সুরমা জাহিদ :
ললিতা নমশূদ্র
আমাকে যখন ধরে নিয়ে যায়, তখন আমি মিলিটারিদের সঙ্গে খুব জোরাজুরি করি। তখন কেমন করে যেন আমার ডান হাতটা ভেঙে যায়। তখন তো আর এসব বলতে পারব না যে কখন কীভাবে হাত ভেঙেছে। তখন মাথায় একটাই চিন্তা ছিল, কীভাবে মান-ইজ্জত রক্ষা করা যায়। মরতে হলে মরব, তবু মান দেব না।
তারপর হাত কীভাবে, কেমন করে ভালো হয়েছে, তা তো আর বলতে পারব না। আমার হাত ভাঙার ব্যথার চেয়ে আরও বেশি ব্যথা ছিল শত শত মিলিটারির নির্যাতনের ব্যথা। যতক্ষণ মিলিটারিরা আমার ওপর নির্যাতন চালাত, ততক্ষণই আমার হাত ভাঙার চেয়ে বেশি ব্যথা পেতাম। শত শত বার নির্যাতনের শিকার হয়েছি। এই ছোট্ট শরীর কীভাবে যে এত নির্যাতন সহ্য করেছে, তা আমি জানি না, আমার শরীরই জানে। এখনো সেই দিনগুলোর কথা মনে হলে শরীর শিউরে ওঠে, ভয়ে থরথর করে কাঁপতে থাকি। পা থেকে মাথা পর্যন্ত সমস্ত শরীরে তারা আঘাত করেছে। কী বলি আর এসব লজ্জা-শরমের কথা, মুখ দিয়ে আসে না। কিন্তু মনের ভেতর তো কথাগুলো দৌড়াদৌড়ি করে। তাদের নির্যাতনের কারণে সারা শরীর পেকে টসটসা হয়ে গিয়েছিল। একটু ধরলেই-ছুঁলেই মনে হতো অনেক বড় আঘাত করছে। দল বেঁধে শত শত মিলিটারি মাসের পর মাস নির্যাতন করেছে। এগুলো কি আর বলা যায়? এগুলো মনে হলে এখনো মাথায় রক্ত উঠে যায়।
শহর বানু
যুদ্ধের মাঝামাঝি সময়। পাকিস্তানিরা খুব বেশি উৎপাত শুরু করে দিয়েছে। আমাদেরও ভয় বেড়ে গিয়েছে। মাঝে একদিন গ্রামে মিলিটারিরা হানা দিয়েছে। অনেকের সঙ্গে আমিও পালাচ্ছি। আসলে পাকিস্তানিরা কখন কোন দিক দিয়ে আসে, তা তো আর আমরা বুঝতাম না বা জানতাম না। তাই যে যে দিকে থাকত, সেদিকেই দৌড়াত। আমি যাচ্ছিলাম বাড়ির উত্তর দিকে। বাড়ি থেকে বাইর হয়ে সামান্য কিছুদূর যাওয়ার পরই আমার পেছন দিয়ে চলে আসে পাকিস্তানিরা। তারা আমার পেছন পেছন দৌড়াচ্ছে। তাদের সঙ্গে তো আর আমি পারি না। তাই আমার পেছন থেকে পাকিস্তানিরা আমাকে ধরে ফেলেছে। তারা যখন ধরে ফেলেছে, তখন আমি ভয়ে কাঁপছি। তখন মনে হলো, ভয় পেলে তো চলবে না। আমার মান তো আমাকেই বাঁচাতে হবে। তাই চেষ্টা করতে হবে, বাঁচি আর মরি।
পাকিস্তানিরা আমাকে ধরে ফেলেছে। আমি তাদের হাত থেকে ছোটার জন্য আমার শরীরের সমস্ত শক্তি দিয়ে চেষ্টা করছি। টানাটানি, ধস্তাধস্তি হয়েছে অল্প কিছু সময়। এতগুলো বড় বড় শক্তিশালী পুরুষমানুষ, তাদের সঙ্গে কি আমি পারি? একসময় তাদের মাঝ থেকে একজন আমাকে তাদের হাতে থাকা বন্দুকের বাঁট দিয়ে জোরে মাথায় আঘাত করে। মাথা ফেটে রক্ত পড়ছে। তখন আমি মাটিতে পড়ে যাই। মাটিতে পড়ে যাওয়ায় হাত অনেকটা কেটে যায়। মাথা ফাটা, আর হাত কেটে যাওয়ার দাগ এখনো আছে, দেখেন। আমার চারপাশটা রক্তে লাল হয়ে গিয়েছে। এ অবস্থাতেই পাকিস্তানিরা আমাকে তুলে নিয়ে যায়।
প্রথমে আমাকে নিয়ে যায় আমাদের গ্রামে চেয়ারম্যানের বাড়িতে। সেই বাড়িতে কোনো মেয়েমানুষ ছিল না। সেখানে সারা রাতই আমাকে অনেক নির্যাতন করে। তারা যখন নির্যাতন করছে, তখন কয়েকবার আমি বেহুঁশ হয়ে গিয়েছিলাম। তার পরও একটুখানির জন্য তারা বিরতি দেয়নি। এতগুলো বড় বড় শক্তিশালী মানুষ। একজনের পর আরেকজন আসছে আর নির্যাতন করছে। তাদের মাঝ থেকে একজন আমার হাত আর মাথা বেঁধে দিয়েছিল এবং ওষুধ দিয়েছিল।
সারা রাত কেটেছে বিরতিহীনভাবে, নির্যাতনের মাঝ দিয়ে। তার পরও তারা ক্ষান্ত হয়নি। সকালে গাড়িতে তুলে নিয়ে যায় রাধানগর নূরু বস্তিতে, যে ক্যাম্প না বাংকার করেছিল সেইখানে। ওখানেও সারা রাত নির্যাতন করত অনেকজন। দিনের বেলায় আমাকে বেঁধে রেখে দিত। এভাবেই কেটেছে চার-পাঁচ মাস বন্দিজীবন। কত শত বার যে নির্যাতন করেছে, তা বলে শেষ করা যাবে না। আর কতজন যে নির্যাতন করেছে, তারও হিসাব নেই।
বেশির ভাগ দিনই এক বেলা খাবার দিত। শুকনা রুটি আর ভাজি। মাঝে মাঝে দু’বেলা রুটি দিত। গোসল করার কোনো সুযোগ ছিল না। মাঝে মাঝে মনে হতো, মরে যাই। কিন্তু তারও কোনো সুযোগ ছিল না। আমাদেরকে কোনো কাপড় পরতে দিত না। অনেক কষ্ট দিয়ে নির্যাতন করেছে, যা সহ্য করার মতো নয়। আমাদের যা ইচ্ছা তা-ই হোক, তাতে তাদের কী। বন্দী ছিলাম বলে মনে হয় আল্লাহ আমাদেরকে শক্তি দিয়েছিল। যে পরিমাণে এত বিশ্রীভাবে নির্যাতন করেছে, এতে বেঁচে থাকার কথা নয়।
আলিফজান বিবি
মুক্তিযুদ্ধের সময় আমার বয়স ছিল খুব বেশি হলে ১৫ বছর। বিয়ে হয়নি। বিয়ের কথাবার্তা চলছে। আর আমার পছন্দের একজন ছিল। যুদ্ধ শুরুর দিকেই সেই ছেলের সঙ্গে আমার একদিন কথা হলোÑনাম জয়নাল। দেখতে-শুনতে ভালো। বাড়িঘর, জমিজমা, কাপড়ের ব্যবসা সবই আছে তাদের। জয়নালই ব্যবসা দেখাশোনা করত। যেদিন শেষ দেখা হলো, সেদিন জয়নাল আমাকে বলতে এসেছিল, সে যুদ্ধে যাবে, আমি যেন তার জন্য অপেক্ষা করি। যদি যুদ্ধ থেকে বেঁচে ফিরে আসে, তবে বিয়ে হবে। আর যদি মারা যায়, তবে যেন অন্য জায়গায় বিয়ে করি। এসব কথা বলে সে আমার কাছ থেকে বিদায় নিয়ে চলে যায়। দেখতে দেখতে সমস্ত এলাকায় যুদ্ধ ছড়িয়ে যায়। একসময় মিলিটারিরা ক্যাম্প করে পুরো গ্রাম দখল করে নিয়েছে। শুরু হলো নারী নির্যাতন। যুদ্ধের প্রথম দিকেই আমি ধরা পড়ি। আমাকে ধরে প্রথমে একটা স্কুলঘরে নিয়ে যায়। সেই স্কুলঘরে আমাকে আট-দশ মিনিট রেখে মিলিটারিরা তারপর সরাসরি ক্যাম্পে নিয়ে গিয়েছে। সুনামগঞ্জ জেলখানা না কী যেন বলে, সেইখানে। সেই জায়গাটায় অনেক বড় জায়গাজুড়ে উঁচু দেয়াল দেওয়া ছিল। ভেতরে অনেক জায়গা, অনেক ঘর। অনেক মিলিটারির আনাগোনা ছিল সব সময়। আমাকে নিয়ে প্রথমে একটা ঘরের ভেতরে আটকে রাখে।
তারপর রাত থেকে শুরু হলো ওইসব কাজ। সারা রাত চলে আমার ওপর নির্যাতন, ভোর পর্যন্ত। সারা রাত একজনের পর আরেকজন, এমন করে করে কমপক্ষে ১৪-১৫ জন মিলিটারি আমার ইজ্জতহানি করে। সারা রাতই একবার বেহুঁশ হয়েছি আবার হুঁশ এসেছে। এমন করে রাত শেষ হয়ে যখন ভোর হয়েছে, তখন তারা শান্ত হলো। তারপর ঘরের দরজা খোলার পর, দু-তিনজন এসে আমাকে টেনে টেনে এক ঘর থেকে অন্য ঘরে নিয়ে যায়। তখন সমস্ত রাস্তা রক্তে ভেসে গিয়েছে। যখন ঘরের ভেতরে ঢোকাবে, তখন একজন লোক একা একাই বলছে, ‘হে আল্লাহ, আর কত কষ্ট দেবে আমাদের ওপর, তুমি কি কিছুই দেখো না। তোমার গজব নাজিল করো তাদের ওপর।’ এসব কথা আমার কানে এসেছে। আমি তখন ঘাড় ঘুরিয়ে তার দিকে তাকিয়ে দেখি, একজন মধ্যবয়সী পুরুষ, বাঙালি। আমি যখন তার দিকে তাকালাম, সে আমার দিকে একটু হাত বাড়িয়ে আবার হাতটা পেছনের দিকে নিয়ে গিয়েছে। বুঝতে পারলাম, সে-ও ভয়ে আছে। আরও কিছুদূর নিয়ে যাওয়ার পর আবার ফিরে তাকালাম। দেখি, সে হাত দিয়ে চোখের পানি মুছছে। আমাকে তারা যে ঘরে নিয়ে যায়, সেই ঘরের ভেতরে কোনো মানুষ নেই, আমি একা। রাতে যখন আমাকে নির্যাতন করে, তখনই আমার পরনের সব কাপড় খুলে ফেলে। তারপর আমাকে আর কাপড় দেয়নি। ওই ঘরের দরজা বাইর থেকে আটকে দেয়।
আমি পড়ে আছি একা একা ঘরে। ব্যথায় ছটফট করি। চাকা চাকা রক্ত যাচ্ছে। যখন সময় ১২টা/১টা বাজে, তখন দরজায় শব্দ শুনতে পেলাম। চোখ খুলে দেখি সেই লোকটি, যে লোকটির সঙ্গে দেখা হয়েছিল সকালে। হাতে একটা থালা আর গ্লাস। থালায় দুইটা বড় বড় রুটি, সঙ্গে কিছু একটা ছিল, কী ছিল মনে নেই। আর গ্লাসভর্তি চা। খাবার খেতে চাইনি। তখন লোকটি বলছে, ‘বোন খেয়ে নাও। কত দিন যে এখানে এভাবে আটকা থাকতে হবে, তা তো কেউ জানে না। একটা সময় হয়তো খাবারও পাবে না।’ অনেক সুন্দর ও আদর করে কথাগুলো বলছে। আমি খাবার খেলাম। যখন সে চলে যায়, তখন আমি তার কাছে একটা কাপড় চেয়েছি পরার জন্য। এমন সময় কিসের যেন শব্দ হয়। আমি বুঝতে পারিনি, সে বুঝতে পারে। খুব দ্রুত চলে যায়। যাওয়ার সময় ইশারায় কী যেন একটা বলেছে, তা আমি বুঝতে পারিনি।
প্রমীলা দাস
যুদ্ধের মাঝামাঝি সময় চলে এসেছে। এর আগে যখনই এলাকায় পাঞ্জাবিরা এসে আমাদের গ্রাম-বাজার দখল করে নিয়েছে, তখন থেকেই আমরা পালিয়ে থেকে থেকে জান-মান বাঁচিয়ে আসছি। কিন্তু একটা সময় এল, পালিয়ে থেকেও রক্ষা পেলাম না।
একদিন আমার বাবা আমাদের বাড়িতে এলেন। বাবা আসার পর আমার শ্বশুর বাবাকে যেতে দিলেন না। বাবা থেকে গেলেন। একদিন দুপুরে বাবা আর শ্বশুর খেতে বসেছেন। তখন বাবা কেন যেন বারবার বলছিলেন, এটাই যদি হয় শেষ বেড়ানো…এমন সব কী কী কথা যেন। ওইদিন সন্ধ্যার সময় বাবা আর শ্বশুরসহ আরও কয়েকজন বাড়ির সামনে বসে গল্প করছেন। জল-খাবার শেষ। এবার চা খাওয়ার পালা। আমি যতবারই তাদের জন্য এটা-সেটা নিয়ে যাচ্ছি, ততবারই বাবা বলছেন, মা সাবধান, সাবধান। আমি তাদের সামনে চা নিয়ে গিয়েছি। ঠিক এমন সময় কোন দিক দিয়ে যেন কয়েকজন পাঞ্জাবি এসে সরাসরি আমার হাতটা ধরে ফেলে। আমার হাত ধরার সঙ্গে সঙ্গে বাবা আমার আরেক হাত ধরে টানছেন। এক হাত ধরে টানছে পাঞ্জাবিরা, অন্য হাত ধরে টানছেন আমার বাবা। এভাবে কিছুক্ষণ টানাটানি করা দেখে পাশ থেকে আরেকজন পাঞ্জাবি এসে তার হাতে থাকা বন্দুক দিয়ে বাবার মাথায় আঘাত করে। সঙ্গে সঙ্গে বাবা মাটিতে পড়ে যান। বাবার মাথা ফেটে রক্ত বের হচ্ছে। তারপর পাঞ্জাবিরা বাবাকে টেনে টেনে নিয়ে যায়। অল্প কিছুদূর নেওয়ার পর একটা গুলির শব্দ শুনতে পেলাম। গুলির শব্দ শুনে মনে হলো, গুলিটা বাবাকে করেছে। এ কথা মনে আসার সঙ্গে সঙ্গে আমার সমস্ত শক্তি দিয়ে আমি আমার হাতটা পাঞ্জাবির হাত থেকে ছুটিয়ে নিয়ে এক দৌড় দিয়ে চলে যাই বাবার কাছে। দেখি, সত্যি সত্যিই আমার বাবার বুকে গুলি করেছে। বাবার চারপাশে কেউ নেই। রক্তে পুরো জায়গাটা লাল হয়ে গিয়েছে। আমি দৌড়ে গিয়ে বাবার ওপর পড়ি। তখন আবার পাঞ্জাবিরা আমাকে টেনে নিয়ে আসে। যতদূর দেখা গিয়েছিল, বাবার শরীরটা পড়ে আছে, একটুও নড়াচড়া নেই।
তার পরের কথা আমি জানি না। তবে বাবার আমার হাত ধরাটা, বাবার মাথায় আঘাত করা, বুকে গুলি করাÑসব আমার চোখে এখনো ভাসে। আর যখন এসব কথা মনে করি, তখনই মাথা ঠিক রাখতে পারি না। দুনিয়ার সবকিছু এলোমেলো হয়ে যায়।
সেদিন ধরে নিয়ে গিয়ে যে নির্যাতন শুরু করেছে, তা শেষ করেছে যেদিন তারা পরাজিত হয়ে এলাকা ছেড়ে চলে গিয়েছিল। যখন দেশ স্বাধীন হলো, পাঞ্জাবিরা পালিয়ে চলে গিয়েছে, তখন মুক্তিবাহিনী এসে আমাকে মুক্ত করে। মুক্ত হয়ে প্রথমে আমি স্বামীর বাড়িতে যাই। গিয়ে দেখি, বাড়িতে কেউ নেই। আশপাশের লোকজনকে জিজ্ঞাসা করি, কেউ তাদের কোনো খোঁজখবর জানে কি না। কেউ একজন জানালেন, তারা সবাই ভারত চলে গিয়েছে। আমি ফিরে যাই মায়ের কাছে। একসময় লোকমুখে জানতে পারি, তারা দেশে ফিরে এসেছে। তখন আমি আবার স্বামীর বাড়িতে ফিরে যাই। আমার ফিরে যাওয়াটা তারা সহজে মেনে নিতে চায়নি। তারা অনেক রকমের অজুহাত আমাকে দেখিয়েছিল। শেষমেশ আর ফিরিয়ে দিতে পারেনি।
আফিয়া বেগম
যুদ্ধ শুরুর কয়েক মাস পরের কথা। সারাক্ষণ কত আর পালিয়ে থাকা যায়। মা তো সব সময়ই আমাকে পাহারা দিয়ে রাখতেন। তার পরও শেষ রক্ষা হয়নি। খুব সম্ভবত মে মাস। সকালবেলা, সবাই নাশতা খাব। এমন সময় মিলিটারিরা চলে আসে। সেদিন আমি পালিয়ে গিয়েছিলাম। তার কয়েক দিন পরের কথা। আমি পুকুরে থালা-বাটি পরিষ্কার করছি। এমন সময় একদল মিলিটারি এসে আমাকে ধরে নিয়ে যায়। প্রথমে নিয়ে যায় আমাদের বাড়ির পাশের ক্যাম্পে। কিছুক্ষণ পর গাড়িতে করে অন্য ক্যাম্পে নিয়ে যায়। তার পরের কথা কী আর বলব। সারা দিন একটা ঘরের ভেতরে আটকে রেখে সারা রাত নির্যাতন করত। এভাবেই কাটতে থাকে দিন। দিন দিন আমি অসুস্থ হয়ে পড়ছি। সারা দিনে একবার খাবার দিত। তা-ও আটার রুটি আর ভাজি। মাঝে মাঝে মাংসও দিয়েছে। কিন্তু রুটি একবারই দিত। এই কয়েক মাসের মধ্যে একদিন, একবারও ভাত দেয়নি, দেয়নি গোসল করতে। সারা দিন একটা ঘরের ভেতরে আটকে রাখত। নেই কোনো আলো-বাতাস। কখন দিন হতো, কখন রাত হতো, কিছুই টের পেতাম না। কখন রাত হয়েছে, তা বুঝতে পারতাম। কারণ রাত হলেই তো চলত নির্যাতন আর নির্যাতন।
রাতে নির্যাতন আর দিনে আটক থাকতে থাকতে একসময় ভুলেই গিয়েছিলাম আমার নাম কী। ক্যাম্পে কেউ তো আমাকে নাম ধরে ডাকত না। ভুলেই গিয়েছিলাম এই ক্যাম্পের বাইরে যে এত সুন্দর একটা পৃথিবী আছে। ভুলেই গিয়েছিলাম আমার মা-বাবা, আত্মীয়স্বজন, পাড়া-প্রতিবেশী আছে। শেষের দিকে তো দিনও শেষ হতো না, রাত কখনো পোহাত না। একেকটা রাত মনে হতো একেকটা বছর। একসময় মনে হয়েছে, অন্যদের মতো কষ্ট পেয়ে পেয়ে তিলে তিলে মারা যাব। তখন মনে হতো, আমি মরে গেলেও তো কেউ জানবে না আমি মরে গিয়েছি, কেউ তো আমার লাশ গোসল দিতে আসবে না, জানাজা হবে না, কাফন পরিয়ে কবর দেবে না। এমনকি আমার জন্য কেউ কান্নাও করবে না। কেমন অদ্ভুত মৃত্যু হবে আমার।
মাঝে মাঝে যখন বাইর থেকে মিলিটারির বড় অফিসার আসত, তারা বোতল খেয়ে খেয়ে নির্যাতন করত। তখন এত বেশি কষ্ট হতো, প্রতিটি মুহূর্তেই মনে হতো, এই বুঝি জানটা বাইর হয়ে যাচ্ছে বা এখনই যাবে, এমন কষ্ট হতো।
দেশ স্বাধীন হলে মুক্তিবাহিনী আমাকে উদ্ধার করে। যখন আমাদেরকে মুক্ত করছিল, তখন আমি আধমরা, স্বাভাবিক ছিলাম না। মনে করতে পারি না, আমি কীভাবে বাড়িতে এসেছি, নাকি কেউ আমাকে নিয়ে এসেছে। তবে এটা মনে পড়ে, মা-বাবা আমাকে জড়িয়ে ধরে অনেক কান্নাকাটি করেছিলেন। তখন নাকি আমি বলেছিলাম, তোমরা কেন কান্না করো, কী হয়েছে তোমাদের। পরে মায়ের কাছে শুনেছি, যখন আমাদেরকে মুক্ত করে দিয়েছিল, তখন আমি নাকি ওই ঘরের ভেতরে বসে ছিলাম। তারা আমার সঙ্গে অনেক কথা বলার পর বিড়বিড় করে আমাদের বাড়ির ঠিকানা বলি। তখন তারা আমাকে বাড়িতে দিয়ে যায়। অনেক দিন পর্যন্ত আমি কাউকে চিনতাম না, কারো সঙ্গে কোনো কথা বলতাম না। ঘরের এক কোনায় বসে থাকতাম। তখন বাবা-মা কবিরাজ এনে অনেক দিন চিকিৎসা করানোর পর আমি আস্তে আস্তে ভালো হই।
লেখক : প্রাবন্ধিক ও গবেষক