ঠিকানা রিপোর্ট: আগামী ৮ মার্চ আন্তর্জাতিক নারী দিবস। গোটা বিশ্বব্যাপী নারীরা অধিকার আদায়ের লক্ষ্যে ও যথাযথ সম্মান লাভের জন্য এই দিনের তাপর্য তুলে ধরে বিভিন্ন অনুষ্ঠানের আয়োজন করছে। নিউইয়র্ক ও বাংলাদেশেও যথাযোগ্য মর্যাদায় দিবসটি পালনের জন্য উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে। রাষ্ট্রপতি এডভোকেট আব্দুল হামিদ, প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা, বিরোধি দলের নেতা, নারী ও শিশু বিষয়ক মন্ত্রণালয়ের মন্ত্রী এই দিবস উপলক্ষ্যে বানী দিবেন। দিবসটির তাৎপর্য্য তুলে ধরে মন্ত্রণালয় ও মহিলা বিষয়ক অধিদপ্তরের উদ্যোগে পালিত হবে নানা অনুষ্ঠান। এছাড়াও নারী সংগঠনগুলো বিভিন্ন অনুষ্ঠানের আয়োজন করেছে। বাংলাদেশ বেতার, বাংলাদেশ টেলিভিশন ও অন্যান্য বেসরকারী টেলিভিশনে দিবসটির তাৎপর্য্য তুলে ধরে বিভিন্ন অনুষ্ঠান প্রচার করার পাশাপাশি নাটকও প্রদর্শিত হবে। সংবাদপত্রের মধ্যে একাধিক সংবাদপত্র ক্রোড়পত্র প্রকাশ করবে। এছাড়াও বিভিন্ন পর্যায়ে এই দিবসের তাৎপর্য তুলে ধরে নানা অনুষ্ঠানের আয়োজন করছে।
নিউইয়র্কে নারী দিবসের তাৎপর্য তুলে ধরে একাধিক সংগঠন বিভিন্ন অনুষ্ঠানের আয়োজন করছে। এই সব অনুষ্ঠানের মধ্যে সামাজিক ও সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান রয়েছে। বিশ্বের বিভিন্ন দেশেও এই দিবসকে কেন্দ্র করে বিভিন্ন অনুষ্ঠানের আয়োজন করছে।
জানা গেছে, নিউইয়র্কের সেলাই কারখানার নারী শ্রমিকদের আন্দোলন থেকে ১৮৫৭ সালে ঐতিহাসিক ৮ মার্চের উদ্ভব। ওই সময়ে নিউইয়র্কেও বিভিন্ন বস্ত্র কারখানায় নারী শ্রমিকরা কাজ করতো। কিন্তু তারা দিনে ১৫ ঘন্টার বেশি কাজ করলেও তাদেরকে উপযুক্ত পারিশ্রমিক দেওয়া হতো না। নারীরা কাজের জন্য সুঁচ, সুতা, বিদ্যুৎসহ অন্যান্য আনুষঙ্গিক যেসব জিনিসপত্র ব্যবহার করত মালিকরা সেই সব জিনিসের মূল্য তাদের বেতন থেকে কেটে রাখতো। এছাড়া কখনো দেরী কওে অফিসে যাওয়া, অফিসে এসে টয়লেট ব্যবহারের সময় বেশি সময় নিলে কিংবা কাজের ফাঁকে বেশি বিরতি নিলে তাদের কাছ থেকে জরিমানা আদায় করা হতো। এই অবস্থার পরিপ্রেক্ষিতে ১৮৫৭ সালের ৮ মার্চ নারীরা তাদেও অধিকার আদায়ের জন্য আন্দোলনে নামে। মালিকদের এই সব অমানবিক শোসনের বিরুদ্ধে সেলাই কারখানার মালিকরা উপযুক্ত বেতন, কাজের পরিবেশের উন্নয়ন, দশ ঘন্টা কাজ করার দাবিতে আন্দোলন করতে থাকে। আন্দোলন চলাকালে পুলিশ নারী শ্রমিকদেও মিছিলের উপর গুলি চালায়। গুলিতে অনেক নারী আহত হন। গ্রেফতার করা হয় উল্লেখযেগ্য সংখ্যক নারী শ্রমিককে। ফলে ওই আন্দোলন জোরালো হয়ে উঠে। পরবর্তী সময়ে নারীর ভোটাধিকারের বিষয়টিও আন্দোলনকারীদের সামনে আসে।
ঊনবিংশ শতাব্দিতে আন্তর্জাতিক শ্রমিক আন্দোলন, সর্বহারা শ্রেণির মুক্তি আন্দোলন দানা বেঁধে উঠার পাশাপাশি বিভিন্ন দেশে শ্রমজীবী নারীদের অধিকার ও দাবি-দাওয়ার জন্য আন্দোলনের সূত্রপাত ঘটে। সমাজতান্ত্রিক আন্দোলনে থাকা নারীরা এই সব আন্দোলনে গুরুত্বপূর্ণ ভ‚মিকা পালন করেন। জার্মান কমিউনিস্ট আন্দোলনের নেত্রী ক্লারা জেটকিন এদের মধ্যে অন্যতম ছিলেন।
ক্লারা জেটকিন ১৮৭৮ সাল থেকে জার্মানিতে তিনি নারীদের উপর শোষণ ও নিপীড়নের কারণ, তার তত্ত¡গত ভিত্তি নির্মাণ ও শ্রমিকদেও মুক্তি আন্দোলন এবং নারী আন্দোলনে গুরুত্বপূর্ণ ভ‚মিকা রাখেন। ফ্রেডরিক এঙ্গেলস, অগাস্ট বেবেল, মার্কসের কন্যা লারা লাফার্গ, কার্ল লিবনেখ, রোজা লুক্সেমবার্গসহ বহু বিশ্ব নেতৃত্বের সাথে তার গভীর হৃদ্যতা ছিল। ক্লারা জেটকিন ১৮৮৯ সালে প্যারিসে ফ্রেডরিখ এঙ্গেলেসের নেতৃত্বে অনুষ্ঠিত আন্তর্জাতিক শ্রমিক সম্মেলনে নারী-পুরুষের সমানাধিকারের বিষয়টি সামনে আনেন তার বক্তৃতায়। তার সেই বক্তৃতা বিশ্বের বিভিন্ন দেশের নারীদের মধ্যে আলোড়ন সৃষ্টি করে। এরই ধারাবাহিকতায় ১৯০৮ সালের ৮ মার্চ আমেরিকার নিউইয়র্কে শ্রমঘন্টা কমানো, মজুরি বৃদ্ধিতে ও ভোটাধিকারের দাবিতে পনের হাজার নারী ও অভিবাসী শ্রমিক মিছিল ও সমাবেশ করে।
এই সমাবেশ বিভিন্ন দেশের সমাজতান্ত্রিক নারী আন্দোলনকে অনুপ্রাণিত করে। ওই দিবসটি স্মরণ করে সোসালিস্ট পার্টি অব আমেরিকা ১৯০৯ সালের ২৮ ফেব্রুয়ারি আমেরিকাব্যাপী জাতীয় নারী দিবস পালনের ঘোষণা দেয়। ওই বছরেই নভেম্বর মাসে ট্রায়াঙ্গেল শার্টওয়েস্ট কারখানায় শ্রমিকরা ধর্মঘট শুরু করে। এদের ৮০ ভাগ ছিল নারী শ্রমিক। এই ধর্মঘট ১৯১০ সালের ফেব্রুয়ারি পর্যন্ত স্থায়ী হয়। ওই বছরেই মে দিবসে ৬০ হাজার শ্রমিক প্রতিবাদে সমাবেশ করে।
১৯১০ সালের আগস্ট মাসে কোপেনহেগেনে কমিউনিস্টদের দ্বিতীয় আন্তর্জাতিক সম্মেলন অনুষ্ঠিত হয়। সেখানে আন্তর্জাতিক নারী দিবস পালনের প্রস্তাব গ্রহণ করা হয়। ওই বছরই আন্তর্জাতিক শ্রমজীবী নারীর দ্বিতীয় সম্মেলন কোপেনহেগেনে হয়। সেখানে ১৭টি দেশের ১০০ জন নারী প্রতিনিধি অংশ নেন। ওই সম্মেলনে ক্লারা জেটকিন সম্পাদক হিসেবে পুনঃনির্বাচিত হন। সেখানে নিউইয়র্কেও নারী শ্রমিকদের আন্দোলনকে স্বীকৃতি দিয়ে ক্লারা জেটকিন আন্তর্জাতিক নারী দিবস পালনের প্রস্তাব উত্থাপন করেন। সেই প্রস্তাব সমর্থন করেন সম্মেলনে আসা অন্যান্য সদস্যরা। তখন সিদ্ধান্ত হয় মার্চ মাসের যে কোন দিন এই দিবসটি পালন করা হবে। পরে অস্ট্রিয়া, ডেনমার্ক, সুইজারল্যান্ড ও জার্মানীতে নারী দিবস পালিত হয়। ১৯১৩ ও ১৯১৪ সালে আন্তর্জাতিক নারী দিবস প্রথম বিশ্বযুদ্ধের প্রতিবাদ হিসেবে পালিত হয়েছিল। ১৯১৩ সাল পর্যন্ত মার্চের যে কোন দিন নারী দিবস পালিত হলেও ১৯১৪ থেকে সুনির্দিষ্টভাবে ৮ মার্চ নারী দিবস পালিত হচ্ছে।