নিজস্ব প্রতিনিধি : ইসলামপন্থী ধর্মীয় দলগুলো নির্বাচনে বিএনপির প্রধান হাতিয়ার। সরলমনা, ধর্মপ্রাণ মুসলমানদের প্রভাবিত করতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রেখে থাকে এরা। আওয়ামী লীগকে ধর্ম নিরপেক্ষতার নামে ইসলামের জন্য ক্ষতিকর হিসেবে চিহ্নিত করে এবং ভারতবিরোধী প্রচারণা চালিয়ে তারা প্রভাব সৃষ্টি করে থাকে। এই প্রতারণার শিকার হয়েছে আওয়ামী লীগ। এদের সম্পর্কে বিশেষভাবে সতর্ক থেকেই সরকারি দল ধর্মীয় দলগুলোকে বিএনপি ও তার নেতৃত্বাধীন ২০ দলীয় জোট থেকে সরিয়ে আনার এবং তাদের ১৪ দলীয় জোটে শরিক করা বা তা না হলেও নিজস্ব রাজনৈতিক বলয়ে রাখার কর্মপরিকল্পনা নিয়ে অগ্রসর হয়েছে। এতে তারা প্রাথমিকভাবে অনেকখানি সফলও হয়েছে।
জানা যায়, ২০ দলীয় জোটে থাকা পাঁচটি ইসলামী দলকে জোট থেকে বের করে আনা এবং তাদের বাইরে থাকা আরো প্রায় ১৫টি ধর্মীয় সংগঠনকে একক প্ল্যাটফরমে আনার জন্য নানামুখী প্রক্রিয়া চলছে। ২০ দলীয় জোটে থাকা ইসলামী দলগুলো হচ্ছে জামায়াতে ইসলাম, জমিয়তে উলামায়ে ইসলাম, ইসলামী ঐক্যজোট, খেলাফত মজলিস ও বাংলাদেশ ইসলামিক পার্টি। বিএনপির নেতৃত্বে ২০ দলীয় জোটে থাকা নিয়ে জামায়াতে বিভক্তি রয়েছে। ভারপ্রাপ্ত আমির মজিবর রহমান ও সেক্রেটারি জেনারেল ডা. শফিকুর রহমানের মধ্যকার বিভক্তি কেন্দ্র, জেলা, উপজেলা পর্যায়েও স্পষ্ট। ডা. লতিফুর রহমানের সঙ্গে সরকারের ঘনিষ্ঠ যোগাযোগ থাকার সন্দেহ জামায়াতের মধ্যে যেমনি বিএনপি মহলেও প্রবলভাবেই রয়েছে। আমির মকবুল আহমদ, নায়েবে আমির মিয়া গোলাম সারোয়ার এবং ভারপ্রাপ্ত আমির মজিবুর রহমান সরকারের সঙ্গে কোনো রকম সমঝোতার বিরোধী। বেগম খালেদা জিয়ার মুক্তির দাবিতে জোটবদ্ধ আন্দোলন এবং নির্বাচন প্রশ্নে বিএনপির সঙ্গে অভিন্ন সিদ্ধান্ত নেওয়ার পক্ষে জামায়াতের এই অংশ। অন্যদিকে ডা. শফিকুর রহমানের পেছনে তরুণ নেতাদের বড় অংশের সমর্থন রয়েছে। তারা দলের নেতা-কর্মীদের রক্ষা এবং মুক্তিযুদ্ধ ও বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের অবদানকে প্রকাশ্যে স্বীকার করে নিয়ে সংশোধিত গঠনতন্ত্র নিয়ে নির্বাচনে অংশ নেওয়ার পক্ষে। জামায়াতের এই নেতৃত্ব যুদ্ধাপরাধের দায়মুক্ত থেকে প্রকাশ্য রাজনৈতিক কর্মকাণ্ড চালানো এবং সমমনা অপরাপর দলের সঙ্গে বা এককভাবে নির্বাচনে অংশ নেওয়ার পক্ষে। সরকারি একটি সংস্থা এ ব্যাপারে তাদের সঙ্গে নিয়মিত ঘনিষ্ঠ যোগাযোগ রেখে চলেছেন। গত ১২ মার্চ ঘরোয়া বৈঠক চলাকালে ভারপ্রাপ্ত আমির মজিবুর রহমানসহ ১২ জন নেতাকে গ্রেফতার করার পেছনে জামায়াতের উল্লিখিত অংশ থেকে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীকে আগাম খবর দেওয়া হয় বলে অভিযোগ রয়েছে। জামায়াতের বিএনপিপন্থী কয়েকজন সিনিয়র নেতার বিরুদ্ধে যুদ্ধাপরাধের অভিযোগ এনে মামলা দায়েরের প্রাথমিক প্রস্তুতিও চলছে। অন্যদিকে জামায়াতের যুদ্ধাপরাধবিরোধী অংশসহ অপরাপর ধর্মীয় সংগঠনগুলোর নেতাদের মধ্যে কাকে কোন আসনে ছাড় দেওয়া যেতে পারে, তারও প্রাথমিক পর্যায়ের আলোচনা চলছে। ছাড় দেওয়ার শর্তে ২০ দলীয় জোটে থাকা ইসলামী দলগুলোর সঙ্গেও সংশ্লিষ্টরা কথাবার্তা বলছেন। এসব দল থেকে বলা হচ্ছে সরকারের প্রবল চাপে রয়েছেন তারা। বাস্তবতা হচ্ছে চাপের পাশাপাশি অনেকে প্রলুব্ধ হচ্ছেন এবং সরকারের কাছ থেকে ব্যক্তিগত ফায়দা নিতেও কুণ্ঠিত হচ্ছেন না।
২০ দলীয় জোটের বাইরে থাকা প্রায় ১৪-১৫টি ইসলামী দলকে জোটবদ্ধ করার প্রক্রিয়া জোরেশোরে চলছে। এরা ১৪ দলেও শরিক হতে চায়। কিন্তু ১৪ দলের শরিক ওয়ার্কার্স পার্টি, জাসদের দুই অংশ, সাম্যবাদী দল, গণতন্ত্রী পার্টি এর ঘোরতর বিরোধী। নির্বাচনী কৌশল হিসেবে সমঝোতা করা হলেও ১৪ দলে নেওয়া বা ১৪ দলের সঙ্গে সমঝোতার নির্বাচনের বিপক্ষে তারা। সরকার ধর্মীয় দলগুলোর স্বার্থে তাদের পরামর্শমাফিক বেশ কিছু পদক্ষেপ নিয়েছে। শিক্ষাব্যবস্থায় পরিবর্তন আনা, কওমি শিক্ষার উন্নয়ন, আলেম-ওলামা, ধর্মীয় সংগঠনের নেতা-কর্মীদের ও মাদ্রাসা শিক্ষক-শিক্ষার্থীদের প্রভাবিত করার উদ্দেশ্যে সরকার তাদের কল্যাণে এসব পদক্ষেপ নিয়েছে। মাদ্রাসা শিক্ষা, শিক্ষক ও শিক্ষার্থীদের আধুনিক শিক্ষা ও মূল ¯্রােতধারার সঙ্গে সম্পৃক্ত করাও সরকারের উদ্দেশ্য। হেফাজতে ইসলামের নেতা আল্লামা শফিসহ হেফাজত ও অন্যান্য ধর্মীয় সংগঠনের পরামর্শ অনুযায়ীই সরকার এসব পদক্ষেপ নিয়েছে। তারা প্রধানমন্ত্রী ও সরকারের প্রতি কৃতজ্ঞতাও প্রকাশ করছেন। রাজনৈতিক স্বার্থে ব্যবহারের পাশাপাশি তাদের কল্যাণে বাস্তবভিত্তিক পদক্ষেপ নেওয়ায় ধর্মীয় নেতারা সন্তুষ্ট। সারা দেশেই এর প্রভাব পড়ছে। এতে করে ধর্মকে আওয়ামী লীগের বিরুদ্ধে ব্যবহার করা জামায়াত ও তার সহযোগীদের পক্ষে কঠিন হবে। নীতিগতভাবে বিপক্ষে হলেও শেখ হাসিনার এই কৌশলকে মূল্যায়ন করছেন ১৪ দলের বাম ধারার শরিকরাও। সৌদি আরবসহ ম্যধপ্রাচ্যের অনেক ইসলামী দেশ শেখ হাসিনার প্রতি দ্ব্যর্থহীন সমর্থন জানাচ্ছে।
বাংলাদেশ ইসলামী ঐক্যজোট, তরিকত ফেডারেশন, খেলাফত আন্দোলন, গণতান্ত্রিক ইসলামিক মুভমেন্ট, জমিয়তে হিজবুল্লাহ, বাংলাদেশ ইসলামিক পার্টি, পিপলস জাস্টিস পার্টি, ন্যাশনাল ডেমোক্রেটিক অ্যালায়েন্স, ন্যাপ ভাসানী, বাংলাদেশ মুসলিম লীগ, জাতীয়তাবাদী গণতান্ত্রিক দলকে জোটবদ্ধ করার প্রয়াসও চলছে। খালেদা জিয়ার মুক্তি অনিশ্চিত ভেবেই তারা বিকল্প চিন্তা করছে। বিএনপি ইসলামী দলগুলোকে ঐক্যবদ্ধভাবে রাখার সর্বাত্মক চেষ্টা করছে। এই দলগুলোর অংশবিশেষ ২০ দলীয় জোট ছাড়লেও এদের অনেকের একটা অংশ ২০ দলীয় জোটেই থেকে যাবে বলে বিএনপির নেতারা মনে করছেন।