রাজনীতি ডেস্ক : ‘ফাইল ঠেকিয়ে ঘুষ খাওয়া আর পিস্তল ঠেকিয়ে টাকা আদায় একই কাজ’। কয়েক বছর আগে রাজধানী ঢাকার দেয়ালে দেয়ালে এই ‘চিকা’ শোভা পেত। দেশে ঘুষ-দুর্নীতি-লুটপাট আগের চেয়ে কয়েকগুণ বেড়ে গেলেও এখন এ ধরনের লেখা ঢাকার দেয়ালগুলোতে দেখা যায় না। ‘ঘুষ খাওয়া এবং ঘুষ দেয়া’ সমান অপরাধ; কিন্তু ‘ফাইল সচলে’ বিপদগ্রস্ত মানুষ যে ঘুষ দিতে বাধ্য হয় তা কারো অজানা নয়। আবার যিনি পিস্তল ধরেন তার কথা ভিন্ন; কিন্তু রাস্তায় যিনি পিস্তলের ভয়ে অর্থকড়ি তুলে দিতে বাধ্য হন তাকে কি অপরাধী বলা যায়? বরং মানুষ বিপদগ্রস্ত বুঝতে পেরে উল্টো ভয়ভীতি দেখিয়ে কিছু আদায় করার চেষ্টা অনৈতিকতার নামান্তর।
দেশের রাজনীতিতে জোট মহাজোটের সংস্কৃতি চালু হয় সেই ১৯৫৪ সালের যুক্তফ্রন্ট নির্বাচনের সময়। এরশাদবিরোধী আন্দোলনের সেটা শাখা-প্রশাখা গজায়। ’৯০-পরবর্তী সময়ে জোটের রাজনীতির সংস্কৃতি চর্চার ডালপালা ছড়িয়ে যায়। দেশের মানুষও জোটের রাজনীতিকে ভালোভাবে গ্রহণ করেছে। রাজনীতির যে গতি প্রকৃতি কোনো একটি দলের এককভাবে নির্বাচন করে ক্ষমতায় যাওয়া এখন সুদূর পরাহত। ১৯৯৬ সালের নির্বাচন থেকে এটা দেখা যাচ্ছে। বর্তমানে দেশে মেরুকরণ ও জোটের রাজনীতির জয়জয়কার চলছে। ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগ ১৪ দলীয় জোট, মাঠের বিরোধী দল বিএনপি ২০ দলীয় জোট, জাতীয় সংসদের গৃহপালিত বিরোধী দল জাতীয় পার্টির অর্ধশতাধিক দলের সমন্বয়ে জোট, পাঁচদলীয় যুক্তফ্রন্ট ছাড়াও আরো কয়েকটি জোট রয়েছে। রাজনৈতিক দলগুলো জোটবন্ধ হয়ে কর্মসূচি পালন করছে। জোটের রাজনীতিতে ভোটের হিসেবে গুরুত্বপূর্ণ হলেও কোন দল কত সুসংগঠিত তা অপ্রাসঙ্গিক। কারণ কোন দলের কত ভোটার রয়েছে তার হিসাবের চেয়ে মানুষ দেখেন আওয়ামী লীগ ও বিএনপির সঙ্গে কতগুলো রাজনৈতিক দল রয়েছে। নির্বাচন কমিশনের কোন দলের নিবন্ধন আছে আর কোন দলের নিবন্ধন নাই ভোটাররা সেটারও গুরুত্বপূর্ণ মনে করে না। তবে রাজনীতিতে আশার কথা হলো ক্ষমতায় যাওয়ার জন্যই হোক আর ক্ষমতা দীর্ঘস্থায়ীর জন্যই হোক বড় দলগুলো দেশের ছোট ছোট দলগুলোকে গুরুত্ব দিচ্ছে। আবার দেশে এমন কিছু ছোট দল রয়েছে যে ওই সব দলে বড় বড় নেতা নেতৃত্ব দিচ্ছেন। বি চৌধুরী, ড. কামাল হোসেন, আ স ম রব, কাদের সিদ্দিকী, মাহমুদুর রহমান মান্না, মুজাহিদুল ইসলাম সেলিমের দল ছোট হলেও নেতা হিসেবে তাদের পরিচিতি কী কম?
৬ মাস পর জাতীয় নির্বাচন অথচ রাজনীতির মাঠে মিটিং মিছিল নেই। উত্তেজনা আছে কিন্তু তার প্রকাশ নেই। এক পক্ষ নির্বাচনী প্রচারণা চালাচ্ছে অন্য পক্ষকে মাঠে নামতেই দেয়া হচ্ছে না- এটা স্বাভাবিক ঘটনা নয়। সব দলের অংশগ্রহণে একাদশ জাতীয় নির্বাচন দেখার জন্য জাতিসংঘসহ গোটা বিশ্বের প্রভাবশালী দেশগুলোর দৃষ্টি যখন বাংলাদেশের দিকে; তখন বিএনপির চেয়ারপারসন বেগম খালেদা জিয়া কারাগারে। বিএনপি অভিযোগ করছে তার সুচিকিৎসা হচ্ছে না। বেগম জিয়া কারগারে থাকায় বিএনপি ও ২০ দলীয় জোটের নেতাকর্মীদের হৃদয়ের ভেতর দিয়ে বয়ে যাচ্ছে ঝড়। এ অবস্থায় মিশন-ভিশন যাই বলেন বিএনপির মূল এজেন্ডা বেগম জিয়াকে কারামুক্ত করা। বিএনপির মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর স্পষ্ট বার্তা দিয়েছেন ‘এখন বিএনপির মূল এজেন্ডা বেগম জিয়াকে মুক্ত করা।’ কিছু প্রচার মাধ্যম সরকারের অনুকম্পা পেতে বিএনপির এই মূল এজেন্ডার সঙ্গে নির্বাচনে যাওয়া না যাওয়া গুলিয়ে ফেলে প্রচারণা চালাচ্ছে। বিএনপি খ-বিখ- হওয়া সময়ের ব্যাপার এ প্রচারণা চালছে। কিন্তু বিএনপির বিপদগ্রস্ত নেতারা নেত্রীর মুক্তিকে সর্বাগ্রে প্রাধান্য দিচ্ছেন। বিএনপির নেতৃত্বে যে ২০ দলীয় জোট রয়েছে; তাদের বৈঠকে শরিক দলগুলোর নেতারাও বিএনপির এ এজেন্ডার সঙ্গে একাত্মতা প্রকাশ করেছে। পেশাগত কারণেই ২০ দলীয় জোটের শরিক অধিকাংশ দলের নেতার সঙ্গে চলাফেরা এবং অনেকের সঙ্গে পারিবারিক সম্পর্ক। চলার পথে, আড্ডায় ও আলোচনায় গত দুই মাসে যাদের সঙ্গে কথা হয়েছে, তারাই বলেছেন এই মুহূর্তে বেগম জিয়ার কারামুক্তি সবচেয়ে বেশি গুরুত্বপূর্ণ। জেল থেকে বেগম জিয়া বের হয়ে আসার পর নির্বাচন এবং শরিকদের মধ্যে আসন ভাগাভাগি ইত্যাদি নিয়ে আলোচনা হতে পারে। ২০ দলীয় জোটের ১০টি শরিক দলের নেতার সঙ্গে কথা বললে তারা সবাই অভিন্ন বার্তা দেন। তারা বলেন, ২০ দলীয় জোট নেত্রী বেগম জিয়ার মুক্তিই আমাদের মূল এজেন্ডা। এখনই নির্বাচন এবং আসন ভাগাভাগির সময় নয়। বেগম জিয়া কারাবন্দী এ সুযোগ নিয়ে ক্ষমতাসীনরা মাঠের বিরোধী দল বিএনপির অভ্যন্তরে নেতায় নেতায় এবং ২০ দলীয় জোটে বিরোধ বাধানোর এজেন্ডা বাস্তবায়নে কিছু মিডিয়াকে ব্যবহার করছে। এ অবস্থায় চোখ-কান খোলা রেখে সব শরিক দলকে সতর্ক থাকা অপরিহার্য। এখন সংসদীয় আসনের জন্য বিএনপির প্রতি চাপ দেয়া বা আসন ভাগাভাগি নিয়ে আলোচনার প্রস্তাব দেয়া রাজনৈতিক প্রতিপক্ষের হাতে অস্ত্র তুলে দেয়ার নামান্তর। এমনকি কয়েকজন নেতা বলেছেন আসন ভাগাভাগির চেয়ে বড় কথা বেগম জিয়া কি চান সেটা। তিনি ২০ দলের অভিভাবক। তার প্রতি পুর্ণ আস্থা ও বিশ্বাস রেখেই ২০ দলীয় জোট হয়েছে। নেত্রী যে সিদ্ধান্ত দেবেন সেটাই মেনে নেবো। ২০ দলীয় জোটের শরিক প্রায় সব দলের নেতাই যখন বেগম জিয়ার ওপর সব সিদ্ধান্তের দায়িত্ব তুলে দিয়েছেন; তখন হঠাৎ করে একটি দল আসন্ন নির্বাচন উপলক্ষে আসন ভাগাভাগি নিয়ে উঠেপড়ে লেগেছেন। যা ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগের কাছে ‘মেঘ না চাইতেই বৃষ্টি’র মতো। টিভি টকশোগুলোতে নিত্যদিন যখন আলোচনা হচ্ছে বিএনপিকে ভেঙে ফেলার চেষ্টা হচ্ছে; বিএনপির কিছু নেতাকে দিয়ে নতুন বিএনপি গঠন করে তারাই ধানের শীষ প্রতীক নিয়ে নির্বাচন করবেন; ২০ দলীয় জোটে ভাঙন ধরাতে হবে। নিত্য এ নিয়ে চলছে মিডিয়ায় প্রচার-অপপ্রচার-প্রপাগান্ডা। তখন শরিক দলের এক সমাবেশে এখনই আগামী নির্বাচনের প্রস্তুতির লক্ষ্যে ২০ দলীয় জোটের আসন বণ্ঠনের দাবি তোলা হয়। শুধু তাই নয়, জোট হয়েছে ২০ দলের অথচ শুধু নিবন্ধিত শরিক ৮টি দলের সঙ্গে আলোচনা করে সংসদীয় আসন বণ্টনে বিএনপির প্রতি আহ্বান জানানো হয়। শরিক দলের কয়েকজন নেতার নাম উল্লেখ করে ওই দলটির মহাসচিব বলেন, এই নেতাদের সঙ্গে বসে যার যেখানে নির্বাচন করার মতো প্রার্থী আছে সেটা ক্লিয়ার করে দেন। তাহলে আর কোনো দ্বন্দ্ব থাকবে না। মাঠে আমাদের দলের নেতাদের দ্বন্দ্ব আওয়ামী লীগের সঙ্গে হচ্ছে না, হচ্ছে বিএনপির সঙ্গে। আসন বণ্টন হলে আমাদের চলার পথ সুগম হবে’। শরিকদের প্রতি বিএনপির মহাসচিবের ‘আসুন এই বিপদের সময় সিট বণ্টন নিয়ে কথা না বলি; এখন দেশনেত্রীকে মুক্ত করাই হবে- আমাদের প্রথম দায়িত্ব এবং কর্তব্য। পরে জোটে যারা যোগ্য আছেন তারা অবশ্যই নির্ববাচনে অংশগ্রহণ করবেন’ বক্তব্য তুলে ধরে দলটির নেতা বলেন, ‘বিএনপি যদি সারা দেশে নির্দেশ দিয়ে প্রত্যেক আসনে তিনজন করে প্রার্থী বাছাই করতে পারে তাহলে আমরা অন্তত প্রতিটি আসনে একজন করে প্রার্থী বাছাই করতে পারি’। প্রশ্ন হলো এ ধরনের দাবির বাস্তবতা কতটুকু?
প্রথমেই মন্ত্রিপরিষদের সাবেক সচিব ড. সাদাত হুসাইনের বাংলা ভিশনের টকশোর বক্তব্য তুলে ধরা যাক। ‘জোটের রাজনীতি এবং ৩০টি ইসলামী দল পৃথক জোট গঠন করছে’ সঞ্চালকের এমন প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, জোট-মহাজোট হচ্ছে, হবে। কিন্তু ভোট আওয়ামী লীগ আর বিএনপিই পাবে। যে ছোট দলগুলো নিয়ে জোট হয়েছে ওই দলগুলো এককভাবে নির্বাচনে করলে ১০-২০ ভোটের বেশি পাবে না; মানুষ বিবেচনা করছে কোন দল কতগুলো দল নিয়ে জোট করছে। ইসলামী দলগুলো নিয়ে যতই জোট হোক আলেম ওলামা ও ইসলামী মূল্যবোধে বিশ্বাসীদের ভোট বিএনপি পায়। যেসব ইসলামী দল ও হেফাজত আওয়ামী লীগের সঙ্গে রয়েছে, তাদের ভোট কি কখনো আওয়ামী লীগ পেয়েছে? দেশের ভোটাররা দুই ধারায় বিভক্ত এটা পরিষ্কার’। তবে নির্বাচনে জিতে ছোট দলগুলোকে মূল্যায়ন করার রেওয়াজ চালু হয়ে গেছে। নির্বাচনে ছোট দলের নেতাদের যেমন পার্থী করা হয়েছে; তেমনি অতি ক্ষুদ্র দলের নেতাকেও মন্ত্রিত্ব দেয়ার উদাহরণ আছে।