৫৬ বছরে এমন তুষারঝড় আগে দেখেনি কেউ

নিউইয়র্কসহ উত্তর আমেরিকায় মৃত্যু ৬০, জনজীবন বিপর্যস্ত

ঠিকানা রিপোর্ট : আর্কটিক থেকে ধেয়ে আসা ধ্বংসাত্মক তুষারঝড়ের কবলে পড়ে উত্তর আমেরিকায় এ পর্যন্ত অন্তত ৬০ জনের মৃত্যু হয়েছে। মৃতের সংখ্যা আরো বাড়তে পারে বলে
আশঙ্কা করা হচ্ছে। তুষারঝড় আপাতত থামলেও যুক্তরাষ্ট্রের জর্জিয়া, কেনটাকি, মিসৌরি, মেরিল্যান্ড, নর্থ ক্যারোলিনা, ওকলাহোমা ও নিউইয়র্কসহ ১২টি রাজ্যে জরুরি অবস্থা জারি করা হয়েছে। যুক্তরাষ্ট্রের মিডিয়া এই তুষারঝড়কে ‘বোম্ব সাইক্লোন’ বলে অভিহিত করেছে।
তুষারঝড়ের কারণে বিভিন্ন স্থানে খ্রিস্টান ধর্মাবলম্বীদের বড়দিনের অনুষ্ঠান পণ্ড হয়ে গেছে। ২১ ডিসেম্বর বুধবার থেকে ২৭ ডিসেম্বর মঙ্গলবার পর্যন্ত ১৫ হাজারটিরও বেশি ফ্লাইট বাতিল করা হয়েছে। এক মিলিয়নেরও বেশি আমেরিকান বড়দিনের ছুটিতে ভ্রমণে যেতে পারেননি। তুষারঝড় নিউইয়র্ক থেকে সিয়াটল পর্যন্ত আঘাত হেনেছে। এতে আরো ২১ হাজার ফ্লাইট বাতিল কিংবা বিলম্বিত হওয়ার আশঙ্কা রয়েছে।


ধ্বংসাত্মক এই তুষারঝড়ে যুক্তরাষ্ট্রেই মারা গেছেন ৪৯ জন। তাদের মধ্যে নিউইয়র্ক রাজ্যের বাফেলোতে মারা গেছেন ২৮ জন।
এদিকে যুক্তরাষ্ট্রে গত ৫০ বছরের রেকর্ড ভেঙেছে শৈতপ্রবাহ। বিভিন্ন অঙ্গরাজ্যের নাগরিকরা গণমাধ্যমকর্মীদের বলেছেন, গত ৫৬ বছরেও এমন ঠাণ্ডা আর তুষারঝড় দেখেননি তারা। চলতি বছরের শুরু থেকেই এ ঠাণ্ডার কবলে পড়ে যুক্তরাষ্ট্রের মধ্যপশ্চিমাঞ্চল। একেবারে হাড় হিম করা ঠাণ্ডা। আর্কটিক ও অ্যান্টার্কটিকা মহাদেশে যেমন ঠাণ্ডা তেমনি ঠান্ডা পড়তে শুরু করেছে দেশটিতে। অ্যান্টার্কটিকার মতোই জমে যাচ্ছে নদী-নালা-সাগর।
যুক্তরাষ্ট্রের জাতীয় আবহাওয়া দপ্তর জানিয়েছে, সর্বত্র হিমবাহের তাপমাত্রা বিরাজ করছে। দেশটিতে উদ্ভূত এমন পরিস্থিতি ইতিহাসে বিরল। তা অতীতের সব শীতের রেকর্ড ভেঙে দিতে পারে। রাস্তায় রাস্তায় পুরো বরফের আস্তরণ জমেছে। কোথাও কোথাও বরফের উচ্চতা ৮ থেকে ১০ ফুট। দেশটিতে যোগাযোগ ও পরিবহন ব্যবস্থা বিপর্যস্ত হয়ে পড়েছে। প্রায় ২ লাখ মানুষ বিদ্যুৎহীনভাবে বাস করছেন।


নিউইয়র্কের এরি কাউন্টি অঞ্চলের নির্বাহী মার্ক পোলোনকারজ ২৫ ডিসেম্বর রোববার এক সংবাদ সম্মেলনে বলেন, ‘উদ্ধারকাজে নিয়োজিত উদ্ধারকর্মীদের গাড়িও বরফে আটকে পড়ছে। উদ্ধারকারী দলকে উদ্ধারকর্মীদেরই উদ্ধার করতে হয়েছে। এটা সত্যিই খুব ভয়ঙ্কর ব্যাপার।’ তিনি জানান, এরি কাউন্টিতে বেশ কয়েকজনকে গাড়িতে এবং রাস্তার বরফের স্তূপে মৃত অবস্থায় পাওয়া গেছে।
বাফেলো অঞ্চলের পুলিশের দেওয়া এক বিবৃতিতেও এমন লোমহর্ষক মৃত্যুর সংবাদ পাওয়া যায়। বলা হয়, মানুষ রাস্তায় ও গাড়িতে মরে পড়েছিল। বাড়িতেও অবস্থা শোচনীয় বেশির ভাগ মানুষের।


যুক্তরাষ্ট্রের ওয়াইমিং রাজ্যের কিছু পার্বত্য অঞ্চলে তাপমাত্রা মাইনাস ৫৭ ডিগ্রি ফারেনহাইটে নেমেছিল। এ ছাড়া মিনেসোটা রাজ্যের তাপমাত্রা হিমাঙ্কের ৩৮ ডিগ্রি নিচে ছিল। আর ডালাসের তাপমাত্রা ছিল মাইনাস ১৩ ডিগ্রি ফারেনহাইট।
ঝড়ের কারণে টেক্সাসের ৮০ হাজারের বেশি গ্রাহক বিদ্যুৎহীন হয়ে পড়ে। মিসৌরি, আরকানসাস, লুইসিয়ানা, মিসিসিপি এবং টেনেসির হাজার হাজার গ্রাহকও বিদ্যুৎবিচ্ছিন্ন হয়ে পড়েছে।
যুক্তরাষ্ট্রের ১২টি রাজ্যের গভর্নররা ‘স্নোম্যাগডন’ এর জন্য জরুরি অবস্থা ঘোষণা করেছেন।
কলোরাডো থেকে কানেকটিকাট, কেনটাকি থেকে মেরিল্যান্ড, মিসৌরি, উত্তর ক্যারোলিনা এবং ওকলাহোমা পর্যন্ত অনেক রাজ্যে ন্যাশনাল গার্ড মোতায়েন করা হয়েছে।
ঝড়ে সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে নিউইয়র্কের বাফেলো। গত ৪৫ বছরের মধ্যে এটিই সবচেয়ে মারাত্মক তাণ্ডব। ভারি বরফের স্তরে চাপা পড়ে শহর, আর গাড়িতে আটকা পড়েন অনেকে। এর মধ্যে ২৮ জনের মৃত্যু হয়েছে সেখানে।
নিউইয়র্ক রাজ্যের দ্বিতীয় বৃহত্তম এই শহরটিতে ১৯৭৭ সালের পর আঘাত হানা সবচেয়ে ভয়াবহ তুষারঝড় এটি।
নিউইয়র্কের গভর্নর ক্যাথি হোকুল বলেছেন, ‘এবারের ঝড় বাফেলোর ইতিহাসে সবচেয়ে ধ্বংসাত্মক হিসেবে লেখা থাকবে।’ ক্যাথি হোকুল এরি কাউন্টি ও বাফেলো শহরে ন্যাশনাল গার্ড সদস্যদের মোতায়েন করেছেন।
এছাড়াও ভারমন্ট, ওহাইও, মিসৌরি, উইসকনসিন, ক্যানসাস ও কলোরাডোতেও প্রাণহানি ঘটার সংবাদ পাওয়া গিয়েছে।
আর্কটিক থেকে ধেয়ে আসা শীতকালীন ঝড়টি প্রাণঘাতী রূপ নেয় ২৩ ডিসেম্বর শুক্রবার থেকে। পশ্চিম যুক্তরাষ্ট্রের মন্টানা অঙ্গরাজ্য তুষারপাতে সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে, সেখানে তাপমাত্রা মাইনাস ৪৫ ডিগ্রি সেলসিয়াসে নেমে গেছে। মিনেসোটা, আইওয়া, উইসকনসিন এবং মিশিগানেও প্রায় একই অবস্থা।
দক্ষিণ ফ্লোরিডায় তাপমাত্রা এতটাই নেমে গেছে যে ইগুয়ানাও (বড় আকারের গিরগিটিসদৃশ প্রাণী) ঠাণ্ডায় জমে যাচ্ছে, আর গাছ থেকে নেমে আসছে। দেশটির পশ্চিমাঞ্চলীয় রাজ্য মন্টানায় তাপমাত্রা মাইনাস ৪৫ ডিগ্রি সেলসিয়াসে নেমেছে।
পশ্চিম কানাডায় এরই মধ্যে তাপমাত্রা পৌঁছে গেছে হিমাঙ্কের ৫৩ ডিগ্রি নিচে। কানাডার পশ্চিমাঞ্চলীয় প্রদেশ ব্রিটিশ কলাম্বিয়ার মেরিট শহরের কাছে বরফে আচ্ছাদিত একটি সড়কে বাস উল্টে মৃত্যু হয়েছে আরও ৪ জনের। এবারের ঝড় কানাডা থেকে শুরু করে যুক্তরাষ্ট্রের রিও গ্রান্ডে নদী পর্যন্ত তাণ্ডব চালায়।
কানাডার অন্টারিও ও কুইবেক প্রদেশের ওপর দিয়ে ঝড়ের ঝাপটা সবচেয়ে বেশি বয়ে যায়। ২৫ ডিসেম্বর রোববার পর্যন্ত সেখানে প্রায় এক লাখ ২০ হাজার মানুষ বিদ্যুৎহীন হয়ে পড়ে।
আবহাওয়াবিদরা জানিয়েছেন, এই পরিস্থিতিতে যতটা সম্ভব বাড়ির ভেতর থাকতে হবে। তীব্র ঠাণ্ডায় বাইরে বের হলে ফ্রস্টবাইটের শিকার কিংবা প্রাণহানির শঙ্কাও রয়েছে।