি পুতুল সরকার ক্ষমতায় আনতে মরিয়া।
বিএনপির মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর বলেন, ১০ ডিসেম্বর নয়াপল্টনেই মহাসমাবেশ হবে। এটি জনগণের ঘোষণা। ওই দিন শান্তিপূর্ণ সমাবেশ অনুষ্ঠিত হবে। সেই সমাবেশ থেকে কর্মসূচি ঘোষণা করা হবে।
১০ ডিসেম্বর ঢাকায় কী ঘটতে যাচ্ছে
রাজনীতিতে গরম হাওয়া