নিজস্ব প্রতিনিধি : বেশ কয়েকটি বড় প্রশ্নবোধক বিষয় নিয়েই ড. কামাল হোসেনের জাতীয় ঐক্যফ্রন্টের জন্ম হয়েছিল। সেসব প্রশ্নের উত্তর অজানা রেখে পথচলা শুরু করার আগেই ঐক্যফ্রন্ট অনিশ্চয়তার মুখোমুখি হয়েছে। ঐক্যফ্রন্ট তার প্রতিদ্বন্দ্বী ২০ দলীয় জোটকেও বড় রকমের সংকটের মুখে ঠেলে দিয়েছে। পৌরসভা ও ইউনিয়ন পরিষদ নির্বাচনকে সামনে রেখে দ্বন্দ্ব, বিরোধ, বিভক্তি তীব্র হচ্ছে। জোটবদ্ধ নির্বাচনের কথা বলে নিজের দলের উল্লেখযোগ্য সংখ্যক প্রার্থীর জোটগত মনোনয়ন নিশ্চিত করবে জাতীয় ঐক্যফ্রন্টের অনেক শরিক, যা জামায়াতসহ ২০ দলের অপর অধিকাংশ শরিক মেনে নিতে রাজি নয়। স্থানীয় সরকারসমূহের নির্বাচনের পর আগামী বছরের মাঝামাঝি বিএনপিসহ ২০ দলের শরিকরা ড. কামালের নেতৃত্বাধীন জাতীয় ঐক্যফ্রন্ট রেখে বা তাদের সাথে সমঝোতার পাশাপাশি ২০ দলের ঐক্য সমান্তরালভাবে এগিয়ে নেওয়ার পক্ষে নয় তারা।
জাতীয় সংসদ নির্বাচনকে সামনে রেখে হঠাৎ করেই রাজনৈতিক অঙ্গন থেকে প্রায় নির্বাসিত ড. কামাল হোসেনের আবির্ভাব ঘটে। সরকারপ্রধানের সঙ্গে আনুষ্ঠানিক সংলাপ, বেগম খালেদা জিয়ার মুক্তি ও অন্য নেতাদের বিরুদ্ধে দায়ের করা মামলা, গ্রেফতারি পরোয়ানা প্রত্যাহারসহ অনেক জরুরি বিষয় অনুত্থাপিত ও অমীমাংসিত রেখে ড. কামাল নির্বাচন অংশ নেওয়ার পক্ষে অবস্থান নেন। অজানা কারণে লন্ডন থেকে কামাল হোসেনের পরামর্শ ও নির্দেশনামতো নির্বাচনে অংশ নেওয়া, নির্বাচিতদের শপথ গ্রহণ, সংসদ অধিবেশনে যোগদানের নির্দেশ আসে। ড. কামালের ফাঁদে কেন পড়ল বিএনপি, শীর্ষস্থানীয় কয়েকজন ছাড়া দলটির সর্বস্তরের নেতাকর্মীর কাছে আজও তা অজানা রহস্যে ঘেরা। জেলখানা থেকে প্রচলিত নিয়মনীতির ব্যত্যয় ঘটিয়ে বেগম খালেদা জিয়ার প্যারোলে ছয় মাসের জন্য মুক্তি, আবারও ছয় মাসের জন্য প্যারোলের মেয়াদ বৃদ্ধি এবং খালেদা জিয়াকে লন্ডনে পাঠানোর চলমান উদ্যোগ, প্রক্রিয়ার পেছনে ড. কামাল হোসেনের ভূমিকা রয়েছে বলেই জানা যায়।
রাজনৈতিক অঙ্গনে প্রশ্ন রয়েই গেছে, ড. কামাল হোসেন সরকারের কাছেই-বা হঠাৎ এতটা গুরুত্বপূর্ণ কেন হয়ে উঠলেন। বিএনপির প্রতিষ্ঠাতা সদস্য ও জিয়াউর রহমানের সর্বাধিক ঘনিষ্ঠ এবং পরবর্তীকালে বিএনপির অন্যতম প্রতিষ্ঠাতা কর্নেল ড. অলি আহমদ। তার ভাষায়, শেখ হাসিনা ও আওয়ামী লীগকে ক্ষমতায় আনাই ছিল ড. কামাল হোসেনের উদ্দেশ্য। প্রশ্ন উঠেছে, আওয়ামী লীগ থেকে তিনি চরম অপমানিত হয়ে বিতাড়িত হওয়ার পর সেই দলকে ক্ষমতায় এনে তারই-বা কী লাভ? আওয়ামী লীগের একজন প্রবীণ নেতা বলেন, পঁচাত্তর-পরবর্তী ন্যক্কারজনক ভূমিকার কারণে ড. কামাল বঙ্গবন্ধু-কন্যা শেখ হাসিনার কাছেই নিন্দিত ছিলেন। এ অবস্থার অবসান ঘটিয়ে শেখ হাসিনার কাছাকাছি আসা, সুযোগমতো আওয়ামী লীগে একটা অবস্থান ফিরে পাওয়া, তা না হলেও রাজনীতিতে একটা সম্মানজনক অবস্থান লাভ ড. কামালের মুখ্য উদ্দেশ্য। চরম সুবিধাভোগী, ব্যক্তিস্বার্থবাদী এই নেতা বিএনপিসহ বিরোধীদের নির্বাচনে আনার মাধ্যমে জাতীয় ও আন্তর্জাতিকভাবে নির্বাচনের বাহ্যিক গ্রহণযোগ্যতা দিয়ে শেখ হাসিনাকে নিরাপদে দেশ শাসনের ব্যবস্থা করে দিয়েছেন। সাংগঠনিক, রাজনৈতিকভাবে অস্তিত্বহীন ড. কামাল ও তার গণফোরামের দুটি আসন পাওয়াও কম অর্জন নয়। ঐক্যফ্রন্টের বৈঠকে এবং সংসদে গণফোরাম সদস্যদের বক্তব্যে এও স্পষ্টভাবেই সাধারণের কাছে প্রতীয়মান হয়েছে যে তারা সবই করছেন, বলছেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার জন্য তার রাজনৈতিক স্বার্থে।
বিএনপির সকল পর্যায়ের নেতাকর্মীরা বিএনপিকে নিয়ে কামাল হোসেনের কথিত জাতীয় ঐক্যফ্রন্টের আত্মপ্রকাশ এবং ড. কামালের সঙ্গে পরামর্শ করে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ রাজনৈতিক সিদ্ধান্ত গ্রহণের ঘটনাবলি মেনে নিতে পারেননি। তারা ড. কামালের ভূমিকা ও সিদ্ধান্তগুলো বিএনপির বড় ধরনের রাজনৈতিক ক্ষতি ডেকে এনেছে বলে মনে করেন। তাদের মতে, ইতিমধ্যে যে ক্ষতি হয়েছে তা সহসা কাটিয়ে ওঠা বিএনপির পক্ষে সম্ভব নয়। ২০ দলীয় জোটের অন্যতম শরিক জামায়াতে ইসলামী শুরু থেকেই সরকারের সঙ্গে ড. কামালের রাজনৈতিক সংলাপসহ অন্যান্য কার্যক্রমে বিএনপির অংশগ্রহণের প্রবল বিরোধিতা করে। ২০ দলের অন্য শরিকরাও এতে সন্তুষ্ট নয় এবং বিএনপির বক্তব্যে আশ্বস্তও হতে পারেনি। ২০ দলীয় জোটকে নিষ্ক্রিয় করে ড. কামালের ঐক্যফ্রন্ট নিয়ে মাতামাতিতে অসন্তুষ্ট ক্ষুব্ধ জোটের নেতাকর্মীরা। তারা আনুষ্ঠানিকভাবে কয়েকবারই বিএনপিকে সতর্ক করে ২০ দলীয় জোটকে সক্রিয় করার পরামর্শ দিয়েছেন। তাদের মতামত, পরামর্শ বিবেচনায় না নিয়ে তাদের প্রভাবিত করার চেষ্টা করে আসছে বিএনপি। জামায়াত স্পষ্ট করেই জানিয়ে দিয়েছে, ড. কামাল তার গণফোরাম ও জাতীয় ঐক্যফ্রন্ট ত্যাগ না করলে তারা বিএনপি ও ২০ দলীয় জোটের সাথে থাকবে না। অবশ্য জামায়াতের একটি অংশ যেকোনো পরিস্থিতিতে বিএনপির সঙ্গে সমঝোতা ও মিতালি অব্যাহত রাখার পক্ষে। ড. কামাল ও তার নেতৃত্বাধীন ঐক্যফ্রন্টে বিএনপির অংশগ্রহণের বিরোধিতাকারী জামায়াতের একটি অংশ কর্নেল (অব.) অলি আহমদের সাথে গভীর বোঝাপড়া ও সম্পর্ক গড়ে তুলেছে। তারা বিএনপির কাছে ব্যাখ্যা চেয়েছে জাতীয় ঐক্যফ্রন্টের গিয়ে তারা ও ২০ দলীয় জোট কতটা লাভবান হয়েছে। এই ফ্রন্ট ছেড়ে ২০ দলীয় জোটবদ্ধভাবে কর্মসূচি ঘোষণার দাবি করে তারা বলেছে, অন্যথায় এই জোট সম্পর্কে তারা বিকল্প চিন্তা করবে। বিএনপির এক শীর্ষস্থানীয় নেতা জানান, জামায়াত কার্যত জোট ছাড়ার হুমকি দিয়েছে। ২০ দলীয় জোটের আরো অন্তত চারটি দল তাদের সঙ্গে রয়েছে। তারা কর্নেল অলির নেতৃত্বে বৃহত্তর ঐক্য গড়ে তুলবে। এ নিয়ে কথাবার্তা শুরু হয়েছে। আসন্ন পৌরসভা ও ইউনিয়ন পরিষদ নির্বাচনে জামায়াতসহ ২০ দলের শরিকরা শতাধিক পৌরসভায় এবং এক-চতুর্থাংশ ইউনিয়ন পরিষদে জোটগত মনোনয়ন চেয়েছে। তাদের বর্তমান অনানুষ্ঠানিক প্রস্তাব সময়মতো তারা আনুষ্ঠানিকভাবে জানাবে। সমঝোতায় আসতে তারা বিএনপির ওপর প্রবল চাপ সৃষ্টি করবে।
বিএনপি ও ২০ দলীয় জোটের প্রায় সকল শরিকের শীর্ষ পর্যায় থেকে কেন্দ্রীয়, জেলা, উপজেলা পর্যায়ে জাতীয় ঐক্যফ্রন্টবিরোধী মনোভাব প্রবলভাবে থাকলেও তারা এ পর্যায়ে এর বিপক্ষে প্রকাশ্য অবস্থান নেওয়ার পক্ষে নয়। দারুণভাবে অসহায়বোধ করছে তারা। এর প্রথম ও প্রধান কারণ শীর্ষস্থানীয় নেতাদের বিরুদ্ধে চলমান মামলা। দুর্নীতি ও অগ্নিসন্ত্রাস, হত্যা মামলার আসামি হয়ে তারা সরকারের করুণায় মুক্ত জীবনে আছেন। অপর প্রধান কারণ হচ্ছে লন্ডনে অবস্থানরত শীর্ষ নেতা তারেক রহমানের সিদ্ধান্তের বিপক্ষে অবস্থান নেওয়া বা তার বিরুদ্ধে কথা বলাও সম্ভব নয় বিএনপির নেতাদের পক্ষে। এ ব্যাপারে মূল নেত্রী বেগম খালেদা জিয়ার সুস্পষ্ট নির্দেশ রয়েছে। এর ফলে তারেক রহমান যা-ই বলছেন, যে সিদ্ধান্তই দিচ্ছেন, তার বাইরে যাওয়ার শক্তি, ক্ষমতা তাদের নেই। বড় প্রশ্ন হচ্ছে সরকারের অনুকম্পা, তাদের নির্দেশনা ও পরামর্শ মেনে বিএনপির মতো বৃহৎ দল ও তার নেতৃত্বাধীন ২০ দলীয় জোট কি সরকারবিরোধী কার্যকর কোনো ভূমিকা নিতে পারবে! বিএনপির পক্ষে ড. কামাল ও জাতীয় ঐক্যফ্রন্ট ত্যাগ করাও কি সম্ভব? শেষ পর্যন্ত জাতীয় ঐক্যফ্রন্ট নয়, ২০ দলীয় জোটই দ্বিখণ্ডিত হতে পারে বলে বিএনপির অনেক প্রবীণ ও অভিজ্ঞ নেতার আশঙ্কা।