১৩ জমিদারের গ্রাম পাবনার হাটুরিয়া

পাবনা : যমুনার ভাঙনকবলিত দারিদ্র্যপীড়িত গ্রামটি দেখলে কারো মনে হবে না, একসময় এখানেই ছিল ১৩ জমিদারের বাস। যমুনার তীরে বাধা থাকত জমকালো বজরা, সহজ নৌপথের কারণে গড়ে উঠেছিল ব্যবসাকেন্দ্র। তবে জমিদারি প্রথা বিলোপের পর জমিদারদের সঙ্গে সঙ্গে সে জৌলুস চলে যায়। থেকে যায় শুধু পরম্পরাগত কথকতা, জরাজীর্ণ জমিদার ভবন ও নানা সংকটে ভুগতে থাকা স্মৃতিকাতর গ্রামের মানুষ।
পাবনার বেড়া উপজেলার যমুনার তীরবর্তী গ্রাম হাটুরিয়া। ১৩ জমিদারের গ্রাম হওয়ায় এ গ্রামের অতীত ছিল বেশ চমকপ্রদ। পাবনা ও সিরাজগঞ্জের বাইরে অন্যান্য জেলায়ও ছিল তাদের জমিদারি। গ্রামের পাশে নাকালিয়া নৌবন্দর থেকে কলকাতায় সরাসরি স্টিমার চলাচল করত। এ বন্দর থেকে নৌপথে দেশের বিভিন্ন স্থানে যাওয়া যেত সহজেই। ফলে শুধু জমিদাররাই নয়, গ্রামটিতে বসতি গড়ে তুলেছিল বহু ব্যবসায়ী। যে কারণে হাটুরিয়া বৃহত্তর পাবনার অন্যতম অভিজাত এলাকা ও বাণিজ্যকেন্দ্র হিসেবে খ্যাতি পায়। গ্রামের সুনাম ছড়িয়ে পড়ে কলকাতাতেও।
প্রবীণ ব্যক্তিরা জানান, প্রথমে দু-একজন জমিদার বাস করলেও পরে একে একে তাদের সংখ্যা বাড়তে থাকে। একপর্যায়ে ১৯১৫ সাল নাগাদ গ্রামটিতে আবাস গড়ে তোলেন ১৩ জন জমিদার। এরা হলেন প্রমথনাথ বাগচী, কাঞ্চিনাথ বাগচী, কালীসুন্দর রায়, উপেন্দ্রনাথ বাগচী, ক্ষীরোদচন্দ্র রায়, ভবানীচরণ বাগচী, সুরেশচন্দ্র রায়, ক্ষুদিরাম পাল, সুধাংশমোহন রায়, যদুনাথ ভৌমিক, শক্তিনাথ রায়, যতীন্দ্রনাথ ভৌমিক ও বঙ্কিম রায়। জমিদারি প্রথা বিলোপের আগ পর্যন্ত তারা এ গ্রামেই বসবাস করতেন।
এলাকাবাসী আরো জানান, এক গ্রামে এত জমিদার একসঙ্গে বাস করলেও তাদের মধ্যে কোনো সংঘাত ছিল না। তবে বিভিন্ন উৎসব-পার্বণে চলত প্রতিযোগিতা। এদের প্রত্যেকেরই কলকাতায় বাড়ি ছিল। ফলে জমিদারি প্রথা বিলোপের পর পরই এরা সবাই কলকাতায় স্থায়ীভাবে বসবাস শুরু করেন।
বর্তমানে জমিদারদের ভবনগুলোর অধিকাংশই ধ্বংসাবশেষে পরিণত হয়েছে। কোনোমতে টিকে থাকা ভবনে ঝুঁকি নিয়ে বাস করছে কয়েকটি পরিবার। এমনই এক পরিবারের পঞ্চাশোর্ধ্ব দীপক গোস্বামী জানান, তাদের ভবনের এক স্থানে নির্মাণকাল ১৯১১ সাল খোদাই করা ছিল। নির্মাতার নাম ছিল জমিদার ক্ষীরোদচন্দ্র রায়ের পিতা উমেশচন্দ্র রায় বাহাদুর।
কথা হলো বেড়া মনজুর কাদের মহিলা কলেজের ইতিহাস বিভাগের প্রভাষক মনোয়ার হোসেনের সঙ্গে। তিনি জানান, জমিদারি প্রথা সম্পর্কে ভালোভাবে জানতে এসব ঐতিহাসিক নিদর্শন সংরক্ষণ করা জরুরি। তবে এক সময়ের ১৩ জমিদারের জৌলুসপূর্ণ হাটুরিয়া এখন নানা সমস্যায় জর্জরিত। গ্রামে কোনো অভ্যন্তরীণ রাস্তা নেই; নেই পানি নিষ্কাশনের ব্যবস্থা। ফলে বর্ষা মৌসুমে জলাবদ্ধতায় ডুবে থাকে গোটা গ্রাম। ভাঙনে নিঃস্ব হয়েছে গ্রামের বহু পরিবার, অভাব-অনটন এখন তাদের নিত্যসঙ্গী।
গ্রামবাসীরা আরো জানায়, অভাব-অনটনের কারণে গ্রামের ছেলে-মেয়ের বড় অংশই এখন শিক্ষার পরিবর্তে উপার্জনের দিকে ঝুঁকছে। তা ছাড়া গ্রামে বাল্য ও বহুবিবাহের প্রবণতাও অনেক বেশি।
স্থানীয় ইউপি চেয়ারম্যান মোস্তাফিজুর রহমান জানান, জমিদারদের গ্রাম বলে পরিচিত হাটুরিয়া এখন অনেক সংকটে ভুগছে। এসব সমস্যা সমাধানের পাশাপাশি বিলীন হতে বসা ঐতিহ্য সংরক্ষণের উদ্যোগ নেয়া প্রয়োজন।